সা ফ ক থা

অভূতপূর্ব সুযোগ কি অবহেলায় নষ্ট হবে?

মাসুদ কামাল | মতামত
অক্টোবর ১৯, ২০২৪
অভূতপূর্ব সুযোগ কি অবহেলায় নষ্ট হবে?

ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখন দেশের মানুষ শেখ হাসিনা ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের বিতাড়নের আনন্দে উদ্বেলিত ছিল। দাম্ভিক হাসিনা উড়ে ভারতে চলে গেছে, তার বাগাড়ম্বর-প্রিয় মন্ত্রী ও তল্পিবাহক নেতারা পালিয়েছে, সারা দেশে দলের অফিস খোলার লোকও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, অনুগত সাংবাদিকরাও গর্তে লুকিয়েছে- এমন বাস্তবতায় নতুন সরকারের জন্য সময়টা ছিল খুবই অনুকূল। আওয়ামীপন্থিদের বিপরীতে দেশের অপর সকল রাজনৈতিক দলেরই সমর্থন ছিল তখন ড. ইউনূসের পক্ষে। 
 

এত বিপুল সমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় এর আগে আমাদের দেশে অন্য কোনো সরকার বসতে পেরেছিল কিনা সন্দেহ। ড. ইউনূস ও তার পছন্দের মানুষেরা সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন আজ প্রায় আড়াই মাস হয়ে গেল। এই অল্পদিনেই তাদের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা কি ঠিক আগের অবস্থানেই আছে?  সম্ভবত নেই। এটা শুনতে ও মানতে যতই কষ্ট হোক না কেন, এটাই সত্য। এই সরকারকে নিয়ে মানুষের আশাবাদ আর আগের অবস্থানে নেই। এই যে দ্রুততার সঙ্গে সমর্থন হারানো, আমার তো মনে হয় এমন উদাহরণও আর নিকট অতীতে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। প্রশ্ন হচ্ছে ঝামেলাটা কোথায় হলো? 
 

এর পেছনে সরকারের বেশ কয়েকটা ভুলকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। আমার বিবেচনায় প্রথম ভুলটা ছিল উপদেষ্টামণ্ডলী নির্বাচনে। দু’তিন জন বাদে নির্বাচিত উপদেষ্টাদের বেশির ভাগই অতি বয়স্ক, অবসরপ্রাপ্ত। একেবারে শুরু থেকেই এনিয়ে আমি আমার সন্দেহের কথা বলে আসছি। আসলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল বিপুল। শেখ হাসিনার দীর্ঘতম স্বৈরাচারী শাসনে মানুষ এতটাই হতাশ, বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ ছিল যে, সরকার পতনে তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। এরপর ড. ইউনূসের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তি যখন সরকার প্রধানের দায়িত্ব নিলেন, মানুষ ভাবলো এবার বুঝি সব সমস্যারই সমাধান হয়ে যাবে। হাসিনার পতনের পর শুরু থেকেই একটা দাবি ছিল সংস্কারের। সবাই বলছিল বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন সব পরিবর্তন আনতে হবে যেন আগামীতে যারাই ক্ষমতায় বসুন না কেন, তারা যেন আর স্বৈরাচারী শাসনকে রূপান্তর করতে না পারেন। এমন ‘সর্বরোগ সংহারী’ সংস্কারের পাশাপাশি মানুষের প্রত্যাশায় ছিল একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। সরকার যে মানুষের এমন প্রত্যাশার বিষয়টি বুঝতে পারেনি তা কিন্তু নয়। তারা বুঝেছিল। তাই তারা বলেও ছিল, আগে সংস্কার- তারপর নির্বাচন। কিন্তু ঝামেলাটা বাঁধলো অন্য জায়গায়। প্রত্যাশা হিসেবে মানুষ যা উচ্চারণ করেনি, যা এমনি এমনি পেয়ে যাবে বলে সবাই ধারণা করেছিল, সেই দ্রব্যমূল্য নিয়ে। মানুষ ভেবেছিল ওনারা সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করবেন, সেই সঙ্গে দেশটাও ভালোভাবে চালাবেন, মানুষের প্রতিদিনের প্রয়োজনগুলো মেটাবেন। কিন্তু বাস্তবে সেই অনুচ্চারিত বিষয়টিই উপেক্ষিত থেকে গেল। জিনিসপত্রের দাম, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তে বাড়তে আকাশ ছুঁয়ে ফেললো। খাদ্যপণ্যের দাম আগের সরকারের আমলেও বাড়তি ছিল, কিন্তু তখন এর কারণ হিসেবে চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেটের কথা বলা হতো। বলা হতো এই চাঁদাবাজি আর সিন্ডিকেট নাকি সরকারই লালন করে। এখন তো আর সেই সরকার নেই। তাহলে এখন কেন জিনিসপত্রের দাম বড়বে? এ প্রশ্নের জবাব মিলছে না। সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো জবাব দেয়া হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টার কর্মকাণ্ড বা কথাবার্তাও এক্ষেত্রে তেমন গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না। কিছু কিছু সমস্যা থাকে যেগুলো সরকার চাইলেও হয়তো সমাধান করতে পারে না। মানুষ তা বোঝে। কিন্তু মানুষ সেসব ক্ষেত্রেও দেখতে চায় যে, সরকার অন্তত ওই ক্ষেত্রগুলোতে সমাধানের চেষ্টাটা করছে, দৌড়ঝাঁপ করছে। উপদেষ্টাদের বয়সজনিত কারণে কিনা জানি না, তবে এখন সে বিষয়গুলোও যেন দৃশ্যমান হচ্ছে না। ফলে মানুষের মধ্যে বিরক্তি বাড়ছে। অনেক সময় এ বিরক্তি ক্ষোভে রূপান্তরিত হচ্ছে। 
 

বিপরীত দিকে সংস্কারের যে উদ্যোগগুলো নেয়া হয়েছে সেসব নিয়েও যে মানুষ দারুণ কিছু আশাবাদ ব্যক্ত করছে, তেমনও মনে হয় না। সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন অবশ্য গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এসব কমিশনের প্রধান অথবা সদস্যদের পরিচয়ও তেমন একটা আশাবাদী করার মতো নয়। ফলে শেষ পর্যন্ত এইসব কমিশন যে প্রতিবেদন বা সুপারিশ পেশ করবে, সেগুলো দেশের পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার কীভাবে গ্রহণ করবে, কিংবা আদৌ করবে কি-না, তা নিয়েও রয়েছে বিস্তর সন্দেহ। 
 

আমার বিবেচনায় এই সরকারের আর একটি বড় ভুল হচ্ছে ছাত্রদের কয়েকজনকে সরকারের অংশ করে নেয়া। এর ফলে ক্ষতি যেটা হয়েছে, সারা দেশের সংগঠিত ছাত্রশক্তির যে ঐক্যটা ছিল সেটা নষ্ট হয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জনকে উপদেষ্টা করা, তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই আরও একজনকে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী পদে নেয়ার বিষয়টি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অনেক ছাত্র-ছাত্রীকেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি। এই আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও দেশের সবক’টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অংশ নিয়েছে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। উপদেষ্টা করা কিংবা বিশেষ সহকারী পদ দেয়াকে যদি আন্দোলনে অংশ নেয়ার স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে সেই স্বীকৃতি থেকে তো অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীদেরই বঞ্চিত করা হয়েছে। এই বঞ্চনাবোধটি অনেক ছাত্রকেই হতাশ করে তুলেছে। ফলে অবধারিতভাবে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে গড়ে ওঠা ছাত্রদের ঐক্যটি আর আগের অবস্থায় থাকেনি, নষ্ট হয়ে গেছে। 
 

অথচ ওই ঐক্যটি অটুট রাখতে পারলে, তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য একটা বড় ফোর্স হিসেবে কাজ করতে পারতো। এই যে আজ চাঁদাবাজি বন্ধ করা কিংবা বাজার মনিটরিংয়ে সরকার মর্মান্তিকভাবে ব্যর্থ হচ্ছে, এ কাজে তাদেরকে কাজে লাগাতে পারতো। এসবের পাশাপাশি তারা সরকারের সঙ্গেও সাধারণ মানুষের পক্ষ হয়ে একটা প্রেসার গ্রুপ হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারতো। আমার বিবেচনায় সরকার একেবারে শুরুতেই সারা দেশের সমন্বয়কদের নিয়ে একটা কমিটি করে দিতে পারতো। এই কমিটি জনগণের সঙ্গে সরকারের একটা সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করতো। তারা প্রতি মাসে একবার করে সরকারের সঙ্গে বসে জানাতে পারতো সরকারের প্রতি জনগণের পালসটি কেমন। একই ভাবে সরকারের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত করতে পারতো জনগণকে। কিন্তু তা না করে, তিনজনকে পুরস্কৃত করতে গিয়ে পুরো দেশের সংগঠিত একটা শক্তিকে হারিয়েছে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত এই সরকার। 
 

একটা কথা মনে রাখা দরকার, এই যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, এর উপর দেশের মানুষের অনেক বড় আশা। যে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, গণতন্ত্রে উত্তরণের যে প্রত্যাশা জনগণের হৃদয়ে দীর্ঘদিন ধরে লালিত হচ্ছে, সেসব এই সরকারের পক্ষেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলে মানুষ মনে করে। সম্ভাব্য সংস্কারের জন্য পতিত সরকারের দল ব্যতীত আর সকল রাজনৈতিক দলই এই সরকারকে এক ধরনের সমর্থন দিয়ে রেখেছে। এমন সুযোগ আমরা আসলে আর দ্বিতীয়বার হয়তো পাবো না। এরপরও যদি শেষ পর্যন্ত, সেই সংস্কার করা না যায়, সরকারের উপদেষ্টাগণ যদি যেন তেন প্রকারে কেবল চেয়ারে টিকে থাকার কথাই ভাবতে থাকেন, তাহলে জাতির জন্য এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্যের আর কিছুই হবে না।
 

মতামত'র অন্যান্য খবর