ব ই থে কে

শেখ হাসিনাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল ভারতের

মোহাম্মদ আবুল হোসেন | বই থেকে
নভেম্বর ৩০, ২০২৪
শেখ হাসিনাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল ভারতের

২০০৯ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি। (বিলুপ্ত) বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে পুরো দেশ যুদ্ধং দেহী। পিলখানায় শীর্ষ কর্মকর্তাদের হত্যার মধ্যদিয়ে বাঙালি জাতির শিরদাঁড়ায় হিম শিহরণ বয়ে যেতে থাকে। তার চেয়ে নিজে বেশি নিরাপত্তাহীন মনে করতে থাকেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেনাবাহিনীর ওপর তিনি ভরসা করতে পারছিলেন না। ফলে ফোন করেন ভারতকে। ফোনে কথা বলেন তখনকার অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে। পরিস্থিতি জেনে বাংলাদেশে সামরিক অভিযান পরিচালনার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে নেয় ভারত। প্রস্তুত রাখে সেনাবাহিনী ও যুদ্ধবিমান। তিনদিক থেকে বাংলাদেশে অভিযান চালানোর রোডম্যাপ হয়। অপেক্ষা শুধু নির্দেশের। নির্দেশ পেলেই বাংলাদেশে নেমে পড়তো ভারতের প্যারাট্রুপার। কিন্তু এমনটি হয়নি শেষ পর্যন্ত। কারণ ভারতের ভয় ছিল, সামরিক অভিযান চালানো হলে তখনকার বিভক্ত সেনাবাহিনী ভিন্ন অবস্থান নিতে পারতো। হত্যা করা হতে পারতো শেখ হাসিনাকে। অথবা তার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানও হতে পারতো। প্যারাট্রুপাররা ঢাকার দুটি বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে শেখ হাসিনাকে উদ্ধারের পরিকল্পনা করে। কিন্তু তাও হয়নি। কারণ, সেটা করা হলে শেখ হাসিনার ক্যারিয়ারে ‘ভারতের হাতের পুতুল’ বিশেষণ যুক্ত হতো। এতে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেত। ‘ইন্ডিয়াস নিয়ার ইস্ট এ নিউ হিস্টরি’ বইয়ে এসব কথা লিখেছেন ভারতীয় সাংবাদিক অবিনাশ পালিওয়াল। তিনি এসওএএস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ডিপ্লোম্যাসি অ্যান্ড পাবলিক পলিসি বিষয়ক লেকচারার। দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ। তিনি সাবেক সাংবাদিক ও পররাষ্ট্র বিষয়ক বিশ্লেষক। পেঙ্গুইন বুকস থেকে প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়াস নিয়ার ইস্ট এ নিউ হিস্টরি’ বইয়ে বাংলাদেশের বিডিআর বা পিলখানা বিদ্রোহ সম্পর্কে তিনি ভারতের প্রস্তুতি সম্পর্কে লিখেছেন। এখানে তার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো। 


বাংলাদেশে ভারতের সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি সম্পর্কে অবিনাশ পালিওয়াল লিখেছেন- সামরিক অভিযানের দায়িত্বে ছিলেন প্যারাসুট রেজিমেন্টের ৬ষ্ঠ ব্যাটালিয়নের মেজর কমলদীপ সিং সাধু। এটা ছিল ২০০৯ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি বিকাল ৫টা। ওই সময় অর্ডার আসে। একটি ইমার্জেন্সি কোড সক্রিয় করা হলো। প্যারাট্রুপারদের কোম্পানিগুলোকে সচল করা হচ্ছিল। একটি ব্যাটালিয়ান শক্তির স্ট্রাইক ফোর্স জরুরি মোতায়েনের জন্য এলার্ট করা হলো ২৪/৭’কে। ভারতের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে এই সামরিক অভিযানের দায়িত্বকে দেখা হয়। একই রকম একটি ইমার্জেন্সি কোড সক্রিয় করা হলো এবং রাতের জন্য তা আগেই রদ করা হয়েছে। যখন ৫ থেকে ৬টি আইএল-৭৬ যুদ্ধবিমান এবং এএন-৩২ সহ আবার নির্দেশ এলো, সাধু তখন জানতেন বড় কিছু ঘটতে চলেছে। এর আড়াই ঘণ্টা পরে কমপক্ষে এক হাজার ভারতীয় প্যারাট্রুপার অবস্থান নিলেন পশ্চিমবঙ্গের কালাইকুন্দা বিমান বাহিনী স্টেশনে। রাতের জন্য তারা সেখানে অবস্থান করেন। সাধুর কমান্ডিং অফিসাররা নির্দেশনা দিলেন। বিডিআর বিদ্রোহ করেছে এবং বাংলাদেশি কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে। সম্প্রতি নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হাসিনা, যার অধীনে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, তিনি হুমকি বোধ করছেন। তিনি সেনাবাহিনীর সমর্থন পাচ্ছেন না। ‘তিনি ভারতকে সহায়তার জন্য অনুরোধ করেছেন... এবং এ জন্যই আমরা এখানে, নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছি। যখন ঢাকায় অবতরণ করবো তখনকার জন্য আমাদের সব রকম প্রস্তুতি নিতে হচ্ছিল’- স্মরণ করেন সাধু। ঢাকায় অবস্থানরত ভারতীয় কূটনীতিকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল নয়াদিল্লি। কারণ, সহিংসতা যদি ছড়িয়ে পড়ে তাহলে তারা তার মুখোমুখি পড়তে পারেন। 


বাংলাদেশের ইতিহাসে সেনাবাহিনীর অফিসারদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হত্যাকাণ্ড চলছিল। এই হত্যাকাণ্ড শুরু হওয়ার অল্প পরেই নয়াদিল্লিতে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ কংগ্রেসের তখনকার শীর্ষনেতা এবং সম্প্রতি নিয়োজিত অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জীকে ফোন করেন হাসিনা। কী ঘটছে তা শোনার পর ব্যবস্থা নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন তিনি। ঢাকা থেকে ‘এসওএস’ (জরুরি বার্তা) পাওয়াতে প্যারাট্রুপারদের সমবেত ও প্রস্তুতির কাজ শুরু হয়। একই সঙ্গে তার ফলে হাসিনাকে সমর্থন দেয়ার জন্য তদবির করতে যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, জাপান এবং চীনা দূতদের সঙ্গে জরুরি যোগাযোগ করেন পররাষ্ট্র সচিব শিবশঙ্কর মেনন। কালাইকুন্দা ছাড়াও জোরহাট ও আগরতলা থেকেও প্যারাট্রুপারদের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। যদি নির্দেশ আসে তাহলে তিনদিক থেকেই বাংলাদেশে প্রবেশ করবে ভারতীয় সেনা। উদ্দেশ্য ছিল জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (পরিবর্তিত নাম হযরত শাহ্‌জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) এবং তেজগাঁও বিমানবন্দরকে নিরাপদ করা। তারপর প্যারাট্রুপাররা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনের নিয়ন্ত্রণ নেবে এবং হাসিনাকে নিরাপদে উদ্ধার করবে। সক্রিয় লড়াইয়ে প্রথমেই ব্যবহারের জন্য গোলাবারুদ বিতরণ শুরু করেন অপারেশন তত্ত্বাবধানকারী ব্রিগেড কমান্ডার। তাৎক্ষণিক ভয়াবহতা জোর দিয়ে বুঝায় যে, একটি অত্যন্ত অস্বাভাবিক ঘটনা (ঘটে গেছে)। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া ছিল উদ্বেগজনক। যদি বাংলাদেশি জেনারেলরা হাসিনার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, তাহলে তারা ভারতীয় সেনাদের বাধা দেবেন। সাধু বলেন, যদি এমনটা ঘটতো তাহলে পূর্বদিকে ছিল আমাদের একটি পুরো কোর। তারা সেনা পাঠাতো। 
২৭শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে সামরিক হস্তক্ষেপ প্রায় করেই বসেছিল ভারত। কিন্তু সেই নির্দেশ আর কখনো আসেনি। ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার ছিলেন পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী। তার পরিবার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। সম্মান দেখাতে তিনি শেখ হসিনাকে ‘আপা’ (বড় বোন) সম্বোধন করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা কিছু বাহিনীকে এলার্ট রেখেছিলাম এবং হাসিনাকে এই বার্তা জানিয়ে দিয়েছিলাম যে, তার নিরাপত্তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন’। কেন? কারণ ভারত জানতো না এই ঘটনা কতোদূর গড়াবে। 


ঢাকায় বিদ্রোহীরা তাদের মহাপরিচালক ও তার স্ত্রীকে বিডিআর সদর দপ্তর, যাকে পিলখানা (হাতি রাখার আস্তাবল) বলা হয়, তার ভেতরে হত্যা করে। সারা বাংলাদেশে অফিসারদের বিরুদ্ধে একই রকম হামলা হয়। বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদের ওপর ভয়াবহ চাপ ছিল। কিন্তু যদি এমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হতো তাতে রক্তপাত হতো এবং অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতো। এতে হাসিনার রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত মঙ্গল ঝুঁকিতে পড়তো। বিদ্রোহীরা, ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা তাকে হত্যা করতে পারতো অথবা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হতো। এর আগে ২০০৭ সালে তাকে একবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং সেই একই ঘটনা আবারো ঘটতে পারতো। ফলে ভারত কোনো সুযোগ নেয়নি। তারা যেটা প্রয়োজন মনে করেছে, তাই করেছে। বল প্রয়োগের বিরুদ্ধে মইনকে হুমকি দিয়েছিল ভারত। 


ওই সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘ক্ষমতার খুব কাছাকাছি ছিলেন যারা তারা আমাকে বলেছেন যে, জেনারেল মইনকে বল প্রয়োগ না করতে বলা হয়েছিল। যদি তিনি তা করেন তাহলে (ভারতীয়) প্যারাট্রুপারদেরকে এক ঘণ্টার মধ্যে ঢাকার আকাশ থেকে নামিয়ে দেয়া হবে’। ভারত কোনো ভয় দেখাচ্ছিল না। ‘এর সবটাই ছিল বাস্তব। যদি প্রয়োজন হতো তাহলে আমরা হস্তক্ষেপ করতাম’- বলেন ভারতের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার অংশ এমন একজন ভারতীয় শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা। কিন্তু চূড়ান্ত নির্দেশ আসেনি। কারণ, প্রান্তঃসীমা থেকে ফিরে এসেছিলেন জেনারেল মইন। তখনকার সামরিক গোয়েন্দা বিষয়ক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, রাজনৈতিকভাবে সংকটের সমাধান করা উচিত। সেভাবেই সমাধান হয়েছিল’। বান্দরবানে একটি ব্রিগেডের কমান্ড দিচ্ছিলেন লেফটেন্যান্ট  জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) মাহফুজুর রহমান। মইনকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, তার উচিত ছিল নির্দেশ দেয়া এবং সেনাবাহিনীকে সমস্যা সমাধানে অনুমতি দেয়া। 


পরবর্তী দুই দিন ধরে সারা দেশে স্থানীয় বিডিআরের প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদ্রোহের ঢেউ দেখা দেয়। মাহফুজুর রহমান বলেন- ‘এটা রাজনৈতিক ছিল না এবং যেহেতু এটা ছিল সেনাবাহিনীর একটি সংকটময় পরিস্থিতি, তাই আমার মনে হয়েছে রুল অব এনগেজমেন্টের অধীনে সেনাবাহিনীকে প্রতিক্রিয়া দেয়ার অনুমোদন দেয়া উচিত। কিন্তু তা ঘটেনি’। ২০০৯ সালে ভারত হস্তক্ষেপ করলে উপমহাদেশের ইতিহাস বদলে যেতো। কিন্তু তা না ঘটা ছিল একটি শক্তিশালী টার্নিং পয়েন্ট। হাসিনাকে সুরক্ষিত করতে বল প্রয়োগের হুমকি দেয়ার মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে এমনভাবে ভোঁতা করে দিয়েছে যে, তাতে বিরোধীদের মোকাবিলায় দায়মুক্তির সঙ্গে শেখ হাসিনার হাতকে মুক্ত করে দিয়েছে তারা। প্রথম মেয়াদের মতো নয়, রাজনীতিকরণ করা সেনাবাহিনী থেকে আসা চাপ থেকে হাসিনা এখন মুক্ত, এ জন্য ভারতকে ধন্যবাদ দিতে হয়। 


নয়াদিল্লি কেন এভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে? সর্বোপরি, হস্তক্ষেপ করলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে খর্ব করা হতো। একই সঙ্গে আধিপত্যবাদী হিসেবে ভারতের সুনাম ক্ষুণ্ন হতো। এতে হয়তো হাসিনার জীবন রক্ষা হতো। কিন্তু ‘ভারতের হাতের পুতুল’ হিসেবে তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি ছিল। এমনিতেই তিনি এমন অভিযোগের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। ভারত এমন একজন হাসিনাকে প্রত্যক্ষ করে যিনি এই বিদ্রোহকে তার সরকারকে অস্থিতিশীল করা হিসেবে বিশ্বাস করতে থাকেন এবং এমন পদক্ষেপ নেন। পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ‘তিনি নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপও নিয়েছিলেন। কিন্তু বুঝতে পারেন যে, এই বিদ্রোহকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। যেসব পরিবারের অফিসার বা যাদের সহকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে তাদের কাছে যান এবং তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন’। অফিসারদের কাছে লাঞ্ছনা ও হেনস্তা হওয়ার পরও হাসিনা তার অবস্থান ধরে রেখেছিলেন, তাদের কথা শুনেছেন এবং বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন। তৌহিদ হোসেন বলেন- ‘তিনি যা করেছিলেন তা যথার্থ ছিল। কারণ, (পরিস্থিতি) শান্ত করতে এর প্রভাব রয়েছে’। বিদ্রোহ শেষ হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ট্যাংকসহ পিলখানায় প্রবেশ করে সেনাবাহিনী। তারপর গ্রেপ্তার করা হয় প্রায় ২০০ জনকে। (জেনারেল) মইন সংযত থাকার ফলে শেখ হাসিনার ক্ষমতা সুসংহত করার পথ পরিষ্কার হয়ে যায়। যেসব অফিসার অশোভন ব্যবহার করেছিলেন তাদের সবাই চাকরি হারান। বিডিআরকে ভেঙে দেয়া হয়। পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ‘তিনি এটা করেছেন খুব বলিষ্ঠভাবে এবং সাহসের সঙ্গে, তিনি ইস্পাতকঠিন একজন সাহসী নারী’। 
অনুবাদ: মোহাম্মদ আবুল হোসেন

বই থেকে'র অন্যান্য খবর