কলকাতার চিঠি

ভাতা-খয়রাতির রাজনীতি বদলে দিচ্ছে ভোটার চরিত্র

পরিতোষ পাল, কলকাতা | মতামত
নভেম্বর ৩০, ২০২৪
ভাতা-খয়রাতির রাজনীতি বদলে দিচ্ছে ভোটার চরিত্র

ভারতে বিভিন্ন নির্বাচনে ভাতা-খয়রাতির রাজনীতি প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন সমীক্ষা ও গবেষণাতেও ভাতা-খয়রাতির প্রভাবে ভোটারদের মনস্তত্ত্ব যে পাল্টে যাচ্ছে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক দলগুলোও ক্ষমতা দখলের দিকে লক্ষ্য রেখে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে নগদ ভাতা দেয়ার বেপরোয়া প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছে। এবং সাফল্যও আসছে। 
সমপ্রতি ভারতের দুই রাজ্যে অনুষ্ঠিত বিধানসভার নির্বাচনে দেখা গিয়েছে নারী ভোটাররা প্রবলভাবে জয়ের কারিগর হিসেবে উঠে এসেছে। নগদে ভাতা প্রদান ও অন্যান্য খয়রাতির প্রকল্প ভোটের ফলাফলে নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়েছে। মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ডের বিধানসভা নির্বাচনে মহিলাদের নগদ ভাতা প্রকল্প শাসকদলকে বাজিমাৎ করতে সাহায্য করেছে। দুই রাজ্যেই দেখা গিয়েছে মহিলা ভোটাররা ব্যাপক সংখ্যায় ভোটদানে অংশ নিয়েছেন। 


২০২১ সালের নির্বাচনের আগে তৃণমূল কংগ্রেসের পরামর্শদাতা সংস্থা আইপ্যাকের তৎকালীন কর্ণধার ভোট কুশলী হিসেবে সুপরিচিত প্রশান্ত কিশোর নারীদের জন্য নগদ ভাতা দানের মাধ্যমে নারীদের বড় অংশকে তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে টেনে আনার পথ বাতলেছিলেন। সেই পরামর্শ মতোই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ নামে প্রকল্পের মাধ্যমে ২৫ থেকে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত আর্থিকভাবে দুর্বল নারীদের হাতে মাসে মাসে নগদ অর্থ তুলে দেয়ার সূচনা করেছিলেন। প্রথমে ৫০০ রুপি দিয়ে শুরু করে এখন তা ১০০০ থেকে ১২০০ রুপি দেয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। আগামী দিনে এই ভাতার অর্থ আরও বাড়িয়ে ১৫০০ রুপির কথাও জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতি মাসের শেষে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ঢুকে যাচ্ছে এই নগদ অর্থ। একই সঙ্গে আরও নারীকে এই প্রকল্পের আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। অভিযোগ এই ভাতা দেয়ার ক্ষেত্রে এখন ভোটের স্বার্থে ‘দুর্বল’ মাপকাঠি দেখা হচ্ছে না। যতবেশি মানুষকে এর আওতায় আনা যাবে ততই ভোট ব্যাংক শক্তিশালী হয়ে উঠবে। আর এই ভাতার টানে নারীরা নির্বাচনের মঞ্চে তৃণমূল কংগ্রেসের সহায়ক ভূমিকা নিয়ে ভোট বৈতরণী পার করা সহজ করে দিয়েছে বলে নির্বাচনী ফলাফলের তথ্যে তা উঠে এসেছে। নির্বাচনী ময়দানে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে এই ভাতা-খয়রাতির প্রকল্প। সমপ্রতি রাজ্যে ৬টি উপনির্বাচনের ছয়টিতেই তৃণমূল কংগ্রেস যেভাবে কংগ্রেস ও বাম প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত করে এবং ভারতীয় জনতা পার্টিকে অনেক পেছনে রেখে জয়ী হয়েছে তাতেও স্পষ্ট হয়েছে ভাতা-খয়রাতির রাজনীতির ভূমিকা।  অবশ্য শুধু নারীদের থেকে নগদ অর্থ তুলে দেয়াই নয়, বিধবা ও বয়স্কদের হাতেও নগদ অর্থের যোগান দেয়ার নানা প্রকল্প চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। 


পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এই প্রকল্পই এখন মডেল প্রকল্প হিসেবে রাজ্যে রাজ্যে কাজে লাগাচ্ছে শাসক থেকে শুরু করে বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। রাজ্যে রাজ্যে এই ভাতা-খয়রাতির বাহারি নাম দেয়া হয়েছে। কোথাও এই প্রকল্পের নাম ‘লাড়কি বহিন’ (আদরের বোন), কোথাও এর নাম দেয়া হয়েছে ‘মাইয়া সম্মান’। কর্ণাটকে চালু করা হয়েছে ‘গৃহলক্ষ্মী’ নামে এবং তেলেঙ্গানায় ‘মহালক্ষ্মী’ নামের নারীদের নগদ ভাতা দানের প্রকল্প।


মহারাষ্ট্রে লোকসভা নির্বাচনে ভরাডুবির পর এবার বিধানসভা নির্বাচনের আগেই চালু করা হয় ‘লাড়কি বহিন’ প্রকল্পের মাধ্যমে ১৫০০ রুপি প্রদান প্রকল্প। নির্বাচনের আগেই বকেয়া পাঁচ মাসের অর্থ ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেয়া হয়। মধ্যপ্রদেশের ভারতীয় জনতা পার্টির সরকারের সাফল্যের অনুসারী হয়ে মহারাষ্ট্রেও এই ভাতা প্রকল্পের মাধ্যমে ভারতীয় জনতা পার্টি  নির্বাচনে বিপুল সাফল্য পেয়েছে। মহারাষ্ট্রের ৯.৬৪ কোটি ভোটারের মধ্যে ২.৫ কোটি নারীই ‘লাড়কি বহিন’ প্রকল্পের অর্থ পেয়েছেন। এবারের রাজ্যে মহিলা ভোটারও বেড়েছে ৫৩ লাখ। তাই উপভোক্তাদের অর্ধেকের বেশি নারী ভোটই (১০ শতাংশ) বাজিমাৎ করতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে। ঝাড়খণ্ডেও মাইয়া সম্মানের মাধ্যমে এক হাজার রুপি করে দেয়া হচ্ছিল। তারও সুফল পেয়েছে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা-কংগ্রেস সরকার। সেখানে ১.২৮ কোটি ভোটারের মধ্যে ৫২ লাখ নারীই অর্থ পেয়েছেন। তারাই এবার হেমন্ত সোরেনের জয় নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বলে নির্বাচনী ফলাফলের তথ্যে উঠে এসেছে। কর্ণাটকেও নির্বাচনের আগে নানা ভাতা ও খয়রাতির প্রতিশ্রুতি দিয়ে কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেই ভাতা দেয়া শুরু করেছে। আরও নানা প্রতিশ্রুতি, যেমন নারীদের বাসভাড়া ফ্রি করে দেয়া হয়েছে। তেলেঙ্গানাতেও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ক্ষমতায় এসে কংগ্রেস নারীদের ভাতা প্রদান শুরু করেছে। 


ভাতা-খয়রাতি যেভাবে নির্বাচনে প্রভাব রাখছে তাতে আগামী দিনে সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে অনুদান সংস্কৃতি প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠবে বলে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা। এক সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভাতা দেয়ার প্রকল্পগুলোকে ‘‘রেউড়ি রাজনীতি” (খয়রাতির রাজনীতি বলে কটাক্ষ করেছিলেন। কিন্তু ভাতা প্রকল্পের সাফল্য দেখে ভারতীয় জনতা পার্টির সরকারগুলোও রাজ্যে রাজ্যে একই পথে হাঁটছে। 


অবশ্য এই ভাবে নগদে অর্থ যোগান নিয়ে বিতর্কও রয়েছে সমাজবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে। প্রশ্ন উঠেছে, এই ভাতা-খয়রাতির অর্থ কি সত্যি সত্যিই নারীর ক্ষমতায়নে সাহায্য করছে? তবে ভাতা প্রদানের সমর্থকদের মতে, ভাতা-খয়রাতির প্রকল্প, বিশেষ করে ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’-এর মতো প্রকল্প নারীদের মধ্যে নিরাপত্তার বোধ যেমন এনে দিয়েছে তেমনি তাদের জীবনে  স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিয়েছে। ফলে সার্বিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এরাই এগুলোকে জনকল্যাণমূলক প্রকল্প হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এই ধরনের প্রকল্পের সমর্থক। তার মতে, এর ফলে মানুষের হাতে অর্থের জোগান আসছে, যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখতে সাহায্যই করছে।


কিন্তু অর্থনীতিবিদদের এক বড় অংশই প্রশ্ন তুলেছেন এই বিপুল পরিমাণ ভাতা-খয়রাতির অর্থ, যা আগামী দিনে আরও বাড়বে বলেই ধরে নেয়া যায় তা আসছে কোথা থেকে? ভারত সরকারের অর্থ মন্ত্রকের অধীনস্থ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিন্যান্স  অ্যান্ড পলিসি এক রিপোর্টে জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন ভাতার অর্থ দেয়া হচ্ছে ঋণের অর্থ থেকে। বিভিন্ন রাজ্য এই একই ভাবে ভাতা ও খয়রাতি খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করছে। ফলে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ ব্যাহত হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের আশঙ্কা, এই প্রবণতা চলতে থাকলে এক পর্যায়ে এসে দেউলিয়ার পথে না ঠেলে দেয় রাজ্যগুলোকে। বিশিষ্ট প্রবীণ সাংবাদিক তাভলিন সিং এই ভাতা-খয়রাতিকে ‘বেপরোয়া জনপ্রিয়তা’ অর্জনের চেষ্টা হিসেবে অভিহিত করেছেন। দারিদ্র্য দূরীকরণে এই ধরনের ভাতা সংস্কৃতির কোনো ভূমিকাই নেই বলেও  মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।  


একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, এক সময় ভোটাররা যেভাবে নানা ইস্যুতে সোচ্চার হতেন, উন্নয়নের দাবিতে মুখর হতেন সেখান থেকে কি তারা সরে আসছেন এই ভাতা-খয়রাতির টানে? নির্বাচনী রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের মতে, সাইলেন্ট ভোটাররাই নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণ করার পথে চলেছে। আসলেই কি এই ভাবে ভোটারদের চরিত্রের আমূল পরিবর্তন ঘটতে চলেছে? একদল বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, ভাতা-খয়রাতির প্রলোভন (প্রতিশ্রুতি) ফেলে ভোটারদের যেভাবে প্রভাবিত করা হচ্ছে তা নির্বাচনে দুর্নীতির জন্ম দিতে চলেছে। 

মতামত'র অন্যান্য খবর