আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও সরকারপ্রধানের পালিয়ে যাওয়ার ধাক্কা-প্রভাব ভারতের ওপর গিয়ে পড়েছে। যখন নতুন সরকার বাংলাদেশের স্বার্থে কথা বলা শুরু করলো তখন কিন্তু তারা আরও প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করলো। এর প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি ভারতের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে যে বক্তব্য দিচ্ছেন সেগুলো ঠিক বন্ধুসুলভ নয়।
গত রোববার রাতে চ্যানেল আইয়ের ‘আজকের সংবাদপত্র’ অনুষ্ঠানে মানবজমিন প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঞ্চালনায় অতিথি ছিলেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। প্রথম আলোর ২৬তম জন্মদিনের বিশেষ আয়োজনে মতিউর রহমান সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন। তিনি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে আরও বলেন, এই বক্তব্যগুলো মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে হিন্দুদের পূজা নিয়ে যে আলোচনা হয়েছে সেগুলো কিন্তু খুব সহায়ক বা ভালো হয়নি। মাত্রাতিরিক্ত তথ্য ও সংখ্যা দিয়ে মনে হলো এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করা হলো যে মনে হলো বাংলাদেশে একটা ভীষণ ভয়ঙ্কর রকমের ধর্মীয় উন্মাদনা চলছে এবং হিন্দুসমাজকে আঘাত করছে। আক্রমণ নিয়ে প্রথম আলো সারা দেশের ৪৮টি জেলার খবর সংগ্রহ করেছিল সেখানে মাত্র দু’টি মৃত্যুর খবর আমরা পেয়েছি এবং ৫০০’র মতো ঘটনা পেয়েছি। এটা কিন্তু ভারতের বিভিন্ন পত্রিকায় ৩০০ জন থেকে ৫০০ জনের মৃত্যুর খবর প্রকাশ করলো। সর্বশেষ ট্রাম্পের এই বক্তব্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয়দের প্রভাবেই হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। ট্রাম্পও এটা দিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ভারতীয়দের ভোট পেতেই। সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার যথেষ্ট সজাগ এবং দায়িত্বশীলতার সঙ্গে আচরণ করছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আমাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়ন করা জরুরি। দুই দেশের স্বার্থেই তা গুরুত্বপূর্ণ। এখন ভারত এটা বুঝে না উঠতে পারলেও তিনি আশা করেন ভারত এটা বুঝে উঠবেন। আশা করছেন মৈত্রী সম্পর্কটা পুনরায় সঠিক স্থানে অবস্থান করবে।
তিনি আরও বলেন, ভারতের সঙ্গে সীমান্তে অস্থিরতা, বাংলাদেশিদের নিহতের ঘটনা এখনো চলছে। বার বার ভারতের পক্ষ থেকে বলা হলেও এটা এখনো বন্ধ হয়নি। দুই দেশের যৌথ নদীর পানিবণ্টন বিষয়ক যে বিষয়গুলো আছে, সেখানেও সমস্যা রয়েছে এবং এটা পূর্ণতা হয়নি। বিগত স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতন ভারত স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। বিগত সময়ে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক একটা পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যেখানে ভারত খুবই নিশ্চিন্তবোধ করেছে। তারা মনে করেছে এটা তাদের জন্য একটা ভালো এবং স্থায়ী ব্যবস্থা। এজন্য তারা বিগত সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখেছিল। বাংলাদেশ-ভারত পাশাপাশি দু’টি দেশ। একটা বৃহৎ দেশ, তার পাশে আমরা ছোট একটা দেশ। ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের গুরুত্ব গত এক-দুই দশকে অনেক বেড়েছে। স্বাভাবিকভাবে আমরা চাই, অর্থাৎ বিগত কোনো সরকার এটা অস্বীকার করতে পারেনি যে-দুটো দেশের মধ্যে একটা স্বাভাবিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা উচিত। কারণ আমাদের অবশ্যই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগব্যবস্থা, আসা-যাওয়া, শিল্পকারখানা, বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ নানা ক্ষেত্রে সম্পর্ক অব্যাহত থাকুক এটা আমরা চেয়েছি। তবে আমরা চাইলেও দুই দেশের সরকারের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকভাবে অগ্রসর হয়নি।
আমরা দেখতে পেয়েছি, বিগত সময়গুলোতে দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের কথা বলা হলেও তিস্তা নদীর পানি কিন্তু আমরা পাইনি। এমনকি গঙ্গা নদীর পানি নিয়েও আমাদের আলোচনা শেষ হয়নি। আরও আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে মতিউর রহমান বলেন, ১৯৬২ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি প্রথম মিছিলে যোগ দিলাম। তখন ছিল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন। তখন প্রধান দাবি ছিল সামরিক শাসন বাতিল হোক, গণতন্ত্র চাই, নির্বাচন চাই, কথা বলার অধিকার চাই, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চাই। স্বাধীনতার ৫৩/৫৪ বছর পরও আমরা দেখি ওই জায়গাতেই ঘুরপাক খাচ্ছি। কথা বলার অধিকার চাই, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চাই, নির্বাচন চাই, গণতন্ত্র চাই। এরমধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, বেশ কয়েকটা নির্বাচন হলো। ক্রমাগত যেনো স্বৈরতন্ত্র থেকে কঠোর স্বৈরতন্ত্রের দিকে আমাদের যাত্রা অব্যাহত থাকলো। বিগত সময়কালে তো আমরা কঠোর স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে ছিলাম। আমরা স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম। এটা নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। রাজনৈতিক দল, সামাজিক শক্তি, ছাত্ররা আন্দোলন করেছেন। লেখক, বুদ্ধিজীবীরা কথা বলেছেন। বিগত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার এই গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে এই স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতন হয়েছে। এটা পরিবর্তন এনেছে। বিগত কয়েক দশক থেকে রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মধ্যদিয়ে দেশটা চলেছে। ১০/১৫ বছর পরপর একটা বড় পরিবর্তন হয়। ঘুরে ফিরে আমরা একই জায়গায় যাই। খারাপের থেকে আরও খারাপের দিকে যাই। এবারের পরিবর্তনের পরে আমরা আশা করছি, আমরা স্বপ্ন দেখছি দেশে একটা স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরে আসবে। ভালো নির্বাচন হবে। একটা গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে আমাদের সকল কার্যক্রম পরিচালনা হবে। বিশেষ করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা গত সরকারের আমলে আমরা পাইনি। নিগৃহীত হয়েছি। মামলা-মোকদ্দমার ভারে নিমজ্জিত হয়েছিলাম। আমরা স্বাধীন দলনিরপেক্ষ সাংবাদিকতা করতে চাই। বিভিন্ন সময়ের সাংবাদিকতার প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০০৯ সালের পরে আমাদের চরম নিপীড়নের মধ্যদিয়ে চলতে হয়েছে। বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, প্রথম আলো আওয়ামী লীগের শত্রু, প্রথম আলো গণতন্ত্রের শত্রু, বাংলাদেশের শত্রু। বিগত ৩ মাস আমরা একটা মুক্ত পরিবেশের মধ্যে রয়েছি। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আপনারা মন খুলে লিখুন, সমালোচনা করুন- কোনো সমস্যা নেই। সেটা আমরা উপভোগ করছি। এটা ঠিক কিছু কিছু মহল, ব্যক্তি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলছেন, তারা সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলছেন। তারা পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ার কথা বলছেন। এসব গণতান্ত্রিক সমাজ, রাষ্ট্রের জন্য শুভ ফল বয়ে আনে না। এর কারণে সমাজের মধ্যে কিছু অস্থিরতা, অনিশ্চিয়তা রয়েছে। আশাকরি আগামীতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও স্থিতিশীল হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিন মাস পূর্ণ হতে চলেছে। অগ্রগতি কতোটুকু দেখছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেক সময় আমরা বলি ১০০ দিন দেখবো, দেখতে চাই। সেটারও বেশি সময় বাকি নেই। অন্তর্বর্তী সরকার এমন একটা সময়ে ক্ষমতা নিয়েছে যখন প্রশাসনিক ব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা, শিল্পকারখানা ব্যবস্থা একটা সংকটে এবং ভেঙে পড়া অবস্থায়। প্রথম যে দায়িত্ব ছিল আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, শান্তি ফিরিয়ে আনা, অর্থনীতিকে গতিশীল করা। তারা করছেন, হচ্ছে। কিন্তু যে পরিমাণে হবার কথা ছিল তা হয় নি। পুলিশ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক হয়নি। এ ধরনের পরিস্থিতিতে অনেক জায়গায় মনে হয় ঠিকমতো কাজগুলো হচ্ছে না। প্রশাসন শিক্ষাব্যবস্থা স্বাস্থ্যখাত এগুলো কিছুটা সমস্যার মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। এগুলোকে আমি অস্বাভাবিকও মনে করি না। আমরা দেখতে চাই অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা যথেষ্ট উদ্যমী হয়েছেন, কথা বলছেন, মানুষের কাছে যাচ্ছেন এবং দৃশ্যমানভাবে সমস্যাগুলো সমাধানে চেষ্টা করছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার ব্যবস্থা করা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা, স্বাভাবিক শিক্ষা-স্বাস্থ্যব্যবস্থা যাতে পরিচালিত হয় সেদিকে নজর দেয়া।
তিনি বলেন, বিগত সময়গুলোতে ’৯৬, ২০০১, ২০০৯ এ সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন ১১ জন। সেখানে এখন আছেন ২১ জন। সংখ্যা কম নয়। তবে সেটা ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার এটা অন্তর্বর্তী সরকার। এখন এটার সময় আমরা জানি না। সংখ্যার চেয়েও দক্ষতা- যোগ্যতার প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেয়া। দায়িত্ব নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া তেমন পরিবেশ পরিস্থিতির জন্য অনেকক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের যে সদস্য তারা ব্যক্তি ধরে করেছেন দায়িত্ব বা মন্ত্রণালয় ধরে করেননি। তার ফলে এখানে একটা ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। বোধহয় এখন অন্তর্বর্তী সরকারের পুনর্গঠনের প্রয়োজন হয়েছে।
প্রথম আলো সম্পাদক বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার শুরু থেকে বলে আসছে, তারা সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, দুর্নীতি দমন এক্ষেত্রে তারা কিছু পরিবর্তন আনতে চান। তারা বলছেন, এবারে যদি সংস্কার করা না যায় আগামীতে সংস্কার করা আরও কঠিন হয়ে যাবে। তারা কিছুটা সময় নিতে চান বলে আমরা ধারণা করি। তারা ৬টি কমিশন গঠন করেছেন। আরও ৪টি গঠন করার প্রক্রিয়ায় আছে। তাদের লক্ষ্য হলো আগামীতে রিপোর্টগুলো নিয়ে এগুলো পর্যালোচনা করবেন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। এরপর নির্বাচনের দিকে যাত্রা শুরু করবেন তবে এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মত-ভিন্নতা আছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) মনে হচ্ছে তারা দ্রুততম সময়েই নির্বাচন চাচ্ছেন। খুব দ্রুত না হলেও এক বছর বা খুব বেশি হলে দেড় বছর তারা বিবেচনা করেন। অন্যান্য দলগুলোর মধ্যেও এই দাবি আছে। আমরা আশাকরি যদি আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চের দিকে অন্তর্বর্তী সরকার আলোচনা শুরু করবেন। তখন আমরা আরেকটু পরিষ্কার চিত্র পাবো। শেষ বিচারে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারই কাম্য। তারাই দেশ পরিচালনা করবেন। যদিও উপদেষ্টা মহল থেকেই বলছেন, সংস্কার সম্পূর্ণ করে তারপর নির্বাচন। তারা কতোটুকু সংস্কার হলে সন্তুষ্ট হবেন এটা আলোচ্য বিষয়। হয়তো এ নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত হতে পারে। আমার মনে হয় ফেব্রুয়ারি-মার্চে আরেকটু পরিষ্কার ধারণা আমরা পাবো।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে ২ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এই টাকা আনার বিষয়ে চেষ্টা চলছে। অন্তর্বর্তী সরকার এই কাজগুলো শুরু করেছেন। যিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন, যিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান তাদের বেশকিছু সাহসী উদ্যোগ উৎসাহজনক। তবে কাজগুলো সহজ না। ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ওনারা কথা বলছেন। আমরা আশা করবো যে, এ বিষয়েও ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং তারা সফল হবেন। ইতিমধ্যেই অর্থনৈতিক খাতের দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রস্তুতে কমিটি কাজ করছে। তাদের কাছ থেকেও আমরা হয়তো পেছনের ঘটনার অনেক কিছু জানতে পারবো। বিগত স্বৈরতান্ত্রিক সময়ের সমস্যাগুলো সেটা রাজনৈতিক, অর্থনীতি, সমাজ, আইনশৃঙ্খলা, ব্যাংকগুলো সব ভেঙে গেছে। এই অব্যবস্থাপনা দুর্নীতি, ভাঙন থেকেও বের হয়ে আসা সহজ বিষয় না। গত ২০/৩০/৪০ একটা স্বেচ্ছাচারিতা চলেছে, রাজনীতি-অর্থনীতি সবখানে। দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এটা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া বা সহজ ব্যবস্থা নেয়া খুব সহজ নয়। কাজগুলো দীর্ঘমেয়াদি। এটা শুধু অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে শেষ হয়ে যাবে না। পরবর্তী সরকারকেও দায়িত্ব নিতে হবে। সেখানে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর হয়তো সমঝোতার ব্যাপারও আছে। যদিও আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, ২০০৭/০৮ সরকারের মধ্যেও এই ধরনের প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথা ছিল, চিন্তা ছিল। সমঝোতাতেও এসেছিলেন কিন্তু কোনো কিছু টিকেনি। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার যেনতেনভাবে তাদের মতো করে দেশ পরিচালনা করেছেন। এবারো যে সেই সম্ভাবনা নেই তা নয়।
তাহলে এই সময় নিয়ে লাভ কী হবে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশীয়, রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার একটা পরিবর্তনের দাবি এসেছে। এই চাওয়াটা আমাদের বহু দিনের। সেজন্য যদি প্রয়োজনীয় সময় নিতে হয় সমঝোতার মধ্যদিয়ে নির্বাচনের দিকে যাওয়া নির্বাচন করা নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করা একটা লক্ষ্য, দায়িত্ব।
তিন জোটের রূপরেখা কেউ মানেনি, ১/১১ সময়েও যেটা বলা হয়েছিল সেটাও মানেনি। তাহলে সামনে মানবে এমন কোনো কথা কী আছে? এর জবাবে তিনি বলেন, এখন হয়তো মানুষের চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন এসেছে। লক্ষ-কোটি মানুষ পরিবর্তনের জন্য যে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। যদিও তিন মাস আগের অবস্থা এখন নেই। এটা যে একদম নেই এটা ঠিক না তেমনি এটা যে ফিরে আসবে না এটাও ঠিক না।
সরকার মানুষের দুঃখকষ্ট লাঘব করতে না পারলে তো সংস্কার নিয়ে চিন্তা করবে না? এর জবাবে বলেন, দুঃখকষ্ট লাঘবের বিষয়টা এক, দুই মাস বা ১০০ দিনের বিষয় নয়। কিছু পদক্ষেপ অন্তর্বর্তী সরকার নিয়েছে। তারা আশা করেন আগামী দুই মাসের মধ্যে এসব ক্ষেত্রে তাদের অগ্রগতি হবে। আমরা একটু অপেক্ষা করতে বা সময় দিতে পারি। দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতির উন্নয়ন, আইনশৃঙ্খলা উন্নয়ন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয় কিনা? আরও কিছুদিন আমরা দেখতে পারি। ড. ইউনূস বলেছেন, আপনারা সমালোচনা করেন। আপনারা সমালোচনা করলেই সংশোধন হবো। সেদিক থেকে আমাদেরও দায়িত্ব রয়েছে। এটাও ঠিক সবকিছু দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে না।
শেখ হাসিনার ফিরে আসার সম্ভাবনা কতোটুকু? প্রশ্নের জবাবে মতিউর রহমান বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমরা দেখতে পেয়েছি, স্বৈরতান্ত্রিক সরকার পতনের পর তারা আবার ফিরে এসেছে। এমনকি বিদেশে পলায়নের পরও ফিরে এসেছে, ফিলিপিনের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি সেটা। হাইতি বা দুয়েকটা দেশের কথা শুনেছি, তারা ফিরে এসেছে। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া এবং তার দলের একটা বড় অংশ যারা মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য ছিলেন তারাও পালিয়ে গেছেন। দেশের ভেতরে যারা আছেন তাদের বড় অংশ জেলে বা লুকিয়ে আছেন। বর্তমান সরকার তাদের বিচার করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন। বিচার হবে, বিচারের জন্য হয়তো আমাদের কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। জুলাই-আগস্টে মানুষের যে ক্ষোভ দেখেছি, এটা আমরা অতীতে জানতাম কিন্তু, এটা প্রকাশ্যে এমনভাবে আমাদের সামনে দৃশ্যমান হয়নি। মানুষের মধ্যে যে ঘৃণার উদ্রেক হয়েছে, অনাস্থা তৈরি হয়েছে, সেখানে আগামী দিনে ফিরে এসে নির্বাচনের মাধ্যমে দ্রুত বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম দেখা যায়। আমি মনে করি, আগামী দশ বছরের মধ্যে তাদের ফিরে আসা, দল পুনর্গঠন ও দল পরিচালনা করা এবং নির্বাচন বা গণআন্দোলনের মধ্যদিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি না।
স্বাধীন সাংবাদিকতা নিয়ে প্রশ্নে মতিউর রহমান বলেন, বিগত আমলগুলোতে কোনো সময়েই আমরা স্বাধীন সাংবাদিকতা করতে পারিনি। বিগত তিন মাসেও নানা রকম অস্থিরতা, ভয় ও দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকতে হচ্ছে। নানা রকম চাপের মধ্যে থাকতে হচ্ছে। অতীতে দেখেছি কিছু আইন-কানুন বা ব্যবস্থা সরকার নিয়েছিল। আমরা অবশ্য সেই আইন বাতিল দাবি করবো। বিশেষ করে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন-এটা বাতিল করার দাবি ছিল। এই আইনে অনেক মামলা হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে এখনো একটা মামলা চলমান। এই আইনগুলো বাতিল করা অত্যন্ত জরুরি। বিগত সরকার আরও চার/পাঁচটি আইন করার উদ্যোগ নিয়েছিল। সংসদে একটি/দু’টি পাসও হয়েছিল সেগুলো বাতিল করতে হবে। একটা মিডিয়া কমিশন গঠনের উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। আমরা আশা করবো তাদের প্রস্তাবনা যদি বাস্তবমুখী হয় সেটা যদি সহায়ক হয় তাহলে আমরা সমর্থন জানাবো। আমরা আশা করবো অন্তর্বর্তী সরকার স্বাধীন সাংবাদিকতার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখবেন। স্বাধীন সাংবাদিকতা একমাত্র নিশ্চিত করতে পারে গণতন্ত্র।
অনুলিখন: পিয়াস সরকার