লেখক, গবেষক ও বামপন্থি রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর সাফ কথার কারিগর। পারিবারিকভাবেই রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বয়ে চলেছেন তিনি। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন নিয়ে তার রয়েছে নিজস্ব চিন্তার ক্ষেত্র। প্রায় ছয় দশক ধরে এদেশের রাজনীতি, সমাজনীতি ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে গবেষণা করে চলেছেন। যার প্রকাশ ঘটেছে শতাধিক বইতে। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের আগে ও পরে তিনি স্পষ্ট বক্তব্য রেখে চলেছেন। কী হতে চলেছে সামনের দিনগুলোতে? অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কী কী করতে পারবে? আগামীর রাজনীতি কোথায় নিয়ে যাবে দেশকে? মীরপুরের রূপনগরের বাসায় মুখোমুখি হই এক সন্ধ্যায়। বর্ষীয়ান এই রাজনীতিক চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলতে শুরু করেন রাজনীতির পরিবর্তনকে কীভাবে দেখছেন। বললেন, এই যে পরিবর্তন, সাংবিধানিক নিয়মকানুন মেনেই তারা এই কর্ম করেছে। সংবিধানের বারোটা বাজিয়েই তারা সংবিধানকে রেখেছে। এই সরকারের একটা কাজ হবে কিছু খুঁটিনাটি সংস্কার করে নির্বাচনটা শেষ করা। সংবিধান নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে কিন্তু এ সরকারের তো এমন কোনো ম্যান্ডেট নেই যে, তারা সংবিধানে বড় রকমের কোনো পরিবর্তন করতে পারে। নির্বাচিতরা পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে দেশ চালাবার কাজও করবে এবং অন্যদিকে সংবিধানও সংশোধন করবে। এটা নতুন কোনো কথা নয়, ভারত যখন স্বাধীন হলো তখন এভাবেই চলেছে। তাদের পার্লামেন্ট একই সঙ্গে সংবিধান সভা হিসেবেও কাজ করেছে। এখানেও অর্থপূর্ণ কোনো সাংবিধানিক সংস্কার করতে হলে নির্বাচিত সরকার লাগবে।
ক্ষমতার দিক থেকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা সীমিত। তাদের হাত-পা বাঁধা। এখানে তারা যে কাজটি করতে পারে, সংস্কার ও নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে ধরনের ফাঁকি ও দুর্নীতি ছিল তা বন্ধের ব্যবস্থা নেয়া। সামনে যে নির্বাচন হবে তা সুষ্ঠুু ও নিরপেক্ষ করা এবং তার জন্য প্রয়োজন নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠিত করা। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যে ক’টি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে তারা ছিল তল্পিবাহী। প্রতিটি নির্বাচন কমিশন ছিল হাসিনার ভৃত্য। অন্তর্বর্তী সরকারকে এমন একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে যারা কোনো দল বা পক্ষের হয়ে কাজ করবে না।
বাজার পরিস্থিতি নিয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, জিনিসপত্রের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হলে জরুরি চাল-ডাল-আটা-চিনি-ভোজ্য তেল এগুলোর রেশনিং জরুরি। নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে ধনীদের কোনো সমস্যা না। সমস্যা হয় যারা মধ্যবিত্ত তাদের। ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে রেশনিং পদ্ধতি চালু করলে জিনিসপত্রের দাম কমতে বাধ্য। রেশনিং ব্যবস্থা চালু থাকলে মজুতদাররা জিনিসপত্রের দাম ইচ্ছামতো বাড়াতে পারবে না। কোনো পণ্যের দাম মজুতদাররা বাড়ালে সরকার সেই সকল পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে রেশনিং করলে বাজার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সহজ কাজ নয়। মূল্যস্ফীতি এমন এক সমস্যা যাতে সর্বস্তরের জনগণ কষ্ট ভোগ করে।
নির্বাচন করতে ১৮ মাস লাগতে পারে- সেনাপ্রধানের এ বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেনাপ্রধান অনেক কিছুই বলেছেন। তিনি তো শেখ হাসিনাকে ভারত পার করে দিয়ে অবলীলায় বলেছেন তার চলে যাওয়ার কথা তিনি কিছুই জানেন না। এটা কোনো নির্বোধও বিশ্বাস করবেন না যে, শেখ হাসিনা চলে যাচ্ছে তিনি জানতেন না। নির্বাচন নিয়ে তিনি পরামর্শ দিতে পারেন। সময়সীমা কতোদিন হবে- যারা এখন সরকারে আছেন তারা কি লক্ষ্য স্থির করবে তার ওপর নির্ভর করছে। সময়সীমার আলোচনা এখনই নির্ধারণ করা যাবে না। নির্ভর করছে তারা কী করবে তার ওপর। ‘আমরা এই এই করতে চাই, আর এগুলো করতে করতে আমাদের এই সময় লাগবে।’ অবাস্তব কিছু করতে চাইলে তা সম্ভব হবে না। দেশের মানুষ নির্বাচন চায়, অনির্বাচিত সরকার বেশি সময় নিলে একটা অস্থিরতা তৈরি হবে। বিএনপিও নির্বাচন চায়। এরা নির্বাচন দিতে দেরি করলে বিএনপি’র মধ্যেও অস্থিরতা তৈরি হবে- তারাও এ সরকারের সমালোচনা করবে- এটা তাদের জন্য ভালো হবে না।
কোটা আন্দোলন থেকে সরকার পতন- রাজনীতিতে কী ধরনের পরিবর্তন দেখছেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কোটা আন্দোলন চাকরির জন্য হলেও এটাকে অরাজনৈতিক মনে করার কোনো কারণ নেই। রাজনীতিই এর মহা গুরুত্বপূর্ণ দিক। কোটা আন্দোলন যখন চলতে লাগলো তখন শেখ হাসিনা এদের বিরোধিতা করে নানা অঘটন ঘটাতে লাগলো। একপর্যায়ে সে এদেরকে রাজাকার বললো। এসব বলে তারা ছাত্রদের আরও ক্ষেপিয়ে দিলো। প্রথমদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়- এরপর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্দোলনে যুক্ত হতে লাগলো। কলেজ ও স্কুলের ছেলেরাও আন্দোলনে সম্পৃক্ত হলো। দুই তারিখের দিকে আন্দোলন কিছুটা শান্ত হলেও শেখ হাসিনার ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথায় আন্দোলন আরও বেগবান হলো। ৫ তারিখে তাকে তাড়িয়ে দিলো। ছাত্রদের এই শক্তিও একটি রাজনৈতিক শক্তি। ছাত্রদের যখন আন্দোলন তুঙ্গে তারাও আওয়াজ তুললো এই সরকারকে ফেলে দিতে হবে। এই সরকারের পদত্যাগের দাবি ছাত্ররা তুললে এর সঙ্গে জনগণের দীর্ঘদিনের চাওয়া মিলে গেল এবং তারাও এর সঙ্গে যুক্ত হলো।
মাও সেতুং যেমন বলেছিলেন, ‘একটি স্ফুলিঙ্গ দাবানল সৃষ্টি করতে পারে’ ঠিক তেমনি ছাত্রদের আন্দোলন দাবানলের মতো সারা জাতির মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো। একটি বড় পরিবর্তন এখানে হলো কিন্তু মনে রাখতে হবে এই পরিবর্তন কোনো সামাজিক বিপ্লব নয়। এখানকার উৎপাদন সম্পর্ক, বণ্টন সম্পর্ক- এই আন্দোলন পরিবর্তন করে দিয়েছে এমন সমাজ বিপ্লব এটি নয়। সমাজের অবস্থা আগের মতোই রয়ে গেছে। এই বিপ্লবের ফলে যে দলই ক্ষমতায় আসুক তারা সাবধান হয়ে যাবে যে, চাইলেই যা খুশি করা যাবে না। বিএনপি আগে যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তারাও যে সব ঠিক করেছে তা তো নয়। এবার তারা নির্বাচনে ক্ষমতায় এলে তাদেরকেও জনগণের মাইন্ড সেট বুঝতে হবে। বিশেষ করে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে যে পর্যায়ে গেছে আর কেউ ক্ষমতায় এসে তা করতে সাহস পাবে না। এটা এই আন্দোলনের একটি বড় রকমের পরিবর্তন বলে মনে করি।
ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর বাংলাদেশ কোন পথে- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, মিশর বা তিউনিশিয়ায় আরব বসন্তের পর দেখা গেছে সেখানে কিছুদিন পর সেনাবাহিনী ক্ষমতায় এসেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এরকম কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। মিশর দীর্ঘদিন রাজা-রাজড়াদের অধীনে ছিল। তারপর যখন হোসনি মোবারক ক্ষমতায় এসেছে তখন সেনাবাহিনীই ছিল তার শক্তি। তার পতনের পর নির্বাচনে ব্রাদার হুড ক্ষমতায় এলেও খুব বেশি দিন দেশ চালাতে পারেনি, সেখানে সামরিক বাহিনী এত বেশি শক্তিশালী ছিল যে, অল্প কিছুদিন পর ফের সামরিক বাহিনীই ক্ষমতায় আসে। অন্যদিকে মিশরের কোনো গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা নেই।
কিন্তু এই দেশে গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘদিন সংগ্রাম করতে হয়েছে, সংগ্রাম করতে করতে এদেশের জনগণের একটি মাইন্ডসেট তৈরি হয়েছে। এদেশের রুলিং ক্লাসের মধ্যেও একটি মাইন্ডসেট তৈরি হয়েছে- তারাও মনে করে যে- এখানে সামরিক শাসন দিয়ে দেশ চালানো সম্ভব নয়। কাজেই মিশর বা তিউনিশিয়ার সঙ্গে এখানকার পরিস্থিতি মিলবে না। অনেকেই বলে থাকে, এখানকার পরিস্থিতি নাকি আফগানিস্তানের মতো হতে যাচ্ছে। আফগানিস্তানে যেভাবে সকল নারীকে বোরকা পরানো হয়েছে- এদেশে কোনো সরকার এসে তা পারবে? আমি মনে করি, এদেশে কখনোই তা হবে না। এদেশে চাকরিতে নারীদের নিষিদ্ধ করে দেখুক না কোনো সরকার, এটা কখনোই এখানে সম্ভব হবে না। কাজেই এটা যারা বলেন, তারা আসলে পাগলের প্রলাপ বকেন। যারা বলেন, বাংলাদেশ আফগানিস্তান হয়ে যাবে তারা আসলে মূর্খ এবং শয়তান।
ছবি: শাহীন কাওসার