বি শ্লে ষ ণ

কেন আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার এমন পরিণতি

অতিথি প্রতিবেদক | এক্সক্লুসিভ
জানুয়ারী ১৮, ২০২৫
কেন আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার এমন পরিণতি

৫ই আগস্ট ২০২৪। জাতির জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন। তবে দেশের একটি প্রাচীন দলের ক্ষেত্রে এমন দিন আসবে তা কেউই হয়তো আঁচ করতে পারেনি। প্রশ্ন উঠেছে- কেন এমন একটি সময়ের মুখোমুখি হতে হলো এই ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে? কেন একজন পরাক্রমশালী শাসককে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার পাশাপাশি দেশ ছেড়ে যেতে হলো? কেনই বা বারবার ক্ষমতায় আসা দলটিকে বা সে দলের সব নেতাকে একসঙ্গে পালিয়ে যেতে হলো? অথবা কেন সবাই নিজেদের বাঁচানোর জন্য দিগ্বিদিক ছুটলেন- এখনো কমবেশি ঘুরে ফিরছে এমন সব জিজ্ঞাসা।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা এ দিনটি বা এ সময়টি নিয়ে বহু বছর গবেষণা করবেন। এর সুলুক সন্ধান করবেন হয়তো। এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব, নেপথ্যের কারণ হয়তো এখনই পুরোপুরি খোলাসা হবে না। এখন পর্যন্ত আলোচনায় যেসব কারণ উঠে আসছে, তার সূত্র ধরে হয়তো ভবিষ্যৎই সব প্রশ্নের পুঙ্খানুপুঙ্খ জবাব ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করবে। আপাতত, জনমনে উঠে আসা ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ভাবনাগুলো দেখা যেতে পারে।


পর্যবেক্ষকমহল মনে করছেন, অতিরিক্ত দম্ভ, একগুয়েমি, অতিকথন, বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, জনগণের অধিকার রক্ষায় উদাসীনতা, আইনের স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ করা, সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারা, দেশের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া, রাজনৈতিক দলগুলোকে কোণঠাসা করে ফেলা, নিজেদের মতো করে রাজনীতির গতিপথ তৈরির প্রচেষ্টা, অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে বাজে মন্তব্যসহ একাধিক কারণে ক্ষমতা থেকে অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে বিদায় নিতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে।


আওয়ামী লীগ ও সাবেক সরকার প্রধান শেখ হাসিনা এতটাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছিলেন যে, সবকিছুতে আমিত্বকে গুরুত্ব দিতেন। তার সেই সিক্রেটস বুঝতে পেরে দলের নেতারা ও সরকারের মন্ত্রীরা সবকিছুর সঙ্গে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারকে জুড়ে দিতেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের দায়িত্বের মধ্যে যে কাজ পড়ে সেটাতেও কারণে-অকারণে শেখ হাসিনাকে টেনে আনতেন। 
দল ও সরকারে হাইব্রিড বা আগন্তকরা শেখ হাসিনার এই আমিত্বের পূজা করে তাকে খুশি রাখার পাশাপাশি নিজেদের আখের গুছিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও স্বজনদের স্তুতিতে ভাসিয়ে দিয়ে তাদের ক্ষতি করেছেন। বিশেষ করে দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের তোষামোদকারী-সুযোগসন্ধানীদের ‘ইয়েস স্যার’ প্রক্রিয়া শেখ হাসিনাকে সত্য ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ করে দিয়েছে। 


গুঞ্জন আছে, ৫ই আগস্টের ঘটনাবলীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের এই সুযোগসন্ধানীদের সম্পৃক্ততা রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দলটি প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকার পরেও রাজনৈতিকভাবে নিজেদের অবস্থান সংহত করতে পারেনি। শুধুমাত্র আর্থিক লাভালাভের প্রতি নেতাদের অতি লিপ্সার কারণে। এটি করতে গিয়ে ঐতিহাসিক আওয়ামী লীগে একদিকে হাইব্রিডদের লাগামছাড়া ঠাঁই হয়েছে, অন্যদিকে প্রকৃত ত্যাগী ও মূল্যবোধসম্পন্ন নেতারা কোণঠাসা হয়েছেন। 
যুদ্ধাপরাধ ও মৌলবাদী রাজনীতির ধারক অভিযোগে যে জামায়াত-শিবিরকে কোণঠাসা করার পাশাপাশি নির্বাহী আদেশবলে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, সেই গোষ্ঠীর প্রচুর নেতাকর্মীকে আবার আওয়ামী লীগে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।


এক্ষেত্রে দলের বিভিন্ন সারির নেতা ও সরকারের মন্ত্রীরা তাদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়েছিলেন বলে অসংখ্য অভিযোগ শোনা গেছে।
বলাবলি আছে, আওয়ামী লীগের মতো একটি রাজনৈতিক দলের বিনা ভোটে বারবার নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া দলটির সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির বদলে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাসহ তার পারিষদদের এককভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার ইচ্ছা দলকে বিপদে ফেলেছে। অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন করা হলে আওয়ামী লীগ এভাবে সংকটে পড়তো না। নিজেদের মতো করে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করার অব্যাহত প্রবণতা ছিল দলটির জন্য বড় ভুল। এই ভুলের মাত্রা এতটা বিস্তৃত হয়েছিল যে, নির্বাচনে প্রার্থী না পাওয়ায় নিজ দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াতে হয়েছে। 


ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার এই প্রবণতা চালু রাখতে গিয়ে অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ করা সাধারণ জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে।
পর্যবেক্ষকমহলের মতে, বারবার নিজের মতো করে ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা অনেক বেশি দাম্ভিক হয়ে উঠেছিলেন। সে কারণে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোকে নানাভাবে কোণঠাসা করার পাশাপাশি দলগুলোর নেতাদের হেয়প্রতিপন্ন করতেন। 
যেমনটি একাধিকবার শোনা গেছে তার কণ্ঠে। তিনি অসংখ্যবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, আমার  (শেখ হাসিনা) দয়ায় সাজাপ্রাপ্ত হয়েও তিনি বাসায় থাকার সুযোগ পেয়েছেন। অথবা সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ও তার সন্তানদের অব্যাহতভাবে খুনি বলা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে এতিমের টাকা আত্মসাৎকারী বলে বারবার হেয় করা, বিএনপি’র মতো একটি দলকে রাজনীতির মাঠ থেকে বাইরে ছুঁড়ে ফেলার প্রক্রিয়া, জাতীয় পার্টিকে সরকারের ‘বি টিম’ হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য দলটিতে নানা সংকট তৈরি করে দেয়া আওয়ামী লীগকে আখেরে ক্ষতি করেছে।


একটি রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক চরিত্রের মধ্যে না থেকে আমলাতান্ত্রিক ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে পড়াকেও অশুভ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। 
বিশেষ করে অসামরিক-সামরিক আমলাচক্র এবং প্রশাসনিক চক্র শেখ হাসিনাকে বিতর্কিত করেছে বেশি। এই চক্রের ফাঁদে পড়ে শেখ হাসিনা জনগণ ও দলের ত্যাগী নেতাকর্মী-সমর্থকদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন বলে মনে করা হচ্ছে। 


শোনা যায়, শেখ হাসিনা একেকটি নির্বাচন নিয়ে একেক রকম পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে এই চক্রটির উস্কানি ছিল। এদের উস্কানি ও স্তুতিতে শেখ হাসিনা হয়ে পড়েছিলেন বাধাহীন। পরিবেশ-পরিস্থিতি ও বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলেন। কখনো কখনো দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা এসব বিষয়ে দলপ্রধানকে সতর্ক করলেও শেখ হাসিনা সেসব পাত্তা দেননি। নেতাকর্মীদের একচ্ছত্র ও অন্ধ সমর্থনে বছরের পর বছর দলপ্রধানের পদে থাকলেও শেখ হাসিনা এই নেতাকর্মীদের কাছ থেকে কিছুটা দূরবর্তী হয়ে পড়েছিলেন বিগত জাতীয় নির্বাচন ও স্থানীয় সরকারের কয়েকটি নির্বাচনের কারণে। যখন ত্যাগী নেতাকর্মীরা দেখলেন কেন্দ্রীয় নেতাসহ বহুমুখী আমলাচক্র ও প্রশাসননির্ভরতা পেয়ে বসেছে আওয়ামী লীগকে, তখন তাদের অনেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লেন। নেতাদের অপকর্ম এবং অর্থের লোভও ত্যাগীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে।


রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহলের মতে, শেখ হাসিনা দেশের বিভিন্ন সেক্টরে উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরে রাজনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় করার চেষ্টা করেছেন। ফলে আইনের শাসন ও সুশাসন থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। উন্নয়নের পাশাপাশি রাজনৈতিক সুশাসন ও সহাবস্থানের সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করে তিনি নিজেকে বিপদাপন্ন করে তুলেছিলেন। 
প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক শক্তিকে পরাস্ত করার নেশায় পেয়ে বসেছিল তাকে। সে কারণে একইসঙ্গে একাধিক তীর মেরেছিলেন। 
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বিএনপি ও জামায়াতকে একইসঙ্গে ঘায়েল করার চেষ্টা করেছেন। হেফাজতে ইসলাম ও অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে কখনো সন্ধি, কখনো ফন্দি করেছেন। এমনকি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী প্রগতিশীল দলগুলোর সঙ্গেও দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। যা রাজনৈতিক শূন্যতার দ্বার উন্মুক্ত করেছে। আর এই শূন্যতা শেখ হাসিনাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। 


বিশ্লেষকরা বলছেন, সমালোচনা সহ্য করতে না পারার কারণেও আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। শেখ হাসিনার একনায়কসুলভ মনোভাবের কারণে দেশে যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে তাই তার জন্য ভয়ানক বিপজ্জনক হয়ে দেখা দিয়েছিল। সেটা তিনি আঁচ করতে পারেননি, ‘ইয়েস স্যার’ মার্কা নেতা ও তোষামোদকারী আমলা ও প্রশাসনিক ব্যক্তির কারণে। এই তোষামোদের মাত্রা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, অনেক সত্য তথ্যও শেখ হাসিনা পেতেন না বা অর্ধেক সত্য, অর্ধেক মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করা হতো তার কাছে।


সংবাদপত্র বা মিডিয়ার মধ্যে যারা সঠিক তথ্য দেয়ার চেষ্টা করতো বা যারা সরকারের সমালোচনা করে সঠিক পর্যবেক্ষণ তুলে ধরতো তাদেরকে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো।
অনেক গুণী ও প্রভাবশালী সাংবাদিক কোণঠাসা ছিলেন তোষামোদকারী সাংবাদিকদের কারণে। ‘ইয়েস আপা’ মার্কা ওই সাংবাদিকরা সঠিক তথ্য তুলে ধরার বদলে শেখ হাসিনা খুশি হবেন, এমন তথ্য দিতেন। অনেক সাংবাদিককে বিভিন্ন সংস্থা চাপ দিতো, তাদের মতো করে লিখতে। আবার অনেক সাংবাদিককে বিশেষ মহলের চাপে তাৎক্ষণিকভাবে দেশ ছাড়তে হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সংবাদপত্র বা মিডিয়াগুলো আওয়ামী লীগের স্তুতিবাক্যে ভরে উঠতো। ফলে ৫ই আগস্ট পরবর্তী সময়ে মিডিয়ার প্রতি জনরোষও লক্ষ্য করা গেছে। 

এক্সক্লুসিভ'র অন্যান্য খবর