গণমাধ্যমে ব্যাপক পরিবর্তন কে কোথায় গেল?

জনতার চোখ ডেস্ক | সরজমিন
ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৫
গণমাধ্যমে  ব্যাপক পরিবর্তন কে কোথায় গেল?

৩৬ জুলাইয়ের পট পরিবর্তনের পর গণমাধ্যমেও বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। এ পর্যন্ত দুই ডজনেরও বেশি গণমাধ্যমকর্র্মীকে তাদের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। কমপক্ষে আটটি সংবাদপত্রের সম্পাদক এবং ১১টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের বার্তা প্রধানকে বরখাস্ত করা হয়েছে বা ‘পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে’। আবার কেউ কেউ সরকার পরিবর্তনের পরপরই নিজ থেকেই চাকরি থেকে সরে গেছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমের নির্বাহী সম্পাদক, প্রধান বার্তা সম্পাদক এবং বার্তা সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। তাদের পরিবর্তে এসব পদে দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি এবং জামায়াত বিট করা সাংবাদিকদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বর্তমান ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখা গণমাধ্যম মালিকদের প্রতিষ্ঠানে এসব পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। অন্তত ৩০ জন সাংবাদিক চাকরি হারিয়েছেন। অনেকের বিরুদ্ধে হাসিনা সরকারকে উৎখাতে পরিচালিত গণ-অভ্যুত্থানের সময় হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে মামলা চলমান রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টও তদন্ত করছে। টিভি ও রেডিও সাংবাদিকদের সংগঠন ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের জরিপে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে সম্প্রচার সাংবাদিকের চাকরি হারানোর সংখ্যা ১৫০ জনের বেশি। যাদের বেশিরভাগই ৫ই আগস্টের পর চাকরি হারিয়েছেন। সরকারের পতনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া এবং রাজশাহীতে ১২১ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ২৯টি ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ছাড়াও তথ্য মন্ত্রণালয় অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে ১৬৭ জন সাংবাদিকের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করে দিয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়। 


প্রিন্ট মিডিয়ায় দৌড়ঝাঁপ
৫ই আগস্টের পর এ পর্যন্ত আটটি পত্রিকা এবং একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের সম্পাদককে পরিবর্তন করা হয়েছে। বিক্ষোভের সঙ্গে জড়িত একটি হত্যা মামলায় গত সেপ্টেম্বর থেকে কারাগারে রয়েছেন ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গত ২১শে জানুয়ারি পত্রিকাটি বন্ধ করে দিয়েছে মালিক পক্ষ। পাশাপাশি দু’টি পত্রিকায় নতুন নির্বাহী সম্পাদক দেয়া হয়েছে। জানুয়ারির শেষ দিকে পদত্যাগ করেন দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম। যেখানে স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন কবি আব্দুল হাই সিকদার। হঠাৎ করেই দেশ রূপান্তর পত্রিকার সম্পাদক মোস্তফা মামুনের পরিবর্তে সেখানে স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন কামাল উদ্দিন সবুজ। তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি। বদল হয় কালের কণ্ঠের সম্পাদকও। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি কবি হাসান হাফিজ কাজটির সম্পাদনায় আসেন সরকার পতনের পর। সমকাল পত্রিকার আলমগীর হোসেনের পরিবর্তে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব নেন হা-মীম গ্রুপের পরিচালক আবুল কালাম আজাদ। বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক আবু তাহেরকে গত বছরের আগস্টের শেষের দিকে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক করা হয়। এর আগে পত্রিকাটির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন নাঈম নিজাম। 


দৈনিক ভোরের আকাশ পত্রিকায়ও সম্পাদক পরিবর্তন করা হয়েছে। পত্রিকাটির আগের সম্পাদক মনোরঞ্জন ঘোষালের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সহ-সভাপতি ইলিয়াস উদ্দিন খান। প্রতিদিনের বাংলাদেশ পত্রিকার সম্পাদক মুস্তাফিজ শফির জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন মোরসালিন বাবলা। তিনি এর আগে পত্রিকাটির ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দৈনিক সময়ের আলোর সম্পাদক ছিলেন কমলেশ রায়। তার পরিবর্তে বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন পত্রিকাটির জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম। অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলানিউজ২৪.কম-এর সম্পাদক জুয়েল মাজহারের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন লুৎফর রহমান হিমেল। অনলাইন নিউজ পোর্টাল সারাবাংলা.নেট পোর্টালটির প্রধান বার্তা সম্পাদক রহমান মুস্তাফিজকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। সারাবংলার বিশেষ প্রতিবেদক গোলাম সামদানী ভূঁইয়াকে পোর্টালের প্রধান বার্তা সম্পাদক করা হয়েছে।
ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় পরিবর্তন


টেলিভিশন চ্যানেলের ক্ষেত্রে প্রথম বড় পরিবর্তন আসে একাত্তর টিভি’তে। ৮ই আগস্ট চ্যানেলটির কর্তৃপক্ষ তাদের বার্তা প্রধান শাকিল আহমেদ এবং বিশেষ প্রতিবেদক ফারজানা রূপাকে বরখাস্ত করে। আগস্টের শেষ দিকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে একটি হত্যা মামলায় তারা কারাগারে রয়েছেন। বর্তমানে চ্যানেলটির বার্তা প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন বিশেষ প্রতিবেদক শফিক আহমেদ। বৈশাখী টিভি’র বার্তা প্রধান অশোক চৌধুরী এবং প্রধান বার্তা সম্পাদক সাইফুল ইসলামকে তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।


সময় টিভি’তে নেতৃত্বের পরিবর্তন নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। চ্যানেলটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ জোবায়ের আহমেদকে আগস্টে বরখাস্ত করা হয় এবং সিটি গ্রুপের অন্যতম পরিচালক শম্পা রহমানকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়। ডিবিসি নিউজের সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টুকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। পাশাপাশি আরেক সম্পাদক প্রণব সাহা নিজে থেকেই পদত্যাগ করেছেন। ডিবিসি নিউজের সম্পাদক হয়েছেন সমকালের সহযোগী সম্পাদক লোটন একরাম। এটিএন নিউজের বার্তা প্রধান প্রভাষ আমিনকে সরিয়ে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয় ডেপুটি নিউজ প্রধানকে। নিউজ ২৪-এর নির্বাহী সম্পাদক রাহুল রাহার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন চ্যানেলটির কান্ট্রি এডিটর ফরহাদুল ইসলাম ফরিদ। 


এটিএন বাংলার প্রধান নির্বাহী সম্পাদক জেড আই মামুনকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে একই বিভাগের মনিউর রহমানকে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি’র প্রধান বার্তা সম্পাদক আশীষ সৈকতের স্থলে চ্যানেলটির বার্তা সম্পাদকের দায়িত্বে এসেছেন মোস্তফা আকমল। একুশে টিভির বার্তা প্রধান রাশেদ চৌধুরীর স্থলাভিষিক্ত হন হারুন উর রশিদ। তিনি এর আগে ডয়চেভেলে বাংলায় কাজ করেছেন। টেলিভিশনটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পুনরায় দায়িত্বে এসেছেন আবদুস সালাম। এশিয়ান টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক বেলাল হোসেনের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন সিরাজুল ইসলাম। 


আর টিভি’র বার্তা প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন যুগ্ম সম্পাদক ইলিয়াস হোসেন। এর আগে ওই পদে ছিলেন আহসান উদ দৌলা মারুফ। ৫ই আগস্টের পরিবর্তনের পর দেশ টিভি’র বিশেষ প্রতিবেদক মহি উদ্দিন চ্যানেলটির প্রধান প্রতিবেদক হয়েছেন। পরে তাকে বার্তা বিভাগের প্রধান করা হয়। দেশ টিভি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ হাসানকে গত বছরের নভেম্বরে গ্রেপ্তার করা হয়। একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। জিটিভি’র বিশেষ প্রতিবেদক গাউসুল আজম বিপু বর্তমানে টেলিভিশনের বার্তা প্রধান হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। 


টকশোতে নতুন মুখ, সম্মানী বাড়ানোর দাবি 
টেলিভিশনের টকশোতে বেশ কিছু নতুন মুখ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এদের মধ্যে অনেককেই হাসিনা সরকারের সময় যেমন সরব দেখা গেছে তেমন এখনো আছেন। তবে আওয়ামী লীগের ন্যারেটিভ নিয়ে যে সকল অতিথি টকশোতে থাকতেন, তারা ৫ই আগস্টের পর উধাও। বর্তমানে জনপ্রিয় মুখের মধ্যে রয়েছে নিউএজ সম্পাদক নূরুল কবীর, সাংবাদিক মাসুদ কামাল, সোহরাব হাসান, আশরাফ কায়সার, গোলাম মোর্তোজা, নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিটির সদস্য ডা. জাহেদ উর রহমান, সাবেক স্থানীয় সরকার সচিব আবু আলম শহীদ খান, রাজনীতিবিদ রুমিন ফারহানা, জোনায়েদ সাকি প্রমুখ। তবে বর্তমানে টেলিভিশনের নিজস্ব স্টুডিও’র বাইরে রয়েছে ফেসবুক, ইউটিউব। তাই জনপ্রিয় ধারার অতিথিরা দাবি জানিয়েছেন অতিথি সম্মানী বাড়ানোর। এমন দাবি প্রসঙ্গে একজন বলেন, টিভি মালিকরা আমাদের বক্তব্যকে নানাভাবে ব্যবহার করে তাদের আয় বৃদ্ধি করেন অথচ আমাদের সম্মানী বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে উদাসীন আছেন। 

সরজমিন'র অন্যান্য খবর