কলকাতার চিঠি

নির্বাচনই কি বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের গতিপথ ঠিক করবে?

পরিতোষ পাল | এক্সক্লুসিভ
মার্চ ১৫, ২০২৫
নির্বাচনই কি বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের গতিপথ ঠিক করবে?

বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়ার পর থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে প্রবল দোলাচল বিরাজ করছে। হাসিনার ভারতে অবস্থান নিয়ে ভারত সরকার স্পষ্ট করে কিছুই জানাচ্ছে না। বরং ভারতে বসে হাসিনা যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন তাতে নীরব সমর্থন জানাচ্ছেন। অবশ্য ভারতের পক্ষ থেকে এ বিষয়টির সঙ্গে ভারতের অবস্থানের কোনো সম্পর্ক নেই জানিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রক থেকে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা যা বলছেন তা পুরোপুরি ‘ইন্ডিভিজ্যুয়াল ক্যাপাসিটি’তে বা তার ব্যক্তিগত পরিসর থেকে বলছেন। গত সাত মাসে হাসিনা দশটিরও বেশি অডিও বিবৃতি দিয়েছেন। তবে গত এক মাসে বাংলাদেশের সব ইস্যুতেই হাসিনা দ্রুততার সঙ্গে মুখ খুলছেন। এবং তা আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেইজ, ম্যাসেঞ্জার ও ইনস্টাগ্রাম মারফত ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। ভারতে অবস্থান করা আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী, সাংসদ ও মধ্যবর্তী স্তরের নেতারা এই সব ভাষণে উৎসাহিত হয়ে উঠছেন। বাংলাদেশের মধ্যেও কিছু উৎসাহ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।  সমপ্রতি আওয়ামী লীগের যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এক নেতা বলেছেন, হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই দেশে ফিরবেন। শুধু তাই নয়, হাসিনাকে নিরাপদে ভারতে থাকতে দেয়ার জন্য প্রকাশ্যে ভারত সরকারেরও প্রশংসা করেছেন তিনি।  হাসিনা নিজেও সমপ্রতি এক অডিও ভাষণে দেশে ফেরার কথা বলেছেন।  আসলে বাংলাদেশের বর্তমান অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিশৃঙ্খলার দিকে নজর রেখেই আওয়ামী লীগের বিদেশে থাকা বা আত্মগোপনে থাকা নেতাদের মধ্যে তৎপরতা যে অনেকটাই বেড়েছে তা স্বীকার করেছেন কলকাতায় আশ্রয় নেয়া এক আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি জানিয়েছেন, ইতিমধ্যেই আওয়ামী লীগে আইটি টিমকে শক্তিশালী করা হয়েছে। তারাই প্রচারণাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে সক্রিয় রয়েছেন।বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আওয়ামী লীগের সমর্থন ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, সমপ্রতি দুটি জেলায় আইনজীবীদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগপন্থিরাই জয়ী হয়েছেন। রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রবল নির্যাতন সত্ত্বেও এটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেছেন। এসব বুঝতে পেরেই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, দেশের পরিস্থিতিকে আনসেটেল করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। বিবিসি বাংলাকে ইউনূস বলেছেন, একটা পলাতক দল দেশ ছেড়ে চলে গেছে বা তাদের নেতৃত্ব চলে গেছে। তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করছে এটাকে (দেশটাকে) আনসেটেল (অস্থিতিশীল) করার জন্য।


হাসিনাকে ভারতে থাকতে দেয়া নিয়ে ভারতের অবস্থানের কোনো বদল হয়নি বলেই মনে করে সাবেক কূটনীতিকরা।  ঢাকায় ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধু শেখ হাসিনাকে ভারত কিছুতেই কোনো বিপদের মুখে ঠেলে দেবে না। বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, বিদেশের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা যদি কোনো কারণে ভারতে চলে আসেন, তাদের জোর করে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোটা  কখনোই ভারতের নীতি নয়। তিনি আরও বলেছেন, আমরা মনে করি আমাদের এখানে যারা আশ্রয় নিয়ে আসেন, তাদের প্রতি আমাদের একটা ...বলতে পারেন সাংস্কৃতিক ব্যাপার বা একটা নীতিগত ব্যাপারও আছে... যে তাদের আমরা জোরজবরদস্তি করে কোথাও পাঠাবো না। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও এটাই আমার মনে হয়।


এদিকে, হাসিনাকে প্রত্যর্পণের ইস্যুতেও ভারত নীরবতা বজায় রেখেছে। ভারত শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে বাংলাদেশ সরকারের  চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করলেও এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে জানিয়েছে। কলকাতায় এক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এই প্রতিবেদককে বলেন, যে সব মামলায় বিচারের জন্য তাকে ফেরত চাওয়া হচ্ছে সেটা যে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ তা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। তাই এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনুরোধ খারিজ করার বিষয়টি প্রত্যর্পণ চুক্তিতেই রয়েছে এবং সেই যুক্তি প্রয়োগ করেই ভারত এই অনুরোধ নাকচ করে দিতে পারে।
আসলে বাংলাদেশের বর্তমান অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অনৈক্যের মূল্যায়ন করে ভারতও আগের অবস্থানে অনড় রয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে বাংলাদেশে যেভাবে সামপ্রদায়িক শক্তির উত্থান হচ্ছে সে ব্যাপারে ভারত যে সতর্ক নজর রেখে চলেছে সেকথা সমপ্রতি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল স্পষ্ট করেই বলেছেন। মুখপাত্র এই প্রথম সরাসরি বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। গুরুতর অপরাধে আটক ও সাজাপ্রাপ্ত সন্ত্রাসী এবং উগ্রপন্থিদের ছেড়ে দেয়ার ফলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।


বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ইস্যুতে নাক না গলানোর কথা সরকারি উপদেষ্টাদের মুখ থেকে শোনা গেলেও ভারত এখন সংখ্যালঘুদের প্রশ্নে কড়া অবস্থানেই রয়েছে। আর তাই রীতিমতো পরিসংখ্যান দিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রক দাবি করেছে,বাংলাদেশ সরকার প্রতিটি ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত শেষে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকারীদের দ্রুত সাজা দিক। সেই সঙ্গে ভারত মনে করিয়ে দিয়েছে, সংখ্যালঘুদের জীবন, সম্পত্তি ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রক্ষার দায়িত্ব  দেশটির অন্তর্বর্তী সরকারের। সেই দায়িত্ব তারা পালন করুক। 


গত সাত মাসে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের  জটিল ওঠাপড়া রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের নজরে রয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের ঢাকা সফর বা বাংলাদেশের দু’টি প্রতিনিধিদলের ভারত সফর সত্ত্বেও স্বাভাবিকতার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতির প্রত্যাশা ব্যক্ত করা সত্ত্বেও ভারতের দিক থেকে সদর্থক সাড়া দেয়া হয় নি। বরং ভারত ক্রমশ খানিকটা আগ্রাসী অবস্থান নিয়ে চলতে চাইছে। সংখ্যালঘুদের প্রশ্নে যেমন সরব থেকেছে তেমনি সামপ্রদায়িক শক্তির উত্থানকে নজরে রেখেছে বলে মনে করেন সাবেক কূটনীতিকরা। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের যোগাযোগ বৃদ্ধির বিষয়টিও ভারত নিরাপত্তার স্বার্থে নজরে রেখেছে। ভারতের সাবেক কূটনীতিক বীণা সিক্রি সমপ্রতি ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনে প্রকাশিত একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে  মন্তব্য করে বলেছেন, জামায়াত আইএসআই’র বাহক ছিল এবং দলটি (জামায়াত) পাকিস্তানের প্রভাবের মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। সমপ্রতি ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদীও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছেন, আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে।


তবে বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের প্রসঙ্গ ভারত তুলেছে কেন তা নিয়ে নানা রকম ব্যাখ্যা শোনা যাচ্ছে। এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক জানিয়েছেন, ভারত প্রথম থেকেই ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ নীতি নিয়ে চলেছে। তবে এবার ভারতের মতামত জানানোর সময় এসেছে। কেননা, ভারত হাসিনাকে নিয়ে যে ধোঁয়াশা বজায় রেখে চলেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে ভারত সরকার।


আর তাই এবারই প্রথম ভারত স্পষ্ট করে জানিয়েছে যে, তারা স্থিতিশীল, প্রগতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের সমর্থক। ভারতের মতে, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ সরকার সব বিষয়ের নিষ্পত্তি করুক।  

   
অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার বিষয়টির উপরেই ভারত জোর দিতে চেয়েছে। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নির্বাচনের যে কথা বলা হচ্ছে তা যে সঠিক হবে না সেদিকেও ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। সোজাকথায় ভারত গণতান্ত্রিক অবস্থানটিই তুলে ধরতে চেয়েছে। ভারতের সেনাপ্রধান উপেন্দ্র দ্বিবেদীও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে বলেছেন, বাংলাদেশে আগে একটি নির্বাচিত সরকার আসুক, তারপর দেখা যাক সম্পর্ক কোনদিকে যায়। তারপর দেখা যাবে কী করা যায়।
ভারতের সামপ্রতিক মনোভাব থেকে স্পষ্ট, ভারত এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে সম্পর্ক উন্নয়নের কোনো উদ্যোগেই তেমনভাবে শামিল হতে চাইছে না। বরং বাংলাদেশের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে ভারত। সেই নির্বাচনের ফলাফলই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের গতিপথ নির্ধারণ করবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। তখনই স্পষ্ট হবে ভারত প্রতিবেশী দেশের নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে কী ধরনের সম্পর্ক গড়ে তুলতে চান। 

এক্সক্লুসিভ'র অন্যান্য খবর