আন্তর্জাতিক

আদানিকাণ্ডে কার লাভ, কার ক্ষতি?

মোহাম্মদ আবুল হোসেন | আন্তর্জাতিক
নভেম্বর ৩০, ২০২৪
আদানিকাণ্ডে কার লাভ, কার ক্ষতি?

আদানিকাণ্ডে তোলপাড় দুনিয়া। দেশে দেশে তারা ব্যবসার মাধ্যমে অনিয়ম, ঘুষকাণ্ড চালিয়েছে। এক্ষেত্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আশীর্বাদ কাজ করেছে। তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর মোদিকে রাজনৈতিক প্রচারণা চালানোর জন্য একটি করপোরেট জেট বিমান সরবরাহ দিয়েছিলেন আদানি। ফলে প্রথমবার নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোদির কানাডা ও ফ্রান্স সফরের সঙ্গী হয়ে যান তিনি। তবে আদানির সঙ্গে চুক্তি নিয়ে সম্প্রতি দেশে দেশে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। ভারতের কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী দুর্নীতির জন্য আদানিকে গ্রেপ্তার দাবি করেছেন। এ নিয়ে পার্লামেন্টে প্রায়ই উত্তেজনা দেখা দিচ্ছে। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে আদানির চুক্তিতে রয়েছে বড় রকম ফাঁক। বিষয়টি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহির বক্তব্যে স্পষ্ট। তিনি ভারতের সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে বলেন- ‘টকস উইথ আদানি অন দ্য সাপ্লাই আর প্রাইভেট অ্যান্ড ক্যান্ট বি মেড পাবলিক’। এর অর্থ দাঁড়ায় আদানির সঙ্গে (বিদ্যুৎ) সরবরাহ নিয়ে আলোচনা প্রাইভেট এবং তা প্রকাশ করা যাবে না। অর্থাৎ এটি একটি গোপন চুক্তি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে খুশি করার জন্য আদানি পাওয়ারের সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এই চুক্তি করেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বাংলাদেশের পাওয়ার রেগুলেটরের সাবেক মহাপরিচালক বি. ডি. রহমতুল্লাহ আদানির সঙ্গে চুক্তি পর্যালোচনা করেছেন বেশ আগে। তখন তিনি বলেছেন- ‘এমনকি চুক্তি যদিও অনুকূলে নয় বলে মনে হয়, তবুও ভারতকে রাগিয়ে তোলার সক্ষমতা রাখেন না হাসিনা। তিনি জানেন কোনটা মন্দ, আর কোনটা ভালো। কিন্তু তিনি জানেন- যদি আমি আদানিকে খুশি করি, তাহলে মোদিও খুশি হবেন। বাংলাদেশ বর্তমানে ভারতের কোনো অঙ্গরাজ্য নয়। তবে বাংলাদেশ ভারতের অধীনে’।


১৬৩ পৃষ্ঠার গোপন (কনফিডেন্সিয়াল) চুক্তিটি ততক্ষণে তা চলে যায় দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের হাতে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এর ফলে আদানিকে স্বাভাবিক মূল্যের চেয়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য বহুগুণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে। এখানেই শেষ নয় আদানি গ্রুপের বাণিজ্যে জালিয়াতি, অনিয়ম এবং গোপন চুক্তি নিয়ে উত্তাল বিশ্ব। এর মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, কেনিয়া, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কাসহ সহ বিভিন্ন দেশ। নতুন করে এই বিতর্ক শুরু হয় যখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে রিপোর্ট প্রকাশ হয় যে- বিভিন্ন বন্দর ও নবায়নয়যোগ্য জ্বালানির বিস্তৃত সাম্রাজ্যে আছে গৌতম আদানির ১৬,৯০০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল প্রসিকিউটররা অভিযোগ করেছেন সেখানে একটি কাজ পেতে আদানি ভারতীয় কর্মকর্তাদের ২৫ কোটি ডলার ঘুষ দিয়েছেন। এ খবর প্রকাশ হওয়ার পর এ বছর ২১শে নভেম্বর একদিনে ৩৪০০ কোটি ডলার ক্ষতির মুখে পড়ে তারা। ২৭শে নভেম্বর আদানি শিল্পগোষ্ঠী একটি বিবৃতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গৌতম আদানি-সহ তিনজনের বিরুদ্ধে ঘুষ দেয়ার অভিযোগই ওঠেনি বলে দাবি করে। আদানি গ্রিন এনার্জি লিমিটেড ওই বিবৃতিতে স্পষ্ট করে বলেছে- গৌতম আদানি, সাগর আদানি এবং সিনিয়র এক্সিকিউটিভ বিনীত জৈনকে যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন করাপ্ট প্র্যাকটিস অ্যাক্ট লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত করা হয়নি। তারা আরও বলেছে, কোনো বিদেশি দুর্নীতি সংক্রান্ত আইনও লঙ্ঘন করেনি এ সংস্থা। ২০২০ সালে আদানির নেট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৯০০ কোটি ডলার। তা ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বেড়ে দাঁড়ায় ১২,৭০০ কোটি ডলারে। মাত্র দুই বছরে কীভাবে ১১,৮০০ কোটি ডলার বৃদ্ধি ঘটলো তা যেন আলাদিনের চেরাগের কাহিনী। কোনো এক জাদুর পরশে হু হু করে বেড়ে গেছে তার অর্থের মান। এর নেপথ্যে কী! স্বচ্ছ ব্যবসা করে এমন উন্নতি সম্ভব! হয়তো হতে পারে, হয়তো না। কিন্তু সম্প্রতি যেসব অভিযোগ উঠে আসছে, তাতে সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে। 


এ অভিযোগের মধ্যেই আদানির শ্রীলঙ্কা বন্দর প্রকল্পের বিষয়ে মার্কিন সংস্থা ইউএস ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স করপোরেশন গত বছর নভেম্বর জানায়, শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে বন্দর টার্মিনাল প্রকল্পের জন্য ৫৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে তারা। এতে আংশিক মালিকানা আছে আদানি গ্রুপের। নতুন করে ঘুষের অভিযোগ ওঠার পর তারা আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতার বিরুদ্ধে নজরদারি করছে। বাংলাদেশে আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তি পর্যালোচনার জন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়ে ২৬শে নভেম্বর তা প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। এর আগে ১৯শে নভেম্বর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ সংক্রান্ত আদেশ দেন।  আদানি গ্রুপের দুর্নীতি নিয়ে দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার ২৩শে নভেম্বরের রিপোর্টে বলা হয়- উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আদানি গ্রুপের সঙ্গে করা দু’টি চুক্তি বাতিল করেছে কেনিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে গৌতম আদানির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে নিউ ইয়র্কের গ্রান্ড জুরি। অস্ট্রেলিয়ায় আদানির কয়লা খনিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। এ অবস্থায় বিভিন্ন দেশে আদানির চুক্তিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। কয়েকদিন আগে আদানির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রায় ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চুক্তির তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। দ্য হিন্দুর এক খবরে বলা হয়, বাংলাদেশের পতিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আদানি গ্রুপের চুক্তিটি শুরু থেকেই বেশ বিতর্কিত ছিল। কেননা, হাসিনা সরকার স্বাভাবিক নিয়ম মেনে এই চুক্তি করেনি বলে অভিযোগ রয়েছে। বলা হয়েছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে খুশি করতে প্রচলিত নীতির বাইরে গিয়ে এই চুক্তি করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) ২০২২-২৩ অর্থবছরে বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট ৫টি কোম্পানি থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করে বিপিডিবি। এগুলো হলো- এনভিভিএন লিমিটেড, পাওয়ার গ্রিড করপোরেশন অব ইন্ডিয়া, পিটিসি ইন্ডিয়া লিমিটেড, সেম্বকর্প এনার্জি ইন্ডিয়া লিমিটেড এবং আদানি গ্রুপের আদানি পাওয়ার। এর মধ্যে ভারতীয় কোম্পানিগুলোর বিদ্যুতের গড় যে দাম, আদানির বিদ্যুতের দাম তার ৮০.৫৭ শতাংশ বেশি। বিপিডিবি’র প্রতিবেদন বলে, আদানি ছাড়া অন্য কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনতে বাংলাদেশের খরচ পড়ছে ৪.২২ থেকে ৯.৯৫ টাকা। সেখানে আদানি পাওয়ারের প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনতে বাংলাদেশের খরচ হচ্ছে ১৪.০২ টাকা। 


২০২৩ সালের ১০ই মার্চ বিবিসি’র এক খবরে বলা হয়, ‘মার্চ মাসে বাংলাদেশে যে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করছে সেই দাম সম্পর্কে একটি ধারণা দিয়েছে আদানি পাওয়ার। তাদের হিসেবে বর্তমান বাজার দর ও কয়লার মান অনুযায়ী প্রতিটন কয়লার মূল্য হবে ১৩৯ ডলার। এতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জ্বালানি খরচ হবে ৯ দশমিক ৩৯ ইউএস সেন্ট। এর সঙ্গে ক্যাপাসিটি চার্জ ৪ দশমিক ২৪ ইউএস সেন্ট যোগ হবে। এই হিসাব করলে মার্চে আমদানি করলে আদানির প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়বে ১৫ টাকার মতো’। 
অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড রাজ্যের নাগানা ইয়ারবাইন ওয়াঙ্গান অ্যান্ড জাগালিংগু কালচারাল কাস্টোডিয়ানস জানিয়েছে, ব্রাভাস মাইনিং অ্যান্ড রিসোর্সেস ইউনিটের বিরুদ্ধে গুরুতর বর্ণবৈষম্যের অভিযোগ এনে তারা অভিযোগ দায়ের করেছে। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, আদানির কর্মীরা আদানির কারমাইকেল কয়লা খনির কাছে আদিবাসী গোষ্ঠীর সদস্যদের বিভিন্নভাবে বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে। নাগানা ইয়ারবাইনের সিনিয়র কালচারাল কাস্টোডিয়ান আদ্রিয়ান বুরাগুব্বা এক বিবৃতিতে বলেন, আমরা বছরের পর বছর ধরে আদানির কাছ থেকে  বৈষম্য সহ্য করেছি, আর সহ্য করা যাচ্ছে না। 


বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি ছিল ‘কনফিডেন্সিয়াল’
বিশেষ করে এসব ঘটনার কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে আদানি পাওয়ারের সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়ে করা চুক্তি ব্যাপকভাবে নজরে আসে। সাংবাদিক গেরি শিহ, নিহা মাসিহ এবং অনন্ত গুপ্ত ২০২২ সালের ডিসেম্বরে যখন এই চুক্তির নেপথ্যের কারণ সবার আগে ফাঁস করে দেন তখন হৈচৈ পড়ে যায়। ওই তিন সাংবাদিক প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্টে লেখেন, প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের যে প্রচলিত দাম তার চেয়ে কমপক্ষে ৫ গুণ বেশি দামে আদানি পাওয়ারের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে এই চুক্তি করেছে (বাংলাদেশ) সরকার। এতে ওই চুক্তির পেছনের অনেক কারণ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়। এর এক বছর পরে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকে ভারতের বার্তা সংস্থা পিটিআইকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহি চৌধুরী বলেন- ‘টকস উইথ আদানি অন দ্য সাপ্লাই আর প্রাইভেট অ্যান্ড ক্যান্ট বি মেড পাবলিক’। এর অর্থ দাঁড়ায় আদানির সঙ্গে (বিদ্যুৎ) সরবরাহ নিয়ে আলোচনা প্রাইভেট এবং তা প্রকাশ করা যাবে না। অর্থাৎ এটি একটি গোপন চুক্তি। এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি। ব্যাঙ্গালুরে ইন্ডিয়া এনার্জি উইকের সম্মেলনের এক ফাঁকে তিনি এসব কথা বলেন। পিটিআইয়ের ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, আমদানি করা কয়লার মূল্য বেড়ে যাওয়ায় জ্বালানি খরচে ক্ষতিপূরণের বিষয়ে ডিসকাউন্ট দেয়ার জন্য বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) অনুরোধ করে আদানি পাওয়ারকে। ওই প্রস্তাব আদানি বিবেচনা করছে বলে বলা হয়। আদানি পাওয়ারের একটি অঙ্গ সংস্থা দীর্ঘমেয়াদে অর্থাৎ ২৫ বছরের জন্য ১৪৯৬ মেগাওয়াট পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট (পিপিএ) স্বাক্ষর করে ২০১৮ সালে। এই রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার আগে ২০২২ সালের ৯ই ডিসেম্বর ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ‘হাউ পলিটিক্যাল উইল অফেন ফেভারস এ কয়েল বিলিয়নিয়ার অ্যান্ড হিজ ডার্টি ফসিল ফুয়েল’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তার চুম্বকাংশে বলা হয়, ২০১৫ সালের জুনে প্রথমবার ঢাকা সফরে বাংলাদেশে আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তার সফর ছিল দু’দিনের। এই সফর ছিল ফলপ্রসূ। এ সময়ে তিনি ঢাকেশ্বরী মন্দিরে প্রার্থনা করেন, ৪০ বছর ধরে বিবদমান সীমান্ত বিরোধ সমাধান করেন এবং বাংলাদেশে ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ও প্রাইভেট কোম্পানিগুলো থেকে বিদ্যুৎ বিক্রির ৪৫০ কোটি ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর মধ্যে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার কথা আদানির। নরেন্দ্র মোদি তখন নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। রাজনৈতিক প্রচারণার সময় মোদিকে একটি করপোরেট জেট বিমান সরবরাহ করেছিলেন এই আদানি। নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোদির প্রথমবার কানাডা ও ফ্রান্স সফরের সঙ্গীও হন তিনি। মোদির বাংলাদেশ সফরের পর বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিষয়ক কর্তৃপক্ষ ১৭০ কোটি ডলারের বিনিময়ে ১৬০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য যোগাযোগ করে আদানির সঙ্গে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ৬০ মাইল দূরে ভারতের গোড্ডায় নির্মাণ হওয়ার কথা। ওই সময় এ প্রকল্পকে উইন-উইন অর্থাৎ সবার জন্যই সমান লাভজনক হিসেবে দেখা হয়। মোদির জন্য এটা ছিল তার ‘প্রতিবেশী প্রথম’ পররাষ্ট্রনীতি এবং ভারতীয় ব্যবসাকে উৎসাহিত করার একটি বড় সুযোগ। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতি অনুযায়ী- বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহন ও বিতরণে ভারতীয় কোম্পানিগুলোর প্রবেশাধিকার দেয়ার জন্য বাংলাদেশের (সাবেক) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ জানান মোদি। ওদিকে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদায় উন্নীত করতে চাইছিলেন শেখ হাসিনা। সরকার হিসাব করে দেখে যে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান গার্মেন্ট কারখানা এবং ফুলেফেঁপে ওঠা শহরগুলোর জন্য বিদ্যুতের চাহিদা তিনগুণ হবে। 


কিন্তু ওই বিদ্যুৎ কেনা (পিপিএ) নিয়ে ১৬৩ পৃষ্ঠার যে গোপন (কনফিডেন্সিয়াল) চুক্তি হয় তা চলে যায় দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের হাতে। তাদের অনুরোধে ওই চুক্তিটি পর্যালোচনা করেন সংশ্লিষ্ট শিল্প বিষয়ক তিনজন বিশ্লেষক। তারা সুপারিশে বলেন, ২৫ বছর মেয়াদি গোড্ডা চুক্তি খুব কমই বাংলাদেশের অনুকূলে যাবে। তারা বলেন, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু হওয়ার পর তারা বিদ্যুৎ উৎপাদন করুক বা না করুক প্রতি বছর আদানি গ্রুপকে উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণ চার্জ হিসেবে প্রায় ৪৫ কোটি ডলার অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে। সিডনিভিত্তিক জ্বালানি অর্থায়ন বিষয়ক বিশ্লেষক টিম বাকলির মতে, এ শিল্পের মূল্যমানের দিক দিয়ে এই মূল্য অনেক বেশি। সরকারি তথ্যমতে, বাংলাদেশে এখন বর্তমান সর্বোচ্চ চাহিদার চেয়ে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। এরপরেই আসে কয়লার দামের প্রসঙ্গ। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর থেকেই কয়লার দাম তিনগুণ হয়েছে। বিদেশি বিদ্যুৎ সরবরাহকারীদের অন্যান্য চুক্তি- যা ওয়াশিংটন পোস্ট দেখেছে, তাতে এমন ধারা রয়েছে- যাতে বলা হয়েছে কয়লার দাম আকাশচুম্বী হলেও যে দাম হবে, বাংলাদেশকে বেঁধে দেয়া দামে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। তবে গোড্ডা চুক্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে বাজারমূল্য পরিশোধ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলেন, আদানির জাহাজে করে এই কয়লা নেয়া হবে ভারতের পূর্বদিকে আদানির মালিকানাধীন বন্দরে। তারপর সেখান থেকে আদানি-নির্মিত রেলের মাধ্যমে তা নেয়া হবে বিদ্যুৎকেন্দ্রে।  যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে এই কেন্দ্র থেকে, তা আদানি-নির্মিত উচ্চ ভোল্টেজ লাইনের মাধ্যমে সীমান্তের এপাড়ে পাঠানো হবে। চুক্তি অনুযায়ী, কয়লার শিপিং ও পরিবহন খরচ বহন করতে হবে বাংলাদেশকে। টিম বার্কলির মতে, সবাই বলছেন বিদ্যুতের বাজারমূল্যের চেয়ে কমপক্ষে ৫ গুণ বেশি দামে আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে হবে বাংলাদেশকে। কয়লার মূল্য যদি যুদ্ধ-পূর্ববর্তী অবস্থায় নেমে আসে তাহলে বাংলাদেশের ভেতরে কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের যে মূল্য সরকারিভাবে প্রকাশিত হয়েছে তার চেয়ে প্রতি কিলোওয়াট-আওয়ার বিদ্যুৎ শতকরা কমপক্ষে ৩৩ ভাগ বেশি দামে বাংলাদেশকে কিনতে হবে আদানি পাওয়ার থেকে। বাংলাদেশের কাপ্তাইয়ে সৌরচালিত প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত বিদ্যুতের দামের সঙ্গে এই দাম তুলনা করলে আদানির বিদ্যুতের দাম হবে ৫ গুণ বেশি। 
বাংলাদেশে পরিবেশ বিষয়ক কর্মী হাসান মেহেদির মতে একদিনে দেশের শতকরা ৬০ ভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে থাকে। তিনি বলেন, গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে আরও বেশি কয়লানির্ভর করে তুলবে। এর ফলে সৌরশক্তি ব্যবস্থাকে ধাক্কা মারবে। সৌরশক্তির বিদ্যুৎ অনেক বেশি সস্তা। কিন্তু বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সংকটের একটি হটস্পট দরিদ্র মানুষের এই দেশ। এখানে তাদের প্রয়োজন নেই এমন কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে তাদেরকে অপ্রয়োজনে বেশি অর্থ দিতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে ২০২১ সালে ১৮টি কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ১০টিই বাতিল করে দেয় বাংলাদেশ। 

আন্তর্জাতিক'র অন্যান্য খবর