নির্যাতন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণহত্যা, ক্ষুধা, বাস্তুচ্যুত- এমন মর্মান্তিক বিশেষণগুলো যেন এখন শুধু গাজার জন্যই বরাদ্দ। গত ১৮ মাস ধরে নারী-শিশু নির্বিশেষে উপত্যকাটির মানুষের ওপর চলছে বর্বর হত্যাযজ্ঞ। গাজায় যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড চলছে তা একজন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে হজম করা বেশ কঠিন। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন উদ্ধারকর্মী একটি শিশুর নিথর দেহ হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তবে শিশুটির শরীরের সঙ্গে তার মাথা নেই। ভিডিওটি দেখে বোঝা যায় ইসরাইলের ভারী বোমার আঘাতে শিশুটির মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এমন চিত্র দেখে যে কারোরই নিজেকে ধরে রাখা কঠিন। এমন হৃদয়বিদারক চিত্র একটি-দুটি নয়। হাজার হাজার। যা করে চলেছে যুক্তরাষ্ট্রের মদতপুষ্ট ইসরাইল। একটি ভিডিওতে এমনও দেখা গেছে- একটি কিশোরকে পালিয়ে যেতে বলা হয়েছে। সে দৌড় শুরু করা মাত্রই তাকে পেছন থেকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ সেখানে এক অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। যাদের খাদ্য নেই, থাকার জায়গা নেই। আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নেই। এক অমানবিক ও মর্মান্তিক জীবন পার করছেন গাজাবাসী। তারা যেন এক দুঃস্বপ্নের মধ্যে রয়েছে। এ পর্যন্ত কতো মানুষ নিহত হয়েছেন তার সঠিক কোনো হিসাব নেই। প্রতিনিয়তই মৃত মানুষের মিছিল ভারী হচ্ছে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত ৫০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এখানে বলে রাখা ভালো যে, ইসরাইলি বাহিনীর বোমার আঘাতে যেসব ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে তার নিচে যেসব মানুষ চাপা পড়েছে তার কোনো হিসাব নেই। আহতের সংখ্যা লক্ষাধিক। গাজার পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে যেভাবে তুলে ধরা হয় তার চেয়েও বেশ ভয়াবহ। তারা যে শুধু মানুষ মেরে ক্ষান্ত হচ্ছে তেমন নয়, কিছু মানুষকে চিহ্ন হিসেবে জীবিতও বাঁচিয়ে রাখছে। যাদের শরীরে রয়েছে ইসরাইলি হায়েনাদের বর্বরতার দাগ। সম্প্রতি এমন বেশ কয়েকজন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছে বিবিসি। যেখানে ভুক্তভোগীরা তাদের ওপর চালানো অমানবিক নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন। এই নির্যাতনের বর্ণনা এতটাই লোমহর্ষক, যা সকলের পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব।
বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ইসরাইলের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া ফিলিস্তিনিরা জানিয়েছেন, কীভাবে তাদের সেখানে অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে। নির্লজ্জ ইসরাইল বরাবর এসব অভিযোগ অস্বীকার করলেও ভুক্তভোগী ফিলিস্তিনিদের শরীরে থাকা নির্যাতনের চিহ্নই সাক্ষ্য দিচ্ছে নেতানিয়াহুর বাহিনীর বর্বরতা কতোটা নির্মম। ইসরাইলের কারাগারে অমানবিক নির্যাতনের শিকার এক ফিলিস্তিনির নাম মোহাম্মদ আবু তাওয়িলেহ। তার বয়স ৩৬। তিনি বলেছেন, তার শরীরে রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ ছিটিয়ে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এতে তিনি চিৎকার করেছেন, এদিক- সেদিক ছুটাছুটি করেছেন। নির্যাতন থেকে নিস্তার পেতে বারবার আকুতি জানিয়েছেন। তবুও তাকে এতটুকু ছাড় দেয়নি ইসরাইলি হায়েনারা। বিবিসি জানিয়েছে, তারা এমন পাঁচ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছে যাদের হামাস-ইসরাইল সংঘাত শুরুর পর গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাদের সকলের বর্ণনাতেই উঠে এসেছে ইসরাইলের সামরিক কারাগারের লোমহর্ষক বর্ণনা। যা শুনে কারও কারও রক্ত হিম হয়ে যেতে পারে। এবং এদের সকলকেই বেআইনিভাবে আটক করা হয়েছে। নির্যাতিত ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, তাদেরকে হামাসের সদস্য সন্দেহে আটক করা হয় এবং অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন ৭ই অক্টোবরের হামলার সঙ্গে তাদের কোনো সংযোগ নেই। তবুও তাদের ওপর অত্যাচার করে তাদের জীবনকে অনিশ্চয়তার দিকে ঢেলে দিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। সম্প্রতি এক যুদ্ধবিরতির চুক্তির মাধ্যমে ওই বন্দিদের মুক্তি দিয়েছে তেল আবিব।
মুক্তি পাওয়া ওই পাঁচ বন্দির বর্ণনা প্রায় একই রকম। তাদের সকলকেই গাজা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রথমে তাদের সামরিক ব্যারাকে নিয়ে যায় ইসরাইলি সেনারা। পরে সেখান থেকে কারাগারে পাঠানো হয়। ইসরাইলের কারাগারে মুক্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের ওপর চলে অমানবিক নির্যাতন। প্রতিটি পর্যায়েই তাদের নির্যাতন করা হয়েছে। এসব ব্যক্তি ছাড়াও মুক্তি পাওয়া অন্যান্য বন্দিরাও একই বর্ণনা দিয়েছেন। সেখানে না খাইয়ে রেখে চরম নির্যাতন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মুক্তি পাওয়া ফিলিস্তিনিরা। কেউ কেউ বলেছেন, শুধু গাজার অধিবাসী হওয়াই নাকি তাদের বড় অপরাধ। এর জেরে তাদের মেরে মেরে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হতো। অনেকে বলেছেন, এর চেয়ে মৃত্যুও ভালো ছিল। এসব অভিযোগ যাচাই করার জন্য ইসরাইল প্রতিরক্ষা বাহিনীকে (আইডিএফ) চিঠি দিয়েছে বিবিসি, তবে তাতে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। জাতিসংঘসহ বিশ্বের বেশ কিছু মানবাধিকার সংগঠন এর তীব্র নিন্দা ও উদ্বেগ জানিয়েছে। তারা বলেছে, এভাবে কারাগারে আটক করে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সম্পূর্ণ বেআইনি। ভুক্তভোগীদের বর্ণনা ইসরাইলি মানবাধিকার সংগঠন বি’তসেলেম এবং জাতিসংঘের কাছে দেয়া সাক্ষাৎকারের সঙ্গে মিলে যায়। জাতিসংঘ গত জুলাই মাসে ইসরাইলি কারাগার থেকে ফেরত আসা ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নেয় এবং তা প্রকাশ করে দেয়। যেখানে বলা হয়েছে, আটককৃত ফিলিস্তিনিদের উলঙ্গ করে তাদের শরীরে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়েছে। সিগারেট খেয়ে সে আগুন দিয়ে ফিলিস্তিনিদের শরীরে ছ্যাঁকা দেয়া হয়েছে। আর খাবার ও ঘুম কেড়ে নেয়া ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। নারী বন্দিদের ওপর কুকুর লেলিয়ে দেয়া হতো। হিংস্র কুকুরগুলো বন্দিদের ওপর উন্মত্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের শরীরের অংশ ছিঁড়ে ফেলতো, যা দেখে উপহাস করেছে ইসরাইলি সেনারা। জাতিসংঘের এক রিপোর্টে বেশ কিছু ঘটনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যেখানে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, এটি আইডিএফের হুমকি প্রদানের একটি বিশেষ পদ্ধতি। যার নাম স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং সিস্টেম। তবে ইসরাইল এগুলো কখনোই স্বীকার করেনি।
গাজায় আন্তর্জাতিক কোনো মিডিয়ার সাংবাদিককে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না ইসরাইল। তাই এসব সাক্ষাৎকার মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নিয়েছে বিবিসি। কখনো কখনো বিবিসি’র পক্ষে কোনো ফ্রিল্যান্সিং সাংবাদিক এই সাক্ষাৎকার সংগ্রহ করেছে। গ্রেপ্তারের পর থেকেই ওই পাঁচ ফিলিস্তিনির ওপর নির্যাতন শুরু হয় বলে জানিয়েছেন তারা। উলঙ্গ করে তাদের চোখ-হাত বেঁধে তাদের ওপর হামলে পড়েছিল সেনারা। মোহাম্মদ আবু তাওয়িলেহ পেশায় একজন মেকানিক। তিনি বলেছেন, তাকে টানা চারদিন নির্যাতন করা হয়। ২০২৪ সালের মার্চে গ্রেপ্তার হন তিনি। তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর প্রথমে একটি ভবনে ঢুকানো হয়। জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাকে ভয়াবহ মারধর করা হয়। তার শরীরে নির্যাতনের যে চিত্র প্রকাশ করেছে বিবিসি। তা দেখার আগে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। আবু তাওয়িলেহ বলেছেন, একটি পাত্রে রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে সেখানে মাথা ডুবিয়ে দেয় সৈন্যরা। এরপর তাকে এলোপাতাড়ি ঘুষি মারতে শুরু করে। তাকে যেই ধ্বংসস্তূপের বিল্ডিংয়ে ঢুকানো হয় সেখানে তিনি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান। তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। ভুক্তভোগী ওই ফিলিস্তিনি বলেছেন, তারা আমার পিঠে আগুন ধরাতে লাইটার এবং এয়ার ফ্রেশনার ব্যবহার করেছিল। এরপর আমার শরীরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। আমি চিৎকার করতে থাকি। প্রাণ বাঁচাতে এদিক-ওদিক ছুটতে থাকি। আগুন আমার কাঁধ থেকে পা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। আগুনে জ্বলতে থাকা আমার শরীরের ওপর সৈন্যরা তাদের রাইফেল দিয়ে বারবার আঘাত করতে থাকে। তাদের হাতে লাঠি ছিল, যা দিয়ে আমার জ্বলন্ত শরীরে মারতে থাকে। আগুন নিভে যাওয়ার পর ঝলসে যাওয়া শরীরে এসিড ঢেলে দেয়া হয়।
এটা শুধু একজনের বর্ণনা। এমন শত শত ফিলিস্তিনি আছেন যাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চলছে। প্রকৃতপক্ষে গোটা গাজাই এখন কারাগারে পরিণত হয়েছে। যেখানেই মানুষের জটলা সেখানেই বোমা ফেলছে ইসরাইল। বোমার আঘাতে শিশুদের মাথা, হাত-পা শরীর থেকে আলাদা হয়েছে। যে দৃশ্য দেখলে শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। এ ছাড়া গাজার সীমান্তগুলো দখলে রেখেছে নেতানিয়াহুর বাহিনী। যার ফলে উপত্যকাটিতে কোনো খাবারই প্রবেশ করতে পারছে না। নেই বিশুদ্ধ পানি। তীব্র ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় মৃত্যুর সময় গুনছে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি। ইসরাইলের বর্বরতায় সবচেয়ে বেশি নাজুক হয়ে পড়েছে শিশুরা। এমনও হয়েছে, জন্ম নিয়েই বোমার আঘাতে প্রাণ হারাতে হয়েছে বহু শিশুর। আস্ত একটি সভ্যতাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। গাজার অধিকাংশ স্থাপনাই এখন ধ্বংসস্তূপ। যেসব অঞ্চলকে নিরাপদ জোন বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল সাম্প্রতিক সেখানেই হামলা শুরু করেছে ইসরাইলি বাহিনী। কার্যত গাজাবাসীর কোনো আশ্রয়স্থল রাখেনি তারা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারণায় গাজায় শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিলেও, ক্ষমতায় বসার পর তা উল্টে গেছে। তিনি গাজাকে তার রিয়েল স্টেট প্রপার্টির স্বর্গরাজ্য বানানোর অভিলাস প্রকাশ করেছেন। আর গাজাবাসীকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করার কথা জানিয়েছেন। যদিও বেশ কিছু আরব বিশ্ব এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, ট্রাম্পের ওই অভিলাস বাস্তবায়ন হবে না। জীবন থাকতে মাতৃভূমি না ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছে গাজাবাসী। এদিকে ইউরোপের সঙ্গে রিসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কিছুটা বিরোধ দেখা দেয়ায়, তারা হয়তো গাজার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার রাজনীতি শুরু করেছে। যার উদাহরণ হচ্ছে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রনের সাম্প্রতিক বক্তব্য। তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে তার দেশ। যুদ্ধের এতদিন পর এসে এভাবে ফিলিস্তিনের পক্ষে সুর তোলায় সন্দেহ রয়েই যাচ্ছে। যত যাই হোক শেষ পর্যন্ত গাজাবাসীর ভাগ্যে কী আছে তা এখনই বলা কঠিন।