আ ন্ত র্জা তি ক

ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক মৃত্যু!

ব্যারিস্টার সোলায়মান তুষার | আন্তর্জাতিক
ডিসেম্বর ৭, ২০২৪
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক মৃত্যু!

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এখন আলোচিত বিষয় হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) কর্তৃক গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী  বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং তার সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে  প্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি। দ্য হেগে অবস্থিত আইসিসি ২১শে নভেম্বর জানায়, ইসরাইলে ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর হামাসের হামলা এবং এর জের ধরে গাজায় দেশটির গণহত্যামূলক যুদ্ধ শুরুর ঘটনায় নেতানিয়াহু, গ্যালান্ট ও হামাসের নেতা মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। 
২০২৪ সালের ২০শে মে আইসিসি’র প্রধান  কৌঁসুলি করিম খান ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী  বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট ও হামাসের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে  গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেন। আইসিসি’র প্রধান আইনজীবী ঐদিনই একটি বিবৃতি দিয়ে বলেন, গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধের শুরু থেকে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী  বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট উপত্যকাটিতে যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসংগত কারণ তার কাছে রয়েছে। গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে এবছরের ৫ই নভেম্বর পর্যন্ত ৪৩,৩৯১ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরাইল। আইসিসি’র প্রধান আইনজীবী হামাসের জ্যেষ্ঠ  নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার, মোহাম্মদ দেইফ ও ইসমাইল হানিয়াকে গত ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর ইসরাইলিদের বিরুদ্ধে অপরাধ তদারকির জন্য অভিযুক্ত করেছেন। ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর দক্ষিণ ইসরাইলে হামাসের হামলায় ১ হাজার ১৩৯ জন নিহত হন। তারা ২৫০ জনকে আটক করে নিয়ে যায়। হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার ও ইসমাইল হানিয়াকে ইতিমধ্যে হত্যা করেছে ইসরাইল। 
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলের আগ্রাসন চলার মধ্যে এই প্রথম আইসিসি ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বা কোনো ইসরাইলি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করলেন।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর ইসরাইল ও তার পশ্চিমা মিত্ররা বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বর্তমানে আইসিসি সদস্য বা রোম চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী  দেশ ১২৪টি। এরমধ্যে রাশিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র আইসিসি বা রোম চুক্তির স্বাক্ষরকারী দেশ নয়।  ইসরাইলও এতে স্বাক্ষর করেনি।?
গ্রেপ্তারি জারির কারণে ইসরাইলের যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রীকে নানা সংকট মোকাবিলা করতে হবে। তিনি পশ্চিমা মিত্র দেশগুলোতেও সফর করতে পারবেন না কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া।? এমনকি ইউরোপীয় দেশগুলোতে সফরে গেলে তিনি গ্রেপ্তারের সম্মুখীন হবেন। ইসরাইলি মিত্র দেশ যুক্তরাজ্য ইতিমধ্যে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তারের  ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাজ্য আইসিসি’র সদস্য ও রোম চুক্তি মেনে চলার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। 


যুগ যুগ ধরে ইসরাইল যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকলেও এবারই প্রথম আইসিসি ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। রোম চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী সব দেশ আইসিসিকে সহযোগিতা করতে বাধ্য। কারও বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি হলে তিনি আইসিসি’র সদস্য রাষ্ট্রে সফরে গেলে তাকে অবশ্যই গ্রেপ্তার করতে হবে। এর ফলে  নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও বিদেশ সফরের সুযোগ সংকুচিত হয়েছে- এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। 
এদিকে ২০২৩ সালের ১৭ই মার্চ ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধ এবং শিশুদের ইউক্রেন থেকে অবৈধভাবে রাশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আইসিসি। আইসিসি’র গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকায় পুতিন ভারতের নয়াদিল্লিতে ২০২৩ সালের ৯ থেকে ১০ই সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে অংশ নিতে পারেন নি। গ্রেপ্তার এড়াতে ২০২৩ সালের ২২ থেকে ২৪শে আগস্ট দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ব্রিকস সম্মেলনেও অংশ নেন নি পুতিন।
আইসিসি প্রতিষ্ঠার পর কোনো পশ্চিমা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এর আগে কোনো অভিযোগ আনেনি। এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বিচারের এই হাতিয়ারকে কেবল দুর্বল রাষ্ট্রের  নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে।  নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত আইসিসি’র প্রাক-বিচার চেম্বারের বিচারকদের একটি প্যানেল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির বিষয়ে আইসিসি’র প্রধান আইনজীবীর করা আবেদন পর্যালোচনা করে শেষমেশ ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী ও অন্যদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। 


আইসিসি’র গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আন্তর্জাতিক তাৎপর্য রয়েছে। বর্তমানে আইসিসি’র সদস্য রাষ্ট্র ১২৪টি।? অভিযুক্তরা আইসিসি’র কোনো সদস্য রাষ্ট্রে গেলে  গ্রেপ্তার হতে পারেন।
রোম চুক্তির মাধ্যমে ২০০২ সালে আইসিসি গঠিত হয়। এর গঠনতন্ত্রে বলা হয়, প্রতিটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাদের নিজ দেশের আন্তর্জাতিক অপরাধীদের বিচারকাজ পরিচালনা করা। আইসিসি শুধু তখনই হস্তক্ষেপ করে, যখন একটি রাষ্ট্র এমন অপরাধীর বিরুদ্ধে তদন্তে অস্বীকৃতি জানায় বা অসমর্থ হয়।
রোম চুক্তির অনুচ্ছেদ ৪, ১২ ও ২৫ অনুযায়ী আইসিসি শুধু তার সদস্য রাষ্ট্রে রোম চুক্তির অনুচ্ছেদ ৫ অনুযায়ী কোনো অপরাধ হলে অপরাধীর বিচার করতে পারে। এ ছাড়া রোম চুক্তির ১৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ স্পেশাল রেজ্যুলেশন করে আইসিসিকে ক্ষমতা অর্পণ করলে সদস্য রাষ্ট্রের বাইরে হলেও আইসিসি বিচার পরিচালনা করতে পারে।
এটা সত্য যে, ইসরাইল আইসিসি’র সদস্য রাষ্ট্র নয়। কিন্তু অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে সংঘটিত সব অপরাধের বিচারের ব্যাপারে আইসিসিকে ২০১৫ সালে এখতিয়ার দেয়া হয়েছিল। যার ফলে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী  বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট ও অন্যদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি ও বিচারের এখতিয়ার আইসিসি’র রয়েছে। এ ছাড়া ২০১৯ সালে আইসিসি’র আপিল চেম্বার এক রায়ে বলেন, আইসিসি’র সদস্য নয়, এমন  দেশগুলোর জন্যও আইসিসি’র আদেশ প্রযোজ্য। সুদান আইসিসি’র সদস্য না হলেও সুদানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল আইসিসি। ২০১৫ সালে ওমর আল-বশির আফ্রিকান ইউনিয়নের সম্মেলনে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গেলে দক্ষিণ আফ্রিকার একটি আদালত তাকে দক্ষিণ আফ্রিকা ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়। তাকে আইসিসিতে হস্তান্তর করা হবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা চলছিল। পরে তিনি পালিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা ত্যাগ করেন। তবে আইসিসি’র অভিযুক্ত ব্যক্তিকে  গ্রেপ্তারের সক্ষমতা নেই। আইসিসি’র কোনো পুলিশ বা নিরাপত্তা কর্মী নেই। কাউকে গ্রেপ্তারে আইসিসিকে সদস্য রাষ্ট্রের সরকারের সহযোগিতার ওপরই নির্ভর করতে হয়।
বস্তুত ২০০২ সালে আইসিসি গঠনের পর এই আদালত গুটিকয়েক বিচার কার্যক্রম শেষ করতে পেরেছে- সবক’টি গরিব ও দুর্বল রাষ্ট্রের অপরাধীদের। শক্তিশালী রাষ্ট্রের  কোনো অপরাধীর বিচার আইসিসি শুরুই করতে পারেনি। ইসরাইল যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিনে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ চালালেও আইসিসি নীরব ছিল। এবার ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে আইসিসি’র গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির বিষয়টি আন্তর্জাতিক তাৎপর্য রয়েছে নানাভাবে। ইসরাইল ও তার পশ্চিমা মিত্ররা নানা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গ্রেপ্তারি পরোয়ানাকে ‘অসংগত’ ও ‘নজিরবিহীন’ বলে মন্তব্য করেছেন। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আইসিসিকে ইহুদিবিদ্বেষী সংগঠন বলে মন্তব্য করেছেন। আইসিসি’র এই রায়কে তিনি ফ্রেঞ্চ রিপাবলিকের ‘ড্রেফাস ট্রায়াল’ কেলেঙ্কারির সঙ্গে তুলনা করেছেন। 
এদিকে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারের আদেশের বিরুদ্ধে আইসিসিতে আবেদন করেছে ইসরাইল। ইসরাইলের অনুরোধ আপিলের ফলাফল না হওয়া পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা যাতে স্থগিত রাখা হয়। 


আইসিসি’র নিজস্ব পুলিশ বাহিনী না থাকলেও আইসিসি’র গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য অস্বস্তিকর। আইসিসি’র এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক মৃত্যু হয়েছে এটা হলফ করে বলা যায়। তিনি দেশে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোণঠাসা হয়ে পড়বেন- এটা চোখ বন্ধ করে বলা যায়। এক কথায় তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার খতম করে দিয়েছে আইসিসি। 
আইসিসি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পরপরই যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টকে  গ্রেপ্তারের ঘোষণা দিয়েছে যারা ইসরাইলের অন্যতম মিত্র হিসেবে পরিচিত। 
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে আইসিসি’র গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকায় ইসরাইল এখন রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে অনেকটা পিছিয়ে থাকবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা, আইসিসি’র গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি থাকায়  পশ্চিমা দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের মতো ইউরোপের  দেশগুলোতে আইসিসি’র গ্রেপ্তারি পরোয়ানার সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। এসব দেশ ইসরাইলে মোটা অঙ্কের অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্রের  জোগান দিয়ে থাকে। আইসিসি’র গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর  পরোক্ষভাবে চাপ তৈরি হবে। ইসরাইলি  নেতারা গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হলে  যেসব দেশ ইসরাইলকে যেসব অর্থ ও অস্ত্র দিচ্ছে তা ব্যবহার করা হতে পারে অপরাধের কাজ। এসব দেশগুলো ইসরাইলের সঙ্গে করা বাণিজ্য চুক্তিগুলো অবশ্যই পুনর্মূল্যায়ন করতে  বিবেচনা করবে। এখন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী আন্তর্জাতিকভাবে তালিকাভুক্ত  গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আসামি। তাদের গ্রেপ্তারে আইসিসিভুক্ত ১২৪টি দেশের আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। গ্রেপ্তার হলে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। তবে গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত তাদের বিচার শুরু হচ্ছে না।  কেননা, কারও অনুপস্থিতিতে বিচার করার এখতিয়ার আইসিসি’র নেই। 


লেখক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও আন্তর্জাতিক আইনের গবেষক।

আন্তর্জাতিক'র অন্যান্য খবর