ইরানে ইসলামী বিপ্লব হয়েছে ১৯৭৯ সালে। এই বিপ্লবের পেছনে ছিল রেজা শাহের দীর্ঘস্থায়ী স্বৈরশাসন। ইরানের বিপ্লবে বামপন্থি, জাতীয়তাবাদী, মধ্যপন্থি ও ইসলামপন্থিরা সক্রিয় অংশ নেন। কিন্তু শাহের পতনের পর রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলেন আধ্যাত্মিক ইসলামী নেতা ইমাম খোমেনি ও তার অনুসারীরা।
১৯৭৯ সালের ১৬ই জানুয়ারি ৩৮ বছরেরও বেশি সময় ধরে দোর্দণ্ড প্রতাপে শাসন করার পর ইরানের প্রধানমন্ত্রী রেজা শাহ পাহলভি দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। শাহের বিদায়ের ১৪ দিন পর ৭৬ বছর বয়সী ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি দীর্ঘ ১৫ বছর নির্বাসন জীবন কাটিয়ে ইরানে ফিরে আসেন। সেই থেকে ইসলামিক ইরানের যাত্রা শুরু হয়।
মধ্যপন্থি ও বামপন্থি যেসব দল ও নেতাকর্মী শাহবিরোধী আন্দোলনে ছিলেন, তারা নতুন করে নিগ্রহের শিকার হন। বিশেষ করে বামপন্থিদের বিরুদ্ধে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। বাধ্য হয়ে অনেকে দেশ ত্যাগ করেন।
ইরানের রাজনীতিতে খোমেনিপন্থিদের একচেটিয়া প্রাধান্য এখন প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সেখানে গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষশক্তি একেবারে নির্মূল হয়ে যায়নি। বর্তমানে ইরানের রাজনীতি ও ভবিষ্যৎ গতি-প্রকৃতি বুঝতে হলে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্বও বুঝতে হবে।
বাংলাদেশে ২০২৪ সালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়, তাতেও বাম, মধ্য ও ইসলামপন্থিদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতার মঞ্চ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে। বিভিন্ন সংস্কারের লক্ষ্যে কমিশনও গঠন করেছে।
পরবর্তী রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ কাদের হাতে থাকবে, সেটি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা রকম আলোচনা আছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ইস্যুতে সমপ্রতি ভারতের সংবাদমাধ্যমে যেসব অপপ্রচার চলছে, তা থেকেও ইসলামপন্থিরা সুযোগ নিতে চাইছেন।
ইরান বিপ্লবের সঙ্গে বাংলাদেশের সামপ্রতিক গণঅভ্যুত্থানের কোনো সম্পর্ক নেই। তারপরও ইরান বিপ্লবের ইতিনেতি নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা আছে। এতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতিবিধি বিশ্লেষণ করতে সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়।
প্রায় সিকি শতাব্দী পর ইরানের ইসলামী বিপ্লবের স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক বদরুল আলম খান। এর আগে তিনি সোভিয়েত রাশিয়ার বিপ্লব নিয়ে লিখেছেন ‘সোভিয়েত রাশিয়া ভাঙলো কেন’, চীন বিপ্লব নিয়ে ‘মাওসেতুং: চীনের দুঃখ’। ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপকের লেখালেখির একটা অংশ জুড়ে আছে বিপ্লবোত্তর দেশগুলো। গণতন্ত্রের বিশ্বরূপ ও বাংলাদেশের সংঘাতময় রাজনীতি বিশ্লেষিত হয়েছে এসব বইয়ে।
ইরান বিপ্লব সম্পর্কে বদরুল আলম খানের পর্যবেক্ষণ হলো: বিপ্লবের সময় ইরানি সমাজে বিভিন্ন রকম চিন্তার স্রোত প্রবহমান ছিল। বর্তমানে দেশটির রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন ঘটনা পর্যালোচনায় এটা স্পষ্ট যে, সেই রকম চিন্তা এখনো একেবারে প্রভাবহীন হয়ে পড়েনি। তিনি স্বীকার করেছেন, শাহবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেও দেশটির জাতীয়তাবাদী, মধ্যপন্থি ও উদারগণতন্ত্রী শক্তি এমনকি প্রভাবশালী ইরানের কমিউনিস্ট সংগঠন তুতেহ পার্টি চূড়ান্ত পর্যায়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়।’ পিছু হটা বলা ঠিক হবে না। সেখানে বামপন্থি ও জাতীয়তাবাদী শক্তিকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সভা-সেমিনারে ভিন্নমতাবলম্বী ইরানিদের দেখা মেলে যারা ইরান বিপ্লবের পর দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। দেশ ছাড়ার দুঃখ একমাত্র সংখ্যালঘু (জাতিগত ও ধর্মীয়) ও ভিন্নমতাবলম্বীরাই বোঝেন।
কেবল ইরান নয়, বিপ্লবোত্তর অন্যান্য দেশের বিজয়ের ভাগীদারেরা সংঘাতে লিপ্ত হয়েছেন। সোভিয়েত বিপ্লরের অন্যতম নায়ক লিও ট্রটস্কি মেক্সিকোতে নিহত হন ভাড়াটে খুনিদের হাতে, চীনেও মাও সেতুংয়ের মৃত্যুর পর পার্টি অভ্যন্তরীণ বিরোধে জড়িয়ে পড়ে, যাদের মধ্যে ছিল ‘গ্যাং অফ ফোর’। আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট বিপ্লব ধ্বংস করতে বিদেশি শক্তি ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর যেমন দায় ছিল, তেমনি ক্ষমতাসীনদের খেয়োখেয়িও কম দায়ী নয়। তৃতীয় বিশ্বের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর আদর্শগত লড়াই শেষ পর্যন্ত ভ্রাতৃঘাতী সহিংসতায় রূপ নিয়েছে, তার অনেক উদাহরণ আছে।
বদরুল আলম খান মনে করেন, ইরানের বিপ্লবের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য খুব তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে ইসলামী বিপ্লবের আগে ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতা ব্যবহার করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের নজির নেই বললেই চলে। লাতিন আমেরিকায় ‘লিবারেশন থিওলজি’র ভূমিকা সহায়ক, কেন্দ্রীয় নয়। উল্লেখ্য, ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোও ইরানের বিপ্লব নিয়ে উৎসাহ দেখিয়েছিলেন। পশ্চিমা বিশ্বের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে তিনি দেখেছিলেন চলমান ইতিহাসের একটি ছেদ হিসেবে। একে তিনি আখ্যা দিয়েছিলেন ‘প্রথম উত্তর-আধুনিক বিপ্লব’ বলে। পরে নারী, ভিন্নমত নিয়ে সহনশীলতা ইত্যাদি প্রসঙ্গে ইসলামপন্থিদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে তিনি হতাশ হয়েছিলেন।
তবে ইরানের ইসলামী বিপ্লবই কেবল জনপ্রত্যাশার বিপরীতে হাটেনি। পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কৃতিত্ব যার, সেই সোভিয়েত ইউনিয়নও ৭০ বছরের মাথায় ভেঙে গেল।
ইরানে যেমন কঠোর আইনি বাধ্যবাধকতা আছে, আবার তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও জোরদার হচ্ছে। ২০২২ সালে বাধ্যতামূলক হিজাবে ‘গাফিলতি’ করার কারণে মাশা আমিনি নামের এক তরুণী গ্রেপ্তার ও নিহত হওয়ার পর সেখানে বড় ধরনের বিক্ষোভ হয়। ইসলামী বিধিনিষেধ সত্ত্বেও ইরানে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে, দেশটি আধুনিক তথ্য প্রযুক্তিতেও এগিয়ে আছে অনেক মুসলিম দেশের তুলনায়।
অধুনা বিশ্ব রাজনীতিতে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। ইসলামী বিপ্লবের আগে দেশটি ছিল পুরোপুরি আমেরিকার তাঁবেদার। এমনকি একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও দেশটি প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পক্ষ নেয় যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করতে। ইসলামী বিপ্লবের পর ইরান তাঁবেদারি অবস্থান থেকে সরে আসে, যে কারণে তাকে বারবার অর্থনৈতিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়তে হয়। অতি সমপ্রতি গাজায় ইসরাইলি দখলদারির বিরুদ্ধেও ইরান সোচ্চার ছিল এবং ইসরাইলি হামলার জবাবে তারা পাল্টা হামলা চালাতে দ্বিধা করেনি।
বদরুল আলম খান গত বছর ১৯শে ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় ইরানের বিপ্লব নিয়ে একটি নিবন্ধে লিখেছেন,
ইসলামি বিপ্লবের পর দীর্ঘ ৪৪ বছর কেটেছে। কিন্তু এই গণবিপ্লব ইরানের মানুষকে কী দিয়েছে-এই প্রশ্ন নতুন করে দেখা দিয়েছে। বিশেষত গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইরানের নীতি পুলিশের হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাসা আমিনির মৃত্যুর ঘটনায় এই প্রশ্ন সামনে এসেছে। মাসার বিরুদ্ধে পোশাকবিধি না মানার অভিযোগ আনা হয়েছিল, যা ইরানের শরিয়াহ আইনবিরোধী। পুলিশ দাবি করে, মাসা হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তবে ২২ বছরের সুস্থ-সবল মাসা হঠাৎ কীভাবে হৃদ্?রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন, এর সদুত্তর দিতে পারেনি পুলিশ।
মাসা আমিনির মৃত্যুর ঘটনায় বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে তেহরান। পরে এই বিক্ষোভ পুরো ইরানে ছড়ায়। বিক্ষোভের সমর্থনে বিশ্বের বিভিন্ন শহরেও মিছিল হয়। বিক্ষোভ দমাতে কঠোর অবস্থান নেয় ইরান সরকার। মিছিলে-সমাবেশে চালানো হয় দমনপীড়ন ও গুলি। গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যাকটিভিস্ট ইন ইরান (এইচআরএআই) জানায়, ইরানে গত কয়েক মাসের বিক্ষোভে অন্তত ৫২৭ জনের প্রাণ গেছে। আটক হয়েছেন সহস্রাধিক।
ইরানের ইসলামি বিপ্লব বাংলাদেশের জন্য কোনোভাবে প্রাসঙ্গিক? এই প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ, এখানকার ধর্মীয় পক্ষগুলোর লক্ষ্য বাংলাদেশকে ইসলামি রাষ্ট্র করা এবং শরিয়াহ আইন প্রতিষ্ঠা করা। সেই লক্ষ্য পূরণে এখানেও গণবিপ্লবের তাত্ত্বিক ন্যায্যতা প্রমাণের নানা আদর্শিক উদ্যোগ চলমান আছে।
তবে রাষ্ট্রের জাতি-ভিত্তিকতাকে উপেক্ষা করে ধর্মীয় রূপ দেয়ার আয়োজনে ইরানের বিপ্লব-অভিজ্ঞতা কোনো শিক্ষা হতে পারে কিনা, সেটি ভেবে দেখা প্রয়োজন। কেননা, ইসলামি বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে ইরান একটি নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে বলে নানা পর্যায়ে সমালোচনা ও বিতর্ক আছে। সুশাসন ও সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ার ইউটোপিয়ান প্রতিশ্রুতি ব্যর্থ হওয়ার বিষয়ে ইরানের অভিজ্ঞতা আমাদের ক্ষেত্রে কোনো তাৎপর্য বহন করে কিনা, সেটিও ভেবে দেখা জরুরি।
এখন দেখা যাক ইরানের বিপ্লবের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘটনাবলির মিল বা অমিল কতোটা? ইরানে আধ্যাত্মিক নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লব হয়েছে, তাদের উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমের ধনতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপরীতে একটি সমাজব্যবস্থা কায়েম করা। কিন্তু সেটি তারা পুরোপুরি করতে পারেনি। ইরানের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এখনো ধনতান্ত্রিক। ধনী-গরিবের ব্যবধান বেড়েছে।
বাংলাদেশে ছাত্র-জনতা আন্দোলন করেছেন মূলত স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে একটি গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে। দেশের মানুষ যে তিনটি নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি, তার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা প্রতিবাদই বিস্ফোরণে রূপ নেয়। এই আন্দোলনে ডান বাম মধ্যপন্থি সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল, সে কথা আগেই উল্লেখ করেছি। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর ডানদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ছে। ফলে বামেরা অনেকটাই হতাশ। বামদের লক্ষ্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন করা। কিন্তু সরকার এ পর্যন্ত যতগুলো সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, তাতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের কথা নেই।
অন্যদিকে ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক মহলে বামপন্থা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে একধরনের জোরালো প্রচার চলছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক মহলও তাতে উস্কানি দিচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। আওয়ামী লীগ আমলে সরকারবিরোধী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিরোধী বলে ট্যাগ লাগানো হতো, বর্তমানেও কেউ কেউ ধর্মবিরোধী, আন্দোলনবিরোধী ট্যাগ লাগানো হচ্ছে।
বদরুল আলম খান ইরানের বিপ্লবের ইতিনেতি ব্যাখ্যা করেছেন। সেখানকার জীবনধারা ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা তুলে ধরেছেন। বিশ্লেষণ করেছেন গণতান্ত্রিক, বাম ও জাতীয়তাবাদী শক্তির ব্যর্থতাও, যা বাংলাদেশের মধ্য ও বামপন্থিদের অনেক শিক্ষণীয় আছে। লেখককে অভিনন্দন।