“বিএনপি কি কেবল পানি সেচেই যাবে, মাছ ধরবে না?”
ভদ্রলোক বিএনপি’র একজন কড়া সমর্থক। প্রশ্নটি আমাকে করলেন, তারপর গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকলেন আমার মুখের দিকে। আমার পাল্টা প্রশ্ন, “সেটা আমি কী করে বলবো? আমি কি বিএনপি করি? আমি তো বিএনপি’র কেউ না। আপনার নেতাদের জিজ্ঞাসা করুন।”
তিনি চুপসে গেলেন। আমি জানি, বড় নেতাদের না হলেও তার কাছের অনেককেই তিনি এই প্রশ্নটি করেছেন। উত্তর পাননি কোনো। জবাব পাবেন কী করে, ওই নেতারাও কি কেউ জানেন কিছু?
তিনি বললেন, “জানেন আমি নিয়মিত এলাকায় যাই। সব জায়গায় বেপরোয়া চাঁদাবাজি চলছে। চলছে-দখলদারি।”
তাকে বলতে হবে কেন, আমার মতো অনেকেই এখন জানে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই বাস্তবতার কথা। কে করছে এসব অপকর্ম? সাধারণ মানুষের অভিযোগের আঙ্গুল বিএনপি’র দিকে। বলছে-ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই তারা বেপরোয়া হয়ে পড়েছে। ক্ষমতায় গেলে না জানি কী হয়। চাঁদাবাজি আর আধিপত্য নিরঙ্কুশ করতে নিজেদের মধ্যে তারা আবার মারামারিও করছে। কেউ কিছু বলছে না। কোনো একটি বিষয় নিয়ে মিডিয়াতে মাতামাতি হলে দলের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বহিষ্কার করা হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে দল নিজে মামলাও করছে। এমন ঘটনা কিন্তু আগে কখনো হয়নি। ৫ই আগস্ট হাসিনা সরকার পতনের পর, প্রথম ছয় দিনেই বিএনপি’র এমন বহিষ্কারের সংখ্যা ছিল ৬৭ জন! অর্থাৎ একেবারে শুরু থেকেই বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিষয়টি নিয়ে খুব সিরিয়াস ছিল। এর মধ্যে যতদূর জানি বহিষ্কারের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। এর বাইরে এ বিষয়ে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের উচ্চারিত সতর্কতামূলক হুমকি তো রয়েছেই। কিন্তু তারপরও কাজ কেন হচ্ছে না? প্রতিদিনই বিভিন্ন মিডিয়াতে এরকম বেপরোয়া চাঁদাবাজি আর দখল বাণিজ্যের খবর প্রকাশিত হচ্ছে।
এই যে নিয়ন্ত্রণহীন কর্মকাণ্ড, এতে ক্ষতি হচ্ছে কার? সহজ উত্তর-বিএনপি’র। তাহলে বিএনপি কি তার এই ক্ষতির বিষয় বুঝতে পারছে না? আসলে এসব ঘটনা কেবল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। ধরা যাক একটা দখলদারিত্বের ঘটনা, যেখানে প্রতি মাসেই দশ-পনের লাখ টাকা নগদ আয়ের সম্ভাবনা, সেটাকে দল থেকে বহিষ্কারের হুমকি দিয়ে থামানো কঠিন। দুষ্ট লোকগুলো তখন ভাবে, বের করে দিলে দিক, দশ-পনের মাস আয় করে নিই, তারপর হাতে কিছু টাকা জমে গেলে পরে ঠিকই আবার দলে ঢুকে যাবো। এমন চিন্তা নতুন কিছু নয়, আগেও বহুবার এরকম হয়েছে। কোনো বহিষ্কারই যে স্থায়ী কিছু নয়, সেটা এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যেই রয়ে গেছে।
এখানে দুটি প্রশ্ন এসে যায়। প্রথমত, বেপরোয়া এই চাঁদাবাজি-সন্ত্রাস আসলে কীভাবে থামানো সম্ভব? আর দ্বিতীয়ত, এমন চাঁদাবাজি-সন্ত্রাসে শেষ বিচারে লাভবান কে? আসলে দু’টি প্রশ্নের জবাব পরস্পর সম্পর্কিত। প্রথমত, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর না হলে এইসব দুর্বৃত্তদের থামানো যাবে না। তাদেরকে সক্রিয় হতে হবে। যেখানেই অঘটন ঘটবে, সঙ্গে সঙ্গে সেখানে যেতে হবে, সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজদের আটক করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা আসবে এই আটকের পর। গ্রেপ্তারের পর দলগুলো যদি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করা সত্ত্বেও দলের লোকদেরকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে, তখন তাদেরকে দায়ী করা যেতে পারে। তার আগে পর্যন্ত দায়িত্বটা প্রশাসনের।
এখন কথা হচ্ছে-প্রশাসন কেন সক্রিয় হচ্ছে না? এই প্রশ্নে জবাব পেতে যেয়েই বরং তাকানো যেতে পারে-সম্ভাব্য বেনিফিসিয়ারির দিকে। এমন সব অরাজকতা চলতে থাকলে লাভটা কার হয়? সামগ্রিকভাবে লাভ হয় সেই গোষ্ঠীটির, যারা বিরাজনীতিকরণের পক্ষে। যারা বলতে চায়, এদেশের সকল সমস্যার মূলে রয়েছে রাজনীতি, রাজনৈতিক দল, আর রাজনীতিকরা। কাজেই দেশের প্রকৃত উন্নতি করতে চাইলে অরাজনৈতিক একটা সরকার দরকার। এরা ঠিক করে দেবে দেশ কীভাবে চলবে। এরা দেশ পরিচালনার একটা নিয়ম বানাবে, তারপর যদি কখনো রাজনৈতিক সরকার আসে তাদেরকে সেই নিয়মের মধ্যদিয়েই চলতে হবে। যখন আপনি একটা রাজনৈতিক স্বৈরাচারী ব্যবস্থার নিগড় থেকে সদ্যই মুক্ত হবেন, তখন এমন বক্তব্য শুনতে অতটা হয়তো খারাপ লাগবে না। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এমন চিন্তাকে কি সুস্থ বলা যাবে?
এখন কিন্তু আমরা সেরকমই একটা প্রচেষ্টা দেখতে পারছি। সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখন সুকৌশলে একটা ক্যাম্পেইন চালানো হচ্ছে, বলা হচ্ছে-এখনই নির্বাচনের কোনো দরকার নেই। নির্বাচন কমপক্ষে ৫ বছর পিছিয়ে দেয়া হোক। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি-সব দল দেখা শেষ। রাজনৈতিক সরকার দিয়ে কিছু হবে না। রাজনীতির বাইরের কিছু দিয়ে বরং দেখা যেতে পারে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আছে, তারাই থাকুক আরও কিছুদিন। এই ক্যাম্পেইন শেষ পর্যন্ত কতোটুকু কার্যকর হতে পারবে বলা কঠিন। কিন্তু চেষ্টা যে সবদিক থেকেই হচ্ছে, সেটা বলা নির্দ্বিধায়। ওই যে দেশ জুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা, তার পেছনেও যে অন্তর্বর্তী সরকারের আরও পাঁচ বছর টিকে থাকার আকাঙ্ক্ষাটা কাজ করছে না-সেটাও বলা কঠিন।
আসলে একটা ষড়যন্ত্র যেন চলছে। এ ষড়যন্ত্রের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কতোটুকু সচেতন-সে বিষয়টাই কেন যেন অতটা স্পষ্ট নয়। চিন্তার বিষয় এটাই।