আ ন্ত র্জা তি ক

বিপ্লব দেশে দেশে

মোহাম্মদ আবুল হোসেন | আন্তর্জাতিক
ডিসেম্বর ১৪, ২০২৪
বিপ্লব দেশে দেশে

বিপ্লবের আগুনে যখন দেশ পোড়ে, স্বৈরশাসকরা তখন এসি ছেড়ে কম্বলের নিচে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকেন। রাজপথের উত্তাপ তাদের গায়ে লাগে না। যখন সে আগুনে ঘর পোড়ে তখন সব ছেড়ে লজ্জাজনকভাবে পালান। তিউনিশিয়া, মিশর, লিবিয়া, ইয়েমেন, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, সর্বশেষ সিরিয়াতে এমন ঘটনা ঘটেছে। ২৪ বছর দেশ শাসন করেছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। তার আগে তার পিতা হাফিজ আল আসাদ কমপক্ষে তিন দশক দেশ শাসন করেছেন। ২০০০ সালে হাফিজ আল আসাদ মারা যাওয়ার পর ক্ষমতায় আসেন তার ছেলে বাশার আল আসাদ। উচ্চশিক্ষিত বাশারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা ছিল অনেক। মানুষ মনে করেছিল তার পিতা হাফিজ আল আসাদের তুলনায় তিনি উদার হবেন। মানুষ স্বাধীনতা ভোগ করবে। কিন্তু তিউনিশিয়ায় আরব বসন্ত শুরুর ঢেউ সিরিয়াতে যখন লাগে, তখন কঠোর হস্তে দমন করার চেষ্টা করেন বাশার আল আসাদ। তিনি তখন বিদ্রোহীদেরকে আল কায়েদার সন্ত্রাসী হিসেবে অভিহিত করেন। তাদের বিরুদ্ধে তিনি বহুবার রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছেন বলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে অভিযোগ ওঠে। বিদ্রোহীদের সমর্থন দেয় পশ্চিমারা। অন্যদিকে দীর্ঘসময় একা হয়ে পড়েন বাশার আল আসাদ। তবে তাকে গোপনে গোপনে সমর্থন দিয়ে গেছে ইরান, হিজবুল্লাহ ও হামাস। দীর্ঘ সময় বাশার আল আসাদ, তার স্ত্রী আসমা আল আসাদ কোথায় আছেন-তা নিয়ে মেতে ওঠে পশ্চিমা মিডিয়া। হঠাৎ মেঘের ভেতর থেকে রোদের উঁকি দেয়ার মতো উঁকি দিয়ে আবার হারিয়ে যান বাশার আল আসাদ। তাকে সমর্থনে এগিয়ে আসে চীন ও রাশিয়া। ফলে হালে পানি পান। সাম্প্রতিক সময়ে তার সঙ্গে বন্ধত্ব গড়ে ওঠে সৌদি আরবেরও। ফলে একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দেখা মেলে বাশারের। কিন্তু তিনি দেশে সাধারণ মানুষের অনুভূতি, পালস বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। যদি তিনি তাদের চাওয়া-পাওয়ার বিন্দুমাত্র মূল্য দিতেন তাহলে তিউনিশিয়ার বেন আলির মতো তাকে পালাতে হতো না। মনে পড়ে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে তিউনিশিয়ার সেই জ্বলজ্বলে ইতিহাস। সেখানে একজন হকার মুহাম্মদ বৌয়াজিজি পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। আসলে নিজের গায়ে আগুন দিলেও সেই আগুন জ্বলে ওঠে সারা দেশে। ফলে তিউনিশিয়ায় শুরু হয় জেসমিন বিপ্লব। কেউ এটাকে আরব বসন্ত বলে থাকেন। ওই ক্ষোভের মুখে দেশটির স্বৈরশাসক জাইন আল আবিদিন বা বেন আলির ক্ষমতার মসনদ আলগা হয়ে যায়। পরের বছর অর্থাৎ ২০১১ সালের জানুয়ারিতে তিনি ক্ষমতা ছেড়ে পালান। অথচ দেশ শাসন করেছেন ২৩ বছর। এ সময় দীর্ঘ। এ সময়ে একজন শাসক ইচ্ছা করলে জনগণের মধ্যে সেবক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে অমরত্ব লাভ করতে পারেন। কিন্তু স্বৈরাচারদের বৈশিষ্ট্য তা হয় না। তারা ক্ষমতাকে নিজের অর্জিত সম্পত্তি মনে করেন। তারা ভাবেন, তাদের অনুগ্রহে বেঁচে আছে জনগণ। কিন্তু পোড় খাওয়া সেই জনতা যখন জেগে ওঠে তখন পালাতে হয় একনায়কদের। তারা তখন আশ্রয় খোঁজেন পরবাসে। কেউ আশ্রয় দেয়। বেশির ভাগই দেয় না। প্রায় ৩০ বছর ক্ষমতায় থাকা মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের ক্ষমতাও উল্টে যায়। অবসান হয় লিবিয়ায় ৪২ বছর ধরে একনায়কের মতো দেশ চালানো নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির। ওই আরব বসন্ত পুড়িয়ে দেয় মধ্যপ্রাচ্যের আরও কিছু দেশকে। ইয়েমেনে ২২ বছর ধরে গদি আঁকড়ে ছিলেন প্রেসিডেন্ট আলি আব্দুল্লাহ সালেহ। তাকেও ক্ষমতা ছাড়তে হয়। আসলে ইতিহাস থেকে স্বৈরশাসকরা কোনো শিক্ষা গ্রহণ করে না। এই যে সব ঘটনা, এসবই ঘটেছে তাদের এবং আমাদের চোখের সামনে। এসব ইতিহাস পত্রিকার পাতায় সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। টেলিভিশনে ব্রেকিং রিপোর্ট হয়েছে। কিন্তু তারপরও স্বৈরাচারের কণ্ঠে শোনা যায়- জনগণ আমাদের ক্ষমতায় রেখেছে। তাদের ভোটে ক্ষমতায় এসেছি আমরা। এমনি ঘটনায় মাঠপর্যায়ে শতকরা ২ থেকে ৫ ভাগ ভোট ঘুমের মধ্যে শতকরা ৪০ ভাগে পৌঁছে যায়। তার জোরে জনগণের কণ্ঠকে তারা দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে। বন্যা এলে কিছু ধরে বাঁচা যায়। কিন্তু আগ্নেয়গিরির বুকে জমে থাকা লাভা যখন টগবগ করে ফোটে, উদ্‌গীরণ হয়- তখন তা কাউকে ক্ষমা করে না। এর চারপাশে যা আছে, তাকে পুড়িয়ে দেয়। লাভার নিচে চাপা পড়ে অনেক কিছু। যারা আগে টের পান- তারা সেখান থেকে পালিয়ে যান অথবা তাদেরকে উদ্ধার করে কেউ। 
একই তো পরিণতি হয়েছিল আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণির। অথচ তাকে ২০১৪ ক্ষমতায় বসিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ২০২১ সালে তাকেও পালিয়ে যেতে হয়। তিনিও দেশে  স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছিলেন। ফলে তার ওপর বিরক্ত হয়ে ওঠে আফগান জনগণ। তাদের সঙ্গে যোগ হয় তালেবান গোষ্ঠী। সম্মিলিত শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে ২০২১ সালের ১৫ই আগস্ট সস্ত্রীক পালিয়ে ওমানে চলে যান তিনি। শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসের কথা এখানে না বললে ইতিহাসের সঙ্গে অন্যায় করা হয়। জ্বালানি সংকট, খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি, উপার্জন কমে যাওয়া- ইত্যাদি কারণে শ্রীলঙ্কা ঋণখেলাপি হয়ে পড়ে। মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে রাস্তায় নামে। পরিণত হয় গণআন্দোলন। জনতার স্রোতের সামনে দাঁড়ানোর সাহস দেখায়নি সেনাবাহিনী, পুলিশ এমনকি গোটাবাইয়া রাজাপাকসের দলের কোনো নেতাকর্মী। উপায়ান্তর না দেখে ২০২২ সালে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান প্রেসিডেন্ট। পাল্টে যায় শ্রীলঙ্কা। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আসেন রণিল বিক্রমাসিংহে। তার অধীনে দেউলিয়া শ্রীলঙ্কা বিশ্বের কাছে উদাহরণ হয়ে ওঠে। কিন্তু ভারতের কব্জা থেকে তারা ক্রমশ উত্তরণের চেষ্টা করছে। ক্ষমতায় এসেছেন বামপন্থি অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে। তিনি চীনপন্থি। সর্বশেষ বাশার আল আসাদ পালিয়ে দেশ ছাড়লে সিরিয়ায় কুখ্যাত সাদেনিয়া কারাগার বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিদ্রোহী নেতা আহমেদ আল-শারা। তিনি আবু মোহাম্মদ আল জোলানি নামেই বেশি পরিচিত। একই সঙ্গে তিনি সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের সময়কার সব নিরাপত্তা সংস্থাকে বিলুপ্ত করে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অভিযোগ আছে তিনি আল কায়েদার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ফলে তাকে নিয়ে সিরিয়ায় পশ্চিমারা যে স্বস্তিতে থাকবে তেমন নয়। এরই মধ্যে গোলান মালভূমি দখল করে নিয়েছে ইসরাইল। অবশ্য ইসরাইল যা করে পশ্চিমাদের চোখে তা-ই বৈধ। গাজাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে একটি জনপদকে ‘নির্জন দ্বীপে’ পরিণত করে দিলেও তা বৈধ। লেবাননে বেসামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে হাজারো মানুষকে হত্যা করলেও তা পশ্চিমাদের চোখে বৈধ। ইরানে হামলা চালানো তাদের চোখে বৈধ। শুধু তাদের চোখে অবৈধ হলো, সাধারণ ফিলিস্তিনিদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি। সে অন্য প্রসঙ্গ। বাশার আল আসাদকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দিয়ে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছিল রাশিয়া ও চীন। কিন্তু তারা দৃশ্যত তার পাশ থেকে সরে গেছে, যদিও বাশারকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে রাশিয়া। তবে চীন এক্ষেত্রে সতর্ক প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। প্রশ্নটা এখানেই, যদি আপনি নিজের ক্ষমতা- জনগণের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে ক্ষমতাকে সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহার করেন তাহলে পরিণতি এমনই হয়। দেশ থেকে পালিয়ে যেতে হয়। এমন স্বৈরশাসকরা জনগণের মুখোমুখি হতে ভয় পান। তারা নিজের জীবনকে বড় করে দেখেন। তাই পালিয়ে যান। এর মধ্যে কোনো বীরত্ব থাকে না। কোনো বাহাদুরি থাকে না। 


যতবারই বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এড়াতে চাই, এড়াতে পারি না। ঘুরেফিরে চলে আসে। বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৫ই আগস্ট পালিয়ে গিয়ে নয়াদিল্লিতে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি কী অবস্থায় সেখানে অবস্থান করছেন প্রথমে সে বিষয়ে ভারত মুখ বন্ধ করে রাখলেও শোনা যায়- পরে তাকে ট্রাভেল ডকুমেন্ট দেয়া হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়ে দিয়েছে, তারা শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিবেচনা করে। নয়াদিল্লি যাওয়ার পর তার যেসব অডিও কথোপকথন ফাঁস হয়েছে তা নিয়ে বাংলাদেশে চরম অস্বস্তি। আন্তর্জাতিক বহু সংবাদ মাধ্যম পতিত শেখ হাসিনার সরকারকে স্বৈরাচার বলে আখ্যায়িত করেছে। সরকার শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া অডিও সম্পর্কে ভারত সরকারের কাছে জবাব চেয়েছে। ৯ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ সফরে এসে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি জানিয়ে দিয়েছেন- শেখ হাসিনার মন্তব্যকে সমর্থন করে না ভারত। তিনি যেসব ডিভাইস ব্যবহার করে অডিও সংলাপ করেন এর সুযোগ ভারত তাকে দিচ্ছে না। বরং তিনি ব্যক্তিগত প্রযুক্তিভিত্তিক ‘ডিভাইস’ ব্যবহার করে কথাবার্তা বলছেন। বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক চায় ভারত। পতিত সরকার নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের এ মন্তব্য পরিষ্কার। অন্যদিকে বাংলাদেশ বার বার বলেছে, সংখ্যালঘুদের ওপর কথিত নির্যাতনের অভিযোগ অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। বিশেষ করে রিপাবলিক টেলিভিশনে একজন উপস্থাপকের তথ্য বিকৃতি করে সংবাদ পরিবেশন রীতিমতো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোতে বারুদের মতো কাজ করছে। তিনি রিপোর্ট উপস্থাপনের সময় যে অঙ্গভঙ্গি করেন, যেসব তথ্য দেন- তা নিয়ে রীতিমতো ট্রলের শিকার হয়েছেন। সর্বশেষ পাকিস্তান থেকে নিত্যব্যবহার্য পণ্য নিয়ে যখন একটি জাহাজ চট্টগ্রামে নোঙর করে, তখন তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, গ্রাফিক্স ব্যবহার করে দেখান যে- ওই জাহাজে করে বাংলাদেশে বোমা পাঠিয়েছে পাকিস্তান। কিন্তু সেই বোমা কোথায়? তার কাছে এ প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া উচিত ভারতের জনগণের এবং সরকারের। এ ছাড়া ভারত যে বিশ্বে গুজব রটানোর এক নম্বর দেশ- সে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মাধ্যমগুলো। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়- এসব গুজব বন্ধে ভারত সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে? রিপাবলিক টিভির কাছে কি কোনো প্রশাসন জানতে চেয়েছে- ওই জাহাজে বোমার তথ্য ওই সাংবাদিক কোথায় পেয়েছেন? এমন প্রশ্নটি কি কেউ করেছেন? আমার জানামতে কেউ করেননি। কেন এভাবে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে দাঙ্গা লাগানোর পাঁয়তারা? যদি বিশ্লেষণ করেন, তবে দেখবেন এর নেপথ্যে হয়তো বিশেষ একটি গোষ্ঠীকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেয়া, না হয় স্থানীয় ভোটের ময়দানে ফায়দা লোটা। কিন্তু এটা এক স্পর্শকাতর ইস্যু। ভারত উপমহাদেশের মানুষের ভাষায় না হলেও সংস্কৃতিতে অভিন্নতা আছে। তাদের নাড়ির টান বড়। তারা বিভক্ত হতে চায় না। হিন্দু-মুসলিম-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধ-জৈন সহ সব সম্প্রদায় একত্রিত হয়ে বাস করতে চায়। 

আন্তর্জাতিক'র অন্যান্য খবর