কলকাতার চিঠি

কোন কৌশলে হাঁটছেন মমতা

পরিতোষ পাল, কলকাতা | অনুসন্ধান
ডিসেম্বর ২১, ২০২৪
কোন কৌশলে হাঁটছেন মমতা

লড়াকু নেত্রী হিসেবে দেশজোড়া তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামডাক অনেক দিন ধরেই। বামফ্রন্ট সরকারকে আন্দোলনের মাধ্যমে যেভাবে তিনি নাড়া দিয়েছিলেন তা সর্বত্র আলোচিত হয়েছে। যার পরিণতিতে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের নির্বাচনে পরাজয় হয়েছিল। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি ক্ষমতায় এসেছেন। এগারো বছরের বেশি সময় ধরে রাজ্য শাসন করলেও এর আগেই নানা সময়ে তিনি কখনো কংগ্রেস কখনো বিজেপি’র হয়ে কেন্দ্রীয় সরকারে মন্ত্রিত্বও করেছেন। ফলে জাতীয় রাজনীতির রথি-মহারথিদের সঙ্গে তার যোগাযোগ বেশ অনেক দিনের। কংগ্রেসের গান্ধী পরিবারের সঙ্গেও তার সুসম্পর্ক কিছুদিন আগে পর্যন্ত অটুট ছিল। 


তবে তাকে মাঝে মাঝে তারকা হিসেবে জাতীয় রাজনীতির বিরোধী মঞ্চে দেখা গেলেও সরাসরি নেতৃত্ব দেয়ার ইচ্ছার কথা এতদিন জানা যায় নি। আর তাই ২০২৩ সালের জুলাইয়ে সম্মিলিত বিরোধী জোট ইন্ডিয়া ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স (ইন্ডিয়া) গঠনের ক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করলেও সরাসরি নেতৃত্বে তিনি আসেন নি। ‘ইন্ডিয়া’ জোটে কোনো সভাপতি বা আহ্বায়কও নিয়োগ করা হয়নি। মূলত জোটে সমন্বয়ের কাজের পাশাপাশি নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসই সর্বভারতীয় দল হিসেবে। ইন্ডিয়ার অন্য সব শরিকরা সকলে আঞ্চলিক দল হিসেবেই পরিচিত, যাদের সাংগঠনিক ক্ষমতা আঞ্চলিক ভাবেই সীমাবদ্ধ। অবশ্য পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল কংগ্রেস সর্বভারতীয় শব্দটি দলের নামের সঙ্গে যুক্ত করে সর্বভারতীয় পরিচিতি আরোপের চেষ্টা করেছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি রাজ্যে সংগঠন তৈরি করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছে। তবে সাফল্য তেমন দর্শনীয় হয় নি।
এই অবস্থায় হঠাৎ করে জাতীয় বিরোধী জোট ইন্ডিয়ার নেতৃত্ব দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমন গুগলি ছেড়েছেন যে, দিল্লিতে রাজনীতির ভরকেন্দ্রে শোরগোল তৈরি হয়েছে। এর উপর ভিত্তি করে বিরোধী জোটের শরিকদের মধ্যে নতুন ভাষ্য তৈরির চেষ্টা চলছে।   
এনসিপি (এসপি) নেতা শারদ পাওয়ার, আরজেডি নেতা লালুপ্রসাদ যাদব, সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব থেকে শুরু করে শিবসেনার উদ্বব ঠাকরে পর্যন্ত বলতে শুরু করেছেন মমতাই নেতৃত্ব দিন ইন্ডিয়া জোটের। 


তবে জোটের নেতৃত্বের প্রশ্নে মমতা সমপ্রতি এক টিভি সাক্ষাৎকারে কি বলেছেন? খানিকটা ধরি মাছ না ছুঁই পানির ধাঁচে নেতৃত্ব দেয়ার বিষয়টি হাওয়ায় ভাসিয়েছেন তিনি। ইন্ডিয়া জোটের ছন্নছাড়া অবস্থা নিয়ে মমতা বলেছেন, ‘‘আমি তো সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছি না। যারা নেতৃত্বে, তাদের এটা দেখা উচিত।’’ তার সঙ্গে সমস্ত আঞ্চলিক ও জাতীয় দলের যোগাযোগ রয়েছে জানিয়ে মমতা বলেছেন, ‘‘আমি দায়িত্ব পেলে এটুকু বলতে পারি, যদিও আমি তা চাই না...কিন্তু এটুকু আমি মনে করি, এখানে (কলকাতায়) বসেও আমি এটা চালিয়ে দিতে পারি।’’
নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার ও বিজেপি’র বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই করার লক্ষ্য নিয়ে প্রায় দেড় বছর আগে ধুমধাম করে ইন্ডিয়া জোট তৈরি হলেও এর সাফল্য কতোটুকু? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, জোটের শরিকরা এক সুরে সুর মিলিয়ে চলতে পারে নি। আঞ্চলিক রাজনীতির স্বার্থে অনেক শরিক বেসুরো বেজেছেন। আর কংগ্রেসের পক্ষে তা সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না তাদের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার জন্য। তাছাড়া কংগ্রেস সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থই হয়েছে। দলের সভাপতি হিসেবে মল্লিকার্জুন খাড়গেকে মুখ হিসেবে রাখা হলেও এখনো রাশ গান্ধী পরিবারের হাতে। আর তাই রাহুল গান্ধীই প্রকৃত পক্ষে কংগ্রেসের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। জোটেরও অঘোষিত নেতা তিনিই। 


এখানেই বিরোধী জোটে তৈরি হয়েছে বিরোধ। কংগ্রেসের একতরফা সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে চান না আঞ্চলিক দলগুলো। রাজ্যে রাজ্যে নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে বিরোধী জোট শরিকরা তেমনভাবে সমঝোতার ভিত্তিতে লড়তে পারে নি। অখিলেশ যাদব, অরবিন্দ কেজরিওয়ালরা কংগ্রেসকে বেশি রেয়াত করতে চাইছেন না। এমনকি সংসদের বিভিন্ন ইস্যুতে কংগ্রেসের বিজেপি বিরোধিতায় সাড়া দেয়নি অনেক শরিক দল। এরই মধ্যে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার সামপ্রতিক  নির্বাচনে কংগ্রেসের নির্বাচনী ব্যর্থতাই ইন্ডিয়া জোটে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে  মাপকাঠি হিসেবে উঠে এসেছে। জোটের অন্যতম শরিক সমাজবাদী পার্টির নেতারা প্রকাশ্যেই বলছেন, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্রের বিধানসভা ভোটে বিজেপি’র কাছে পরাজিত হয়েছে কংগ্রেস। তারা বিজেপি-কে সামলাতে যে ব্যর্থ তা প্রমাণিত।
অবশ্য কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর ইস্যু নির্বাচন নিয়েও বিরোধীদের প্রশ্ন রয়েছে। আদানি ইস্যুতে মোদির বিরুদ্ধে রাহুল প্রথম থেকেই লড়াই করে চলেছেন। তেমনিভাবে ইভিএম (ইলেকট্রনিক  ভোটিং মেশিন) বিতর্কেও রাহুল সোচ্চার। তবে জোট শরিকরা এগুলোতে সায় দেয়নি। সংসদের ভেতরে-বাইরে কংগ্রেসের প্রতিবাদে সুর মেলায়নি তৃণমূল কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টির মতো দলগুলো। তাদের মতে, সাধারণ মানুষের সমস্যার দিকে লক্ষ্য রেখে ইস্যু নির্বাচন করে বিজেপি’র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামা দরকার। কিন্তু রাহুল গান্ধী তথা কংগ্রেস তাদের তোলা ইস্যুগুলোকেই বিজেপিকে ঘায়েল করার ক্ষেত্রে অন্যতম অস্ত্র বলে মনে করছেন। 


তবে বিজেপি বিরোধী জোটের ছন্নছাড়া অবস্থা এবং কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীকে নিয়ে কটাক্ষ করার সুযোগ হাতছাড়া করেনি। বিজেপি নেতাদের মতে, পরস্পরের সঙ্গে মিশ খায় না, এমন সব দলের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই এটা। কংগ্রেস এবং রাহুল গান্ধী অন্যদের কাছে বোঝা। 
তবে মমতা শেষপর্যন্ত নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্ব নেবেন কিনা কিংবা ইন্ডিয়া জোটের শরিকরা একমত হবেন কিনা সে সব নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ও ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা ওমর আবদুল্লাহ বলেছেন, কংগ্রেসকে জোটের নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। অবশ্য কংগ্রেস মনে করে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তারাই বৃহৎ বিরোধী দল। লোকসভায় ৯৯টি আসনই তাদের দখলে। কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা মমতার প্রস্তাব নিয়ে কিছু না বললেও দলের অন্য নেতারা প্রশ্ন তুলেছেন, তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গের বাইরে শিকড় ছড়াতে চেয়েছিল। যথেষ্ট চেষ্টা করেছে। কিন্তু সফল হয়নি। যিনি পশ্চিমবঙ্গের বাইরে দলকে নিয়ে যেতে পারেননি, তিনি কীভাবে জাতীয় স্তরে লড়বেন? কীভাবে তিনি নেতৃত্ব দেবেন? 
অন্যদিকে, মমতাকে নেতৃত্ব নেয়ার জন্য স্বাগত জানিয়ে বিভিন্ন শরিকরা বলছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস ধারাবাহিকভাবে বিজেপি-কে হারাচ্ছে। বিজেপি-কে হারানোর প্রশ্নে তৃণমূল নেত্রীর ট্র্যাক রেকর্ড অতুলনীয়, তা সে একুশের বিধানসভা হোক বা চব্বিশের লোকসভা অথবা সামপ্রতিক পশ্চিমবঙ্গের ৬টি বিধানসভা উপনির্বাচন।  তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের মতে, মমতার সেই সাহস, দায়বদ্ধতা এবং অভিজ্ঞতা রয়েছে দেশের  ভেতর তৈরি হওয়া সামপ্রদায়িক শক্তি ও ঘৃণার রাজনীতির সঙ্গে লড়াই করার। দীর্ঘ তার রাজনৈতিক জীবন। তিনি ৭ বারের সাংসদ, ৪ বারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, ৩ বারের মুখ্যমন্ত্রী। ফলে তার থেকে যোগ্য ব্যক্তি কে আছেন ইন্ডিয়ার নেতৃত্ব দেয়ার? এনসিপি’র এক সাংসদ বলেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার সফল মডেল তুলে ধরেছেন। তার অভিজ্ঞতা, লড়াইয়ের ইচ্ছা থেকে তিনি আগ্রহ দেখিয়েছেন। ইন্ডিয়া জোটের বৈঠক হলে এ বিষয়ে শীর্ষনেতারা কথা বলবেন। কংগ্রেসের প্রবীণ সাংসদ তারিক আনোয়ারও মনে করেন, ইন্ডিয়া জোটে অনেক দল রয়েছে। কে নেতৃত্ব দেবেন, তা সবাই মিলে ঠিক করা হবে।


রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, কংগ্রেসকে কোণঠাসা করার কৌশল হিসেবেই তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নেতৃত্ব দেয়ার কথাটি হাওয়ায় ভাসিয়েছেন। আর এর মাধ্যমেই সব আঞ্চলিক দলের নেতাদের তিনি জোটবদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস দীর্ঘ সময় ধরে তৃণমূলের সঙ্গী হতে চায় নি। সেই ক্ষোভটা মমতার অনেক দিনের। অন্য দলগুলো নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থেই কংগ্রেসকে দূরে সরিয়ে রেখে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করতে চাইছে। কিন্তু এইভাবে কী কংগ্রেসের মতো জাতীয় দলকে নেতৃত্ব থেকে দূরে রাখা সম্ভব হবে? কংগ্রেস নেতারাই বা তা মেনে নেবেন কেন? অনেকের মতে, ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকে নেতৃত্ব দেয়ার প্রশ্ন নিয়ে ব্যাপক সংঘাতের সম্ভাবনাই তৈরি হবে। 

অনুসন্ধান'র অন্যান্য খবর