বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয়দান প্রসঙ্গে নানা আলোচনা চলছে নানা মহলে। ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট প্রবল গণ-অভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। তবে তিনি তার দলের শীর্ষ নেতাদের বা সহযোদ্ধাদের কাউকে সঙ্গে আনেন নি। এনেছেন একমাত্র তার বোন রেহানাকে। আওয়ামী লীগের বাকি নেতা তথা মন্ত্রী ও সাংসদরা নিজেদের উদ্যোগে বৈধ বা অবৈধ পথে দেশে দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে অধিকাংশই আশ্রয় নিয়েছেন ভারতে। বাংলাদেশে আত্মগোপনেও রয়েছেন অনেকে। তাদেরকে খুঁজে খুঁজে বের করে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
ভারতে হাসিনার আশ্রয় নিয়ে রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে একাডেমিশিয়ানরা নানা অভিমত প্রকাশ করছেন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনাকে প্রত্যর্পণের জন্য নোট ভারবাল পাঠিয়েছে ভারতের কাছে। ভারত গত দুই মাসে তার কোনো উত্তর দেয় নি। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয় নি, শেখ হাসিনা কি মর্যাদায় ভারতে রয়েছেন। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রকের পক্ষে জানানো হয়েছে হাসিনা ভারতে রয়েছেন। তার অনুরোধের ভিত্তিতেই যে দ্রুততার সঙ্গে হাসিনাকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে সেকথাও জানানো হয়েছে।
তবে সমপ্রতি বাংলাদেশে নানা মহলে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, হাসিনা কি দালাই লামার মতো মর্যাদা পেতে পারেন? অবশ্যই এর উত্তরে অধিকাংশই বলছেন, দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে, সেটা হতে পারে না। আসলে দালাই লামা একজন ধর্মগুরু। সেখানে হাসিনা একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তবে দুজনেই মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতেই যে ভারতে এসেছেন এটাই যা মিল।
ভারত ১৯৫৯ সালের এপ্রিলে তিব্বতের ধর্মগুরু দালাই লামাকে পালিয়ে ভারতে আসার পর আশ্রয় দিয়েছিল। দালাই লামার সঙ্গে আসা আরও অনেককে আশ্রয় দেয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ে দালাই লামাকে অনুসরণ করে ভারতে আসা তিব্বতিদেরও আশ্রয় দেয়া হয়েছে। বর্তমানে ভারতে আশ্রয় নেয়া তিব্বতির সংখ্যা ৯৪ হাজার ২০৩ জনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারতের অরুণাচল প্রদেশের তাওয়াংয়ে দালাইলামা ও তার দলবলকে ভারত স্বাগত জানিয়েছিল। আগেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কাছে খবর ছিল যে, কমিউনিস্ট সরকারের প্রবল নির্যাতন ও মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকায় দালাই লামা ভারতে আসছেন। তবে কয়েকদিন পরে ভারতের সংসদে নেহরু জানান যে, দালাই লামা ভারতে প্রবেশ করেছেন। এবং তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়া হয়েছে। তাকে যে সম্মানজনক মর্যাদা দেয়া হবে সেকথাও নেহরু জানিয়েছিলেন। ১৯৫৯ সালের ৩রা এপ্রিল মুসৌরিতে নেহরুর সঙ্গে দালাই লামার বৈঠকে আশ্রয় দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এরপরে অবশ্য দালাই লামাকে প্রবাসী দরকার গঠনের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায় দালাই লামা ও অন্যান্য তিব্বতিদের থাকতে দেয়ারও অনুমতি দেয়া হয়। সেখানেই এখন দালাই লামা বসবাস করেন। সেখানে সরকার পরিচালনা ও সমস্ত রকম সামাজিক উন্নয়নের কাজ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে।
তবে দালাই লামাকে আশ্রয় দেয়ার ব্যাপারে ভারত চীনের সঙ্গে ১৯৫৪ সালে মৈত্রী চুক্তি হিসেবে রূপায়িত ‘পঞ্চশীল নীতি’র তোয়াক্কা না করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এবং এ ব্যাপারে নেহরুই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন।
তবে নেহরু দালাই লামাকে রাজনৈতিক আশ্রয়ের কথা বললেও আসলে আইনগতভাবে তাকে সম্মানিত অতিথি হিসেবে শরণার্থীর মর্যাদা দিয়েই রাখা হয়েছে। অন্যান্য তিব্বতিও রয়েছেন শরণার্থী হিসেবেই। কিছু দিন আগে দালাই লামা নিজেই বলেছিলেন, তিনি ভারতে শরণার্থী হিসেবেই রয়েছেন এবং তাকে সবধরনের স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার দিয়েছে ভারত সরকার। তবে ভারত-চীন সম্পর্কের কথা মাথায় রেখে তিব্বতের স্বাধীনতার দাবি তোলার ব্যাপারে ভারতের তীব্র আপত্তি রয়েছে।
দালাই লামার কাছে শরণার্থী সংক্রান্ত জাতিসংঘের কোনো নথিও নেই। তিনি ভারতের দেয়া বিশেষ (সুই জেনেরিস) ট্রাভেল ডকুমেন্ট নিয়েই দেশে-বিদেশে যাতায়াত করেন। রাষ্ট্র বিজ্ঞানীদের মতে, ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার নির্দিষ্ট কোনো নীতি নেই। অ্যাডহক ভিত্তিতে সরকারি নীতি অনুযায়ী, তিব্বতিদের থাকার সবরকম অধিকার দেয়া হয়েছে। তবে সাধারণ তিব্বতিদের কোনো ট্রাভেল ডকুমেন্ট দেয়া হয় না। একটা আইডেন্টিটিটি সার্টিফিকেট দেয়া হয়, যার মাধ্যমে ভারত থেকে বাইরে যেতে পারেন এবং দেশে প্রবেশ করতে পারেন। সামপ্রতিক সময়ে গত দুই দশকে যে সব তিব্বতি ভারতে এসেছেন তাদের জন্য নানা বিধিনিষেধ রয়েছে। বিক্ষোভ দেখানোর মতো আন্দোলনেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
দালাই লামাকে মানবিক ও বাস্তব উদ্বেগের নিরিখে যেমন আশ্রয় দেয়া হয়েছিল তা কি শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে? এটা ঠিক যে, দালাই লামার মতোই ভারতে আসার পর হাসিনাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে হাসিনার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি কোনো যোগাযোগ বা বৈঠক হয় নি।
আসলে বাংলাদেশে ক্ষমতায় ১৫ বছরে থাকার সময়ে শেখ হাসিনা যে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চালিয়েছেন এবং দলীয় নেতারা যেভাবে ঔদ্ধত্যপূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে লুটপাট চালিয়েছিলেন তাকে অস্বীকার করা যায় না বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ক্ষোভের আগুন যে জ্বলছিল তা ছাত্র আন্দোলনের মধ্যদিয়েই স্ফুলিঙ্গ আকারে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এখনো সেই ক্ষোভের আগুন ছাত্র-জনতার মধ্যে রয়েছে বলেই নানা অশান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। ফলে হাসিনাকে বাংলাদেশে পুনর্বাসিত করা একরকম অসম্ভব বলেই মনে করেন পর্যবেক্ষক মহলের একাংশ। তাছাড়া বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও তার অন্যান্য সংগঠনকে কবরস্থ করার জন্য সক্রিয় চেষ্টা চালাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। অপারেশন ডেভিল হান্টের নামে আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
ভারত অবশ্য ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবেই বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে। তবে তাকে যে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া মানবিক কারণেই উচিত হবে না- সেটা ভারতের বিভিন্ন স্তরের মানুষের অভিমত। ভারত অবশ্য আশ্রয় দেয়ার সময় ভেবেছিল, কিছুদিনের জন্য ট্রানজিটে থেকে হাসিনা অন্য কোনো দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ে চলে যাবেন। কিন্তু সম্ভাব্য সব দেশ মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় হাসিনা ভারতেই দীর্ঘ সময়ের জন্য থেকে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এখানেই ভারতের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। তৈরি হয়েছে কূটনৈতিক জটিলতাও।
তবে হাসিনা ভারতে বসেই রাজনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। একাধিক কর্মী সমাবেশে অডিও ভাষণ দিয়েছেন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের মতে, হাসিনা ভারতের মদতে উস্কানি দিয়ে চলেছেন। আর এজন্য ভারতকে প্রতিবাদপত্র পাঠানো হয়েছে। আবার বাংলাদেশের সামপ্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে ভারতের মন্তব্যকে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে নাক গলানোর অভিযোগ তোলা হয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে ছাত্র-জনতার মধ্যে তীব্র ভারতবিদ্বেষ কাজ করছে। হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন ভারত সরকার অন্য কোনো দলের সঙ্গেই সম্পর্ক বা যোগাযোগ রাখেননি বলে অভিযোগ। ফলে ভারত সরকার অনেকটাই দ্বিধাগ্রস্ত। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের তিক্ততা কাটানোর চেষ্টা করা সত্ত্বেও তা কাটার কোনো লক্ষণ নেই। নানা ইস্যুতে তা জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে।
এই অবস্থায় ভারতের সামনে কোনো পথ খোলা রয়েছে কি? বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু হাসিনাই নন, যে শত শত আওয়ামী লীগ মন্ত্রী, সাংসদ থেকে নানা পর্যায়ের নেতা ও কর্মীরা ভারতে রয়েছেন সেটা তো সকলের জানা।
বিবিসি’র হিসাব অনুযায়ী, প্রথম সারির বা ‘ক্যাটাগরি ১’ নেতাদের মধ্যে অন্তত ২০০ জন পশ্চিমবঙ্গে বাস করছেন। এই শ্রেণির নেতাদের মধ্যে যেমন আছেন দল এবং সাবেক সরকারের শীর্ষ পদাধিকারী এবং মন্ত্রীরা, তেমনই আছেন প্রায় ৭০ জন সংসদ সদস্যও। বাকিদের মধ্যে রয়েছেন, অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার, পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তা, আওয়ামী লীগের অনেক জেলা সভাপতি-সম্পাদকরা, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, মেয়র এবং আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতারাও। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে রয়েছেন উপজেলা স্তরের সভাপতি-সম্পাদক, জুনিয়র এবং কম গুরুত্বপূর্ণ আওয়ামী লীগ নেতাদের সংখ্যাটা প্রায় এক হাজারের কাছাকাছি।
সরকার এখন পর্যন্ত এদের ব্যাপারে চুপ থাকলেও তারা এভাবে দীর্ঘদিন কি ভারতে থাকতে পারবেন? সুনির্দিষ্ট নীতি ছাড়া কোনো সুবিধাই তাদের সরকার দিতে পারবেন না।
তাই দালাই লামার প্রসঙ্গ যখন উঠেছে সেই পদ্ধতি অনুসরণ করে ভারত কি বিশেষ নীতি তৈরি করতে পারে হাসিনাসহ বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসাদের জন্য? শাসক দলের ঘনিষ্ঠ এক বুদ্ধিজীবীর মতে, শরণার্থীর মর্যাদা দিয়ে আপাতত তাদের রাখা যেতে পারে। অবশ্য ভারতের সামনে বিপদও রয়েছে। শেখ হাসিনা এই সুযোগে দালাই লামার ঢঙে প্রবাসী সরকার গঠনের কোনো উদ্যোগ নিলে হিতে বিপরীত হতে বাধ্য। হাসিনা যে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে আসেননি সে কথা আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেনও। হাসিনা-পুত্র জয়ও বলেছেন, তার মা পদত্যাগ করেন নি। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিও বিশিষ্ট সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন যে, শেখ হাসিনার পদত্যাগের কোনো দালিলিক প্রমাণ তার কাছে নেই। ফলে এই অবস্থায় রাজনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়ে কোনো প্রবাসী সরকার গঠনের প্রয়াস হওয়া অসম্ভব নয় বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ।
ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনাকে থামাতে বলেছেন। কিন্তু হাসিনার ব্যক্তিগত অধিকারে ভারত হস্তক্ষেপ করতে চাইছে না। ভারত এ ব্যাপারে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে, শেখ হাসিনা যা বলেছেন- তা তার ব্যক্তিগত এখতিয়ারে বলেছেন। এ ব্যাপারে ভারতের কোনো ভূমিকা নেই।
তবে ভারত শেষ পর্যন্ত কোন পথে হাঁটবে তা স্পষ্ট হতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষক মহল। অনেকের মতে, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া ভারতের সামনে বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই।