ট্রাম্পের সঙ্গে মোদির ফোনালাপে ভূরাজনৈতিক, বাণিজ্যিক বিষয়গুলো নিয়ে বেশি কথা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়তো বোঝাতে চেষ্টা করবে সম্পর্ক ভালো থাকলে দুই দেশের জন্য নিরাপত্তা, ব্যবসার জন্য ইতিবাচক হবে। আমার ধারণা, ভারতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বোঝাতে চেষ্টা করবে বাংলাদেশকে তাদের মতো থাকতে দাও বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক এম হুমায়ুন কবীর। যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশি সাবেক এই রাষ্ট্রদূত সম্প্রতি ‘জনতার চোখ’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সমসাময়িক নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
প্রশ্ন: ট্রাম্প শপথ নিয়েই ইউএসএআইডি’র মাধ্যমে যে সহযোগিতা অব্যাহত ছিল দুনিয়া জুড়ে তা পুনর্মূল্যায়নের ঘোষণা দিয়েছেন। বাংলাদেশে এর কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে?
-প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ত্বরিতগতিতে এক্সিকিউটিভ অর্ডারের মাধ্যমে অনেকগুলো অ্যাকশন নিয়েছেন। তার প্রধান ফোকাস ডমিস্টিক, সামান্য কিছু বাইরের বিষয়ে। বহির্বিশ্বে যে ধরনের সহযোগিতা দেয়া হয় গত বছর তা ছিল ৭২ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বের অনেক দেশ এই সহযোগিতা পেয়ে থাকে, দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সবগুলো দেশ পেয়ে থাকে। আমরা গত বছর প্রায় ৪৪০ মিলিয়ন ডলার সহযোগিতা পেয়েছিলাম। বহু এনজিও এই সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করছিল। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো আগামী তিন মাস সময় নিয়ে তারা এই মার্কিন সহযোগিতাগুলো মূল্যায়ন করবে। এরপর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। বাংলাদেশ পর্যালোচনা পর্যায়ে আছে। আপাতত ৯০ দিন এই সহযোগিতা স্থগিত থাকবে। তবে ব্যতিক্রম হচ্ছে ইসরাইল এবং মিশর। মানবিক সাহায্য হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় যে খাদ্য সাহায্য দেয়া হয় সেটা অব্যাহত থাকবে। সেই হিসেবে রোহিঙ্গাদের জন্য সহযোগিতা আশা করি সেটা অব্যাহত থাকবে। এটা মূলত বিতরণ হয় জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে। আমাদের বাড়তি একটা যে চাপ হওয়ার আশঙ্কা ছিল সেটা থেকে স্বস্তি মিলবে।
আমাদের এখানে রোহিঙ্গাদের সাহায্য দেয়া শুরু হয়েছে ২০১৭ সালে। যখন এসেছে তখন থেকেই। আমরা ৯০০ মিলিয়নের জন্য আবেদন করি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে। সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব থেকে বেশি টাকা দেয়। গত বছর তারা ঘোষণা দিয়েছিল যে, ২২০ মিলিয়ন ডলার সহযোগিতা দেবে। আমরা ৯০০ মিলিয়নের বাজেট করলেও ৫০০/৬০০ মিলিয়ন ডলার পাই। যার বড় একক সাহায্যকারী দেশ ইউএসএ। অন্যান্য খাতের বিষয়ে তিনি বলেন, জ্বালানি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জলবায়ু, গণতন্ত্রসহ সব খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে, হোঁচট খাবে।
প্রশ্ন: ট্রাম্প কি মোদির চোখ দিয়ে বাংলাদেশ দেখবে? বা ওয়াশিংটন কি দিল্লির চোখ দিয়ে ঢাকাকে দেখবে?
-২০০১ সাল থেকে ‘গ্লোবাল অন টেরর’-এর বিরুদ্ধে যে বিশ্বব্যাপী কর্মসূচি তার অংশ হিসেবে আঞ্চলিকভাবে যে দেশগুলো প্রভাবশালী সেই দেশগুলোকে এই কাজে সহযোগী হিসেবে পেয়েছে। সেই কারণে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে বাড়তি দায়িত্ব দিয়েছিল অলিখিতভাবে। ভারত সেই দায়িত্বের অংশ হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এই সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা গড়ে তোলে। তারা অন্যান্য প্রভাবও বিস্তার করে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের প্রধান বিষয় ছিল সন্ত্রাস নিয়ে বিরোধিতা করা। কিন্তু সন্ত্রাস বিরোধিতার নামে বিরোধী দলের উপর চাপ প্রয়োগের জন্য এই অস্ত্রটা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে বিগত সরকার। বাইডেন প্রশাসন যখন ক্ষমতায় আসে তখন তারা এটা থেকে সরে আসে। তারা বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দুর্নীতিবিরোধী কাজে মনোযোগ দেয়। আমার ধারণা তার ফলে ভারত যেরকমভাবে চাইতো বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু তার ভিন্ন চিন্তার কথা বলে আসছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিকাশ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সাধারণ মানুষের মানবাধিকার এসব বিষয়ে তারা সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু এখানে বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে ভারতের একটা টানাপড়েন তৈরি হয়। ২০২৩ সালে নির্বাচনের আগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোরেশোরে এই কথাগুলো বলেছেন। তবে নির্বাচনের কারণে তা অনেকটাই থেমে যায়।
ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নিরাপত্তার বিষয় তুলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এক ধরনের চাপ দিয়েছে যে, ক্ষমতায় যে সরকার আছে তাকে থাকতে দেয়া হোক। সেজন্য মার্কিনিদের সঙ্গে ভারতের স্বাচ্ছন্দ্যের একটা ঘাটতি ছিল। আমার ধারণা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটা শিক্ষা নিয়েছে মালদ্বীপে যে নির্বাচন হলো, নেপালের সঙ্গে যে সম্পর্ক এসব নিয়ে একটা শিক্ষা নিয়েছে। ছোট দেশগুলো ভারতের সঙ্গে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো না। তারই একটা নমুনা জুলাই-আগস্টে যে সরকার পরিবর্তন হলো তখন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়েছে। সমর্থন করেছে। বর্তমানে যে চাপ আছে সেটাও সামাল দেয়ার জন্য চেষ্টা করছে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, ট্রাম্প প্রশাসন ছোট দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়ভাবে স্বাধীনভাবে সম্পর্ক বজায় রাখবে। গণতান্ত্রিক কাঠামো, সাবলীল অর্থনীতি চালু থাকুক সেটা চাইবে। ট্রাম্প প্রশাসনের গুরুত্ব বেশি থাকবে ব্যবসা-বাণিজ্যে। আজকে যদি বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে একটা গণতান্ত্রিক সরকার হয় তাহলে মার্কিন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা করার সুযোগ পাবে। সেই প্রেক্ষিতেও আমি মনে করি যে প্রক্রিয়া আছে সেটাতে সমর্থন থাকবে। এজন্য প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করতে হবে, দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে, মুক্ত পরিবেশ মিডিয়া, নাগরিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
প্রশ্ন: সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কোন্দিকে যাবে? যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে কি ধরনের ভূমিকা নেবে?
-ভারতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বোঝাতে চেষ্টা করবে বাংলাদেশকে তাদের মতো থাকতে দাও। ট্রাম্পের সঙ্গে মোদির ফোনালাপে ভূরাজনৈতিক বিষয়গুলো, বাণিজ্যিক বিষয়গুলো নিয়ে বেশি কথা বলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়তো বোঝাতে চেষ্টা করবে সম্পর্ক ভালো থাকলে দুই দেশের জন্য নিরাপত্তা, ব্যবসার জন্য ইতিবাচক হবে।
প্রশ্ন: জয়শঙ্কর (ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী) ট্রাম্পের শপথে গেলেন। সেখানে মার্কিন ফরেন সেক্রেটারির সঙ্গে বৈঠক করলেন। তারা স্বল্প সময়ে বাংলাদেশের প্রসঙ্গেও কথা বলেছেন।
-কথা হতেই পারে। সেখানে কী আলোচনা হয়েছে সেটা তো আমরা জানি না। এখানে ধারণার বিনিময় অস্বাভাবিক কিছু নয়। ব্যক্তিগত ধারণা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখানে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কীভাবে ভালো করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করতে পারে। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন চাইবে না চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ুক। ভারতের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সম্পর্ক হলে ওই দেশগুলোতে চীনের প্রভাব বিস্তার করার সম্ভাবনা থাকে।
প্রশ্ন: তাহলে আমেরিকায় ট্রাম্পের জয়ের কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে?
-বড় রকমের কোনো পরিবর্তন আসবে মার্কিন নীতিতে আমি তা মনে করি না। প্রথমত, মাঠের বাস্তবতা পরিবর্তন হয়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে এই পরিবর্তন দেখে না এটা ভাবার কারণ নাই। দ্বিতীয়ত বিশ্বের কয়েকটা জায়গায় যুদ্ধ চলছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন চাইবে এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা। তার ফোকাস যে ব্যবসায় তা মোদির সঙ্গে কথাতেই বোঝা গেছে। আমরাও কিন্তু এলএমজি কেনার জন্য বড় একটা কন্ট্রাক্ট সাইন করেছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা কোম্পানির সঙ্গে। এই স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে মার্কিনিরা আরও এনকারেজ করবে বলে আমার মনে হয়।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মধ্যে এক ধরনের টানাপড়েন চলছে। ৫ই আগস্টের পর থেকেই তা দৃশ্যমান, কীভাবে দেখেন? তা ভারতের সেনাপ্রধানের সাম্প্রতিক বক্তব্য লক্ষ্য করে যদি ব্যাখ্যা করেন।
-আমি ভারতের সেনাপ্রধানের সাম্প্রতিক বক্তব্যকে যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ বলে মনে করি না। কারণ এই ধরনের কথার অর্থ এখনকার সরকারের প্রতি এক ধরনের অনাস্থা প্রকাশ করা। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের চেহারাটা তাদের বোঝা দরকার। এটা অভ্যুত্থানের সরকার। নতুন বাস্তবতাটাকে যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবে ততই ভালো। আমাদেরও তো অভ্যন্তরীণভাবে অনেক কাজ আছে; আমাদের জন্য স্বাভাবিক স্থিতিশীল সম্পর্ক থাকা ভালো। যা শুনছি এর বাইরে একটা বাস্তবতা আছে, দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য কিন্তু মোটামুটি চলছে। নীতিগত বা রাজনৈতিক পর্যায়ে সমস্যা। তারা এটা মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু প্রজাতন্ত্র দিবসে ভারতীয় হাইকমিশনার মহোদয় বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক দীর্ঘমেয়াদি হিসেবে দেখেন। নিকট দুই দেশের প্রতিবেশী হিসেবে একে অপরের জাতীয় স্বার্থ, বাস্তবতার আলোকে সম্পর্ক ধরে রাখতে হবে। ভারতের দিক থেকে এই উদ্যোগটা আসা দরকার। আমাদের সর্বোচ্চ মহল থেকে বারবার এটা বলা হচ্ছে এখন ভারতের দিক থেকে আসা উচিত।
প্রশ্ন: কূটনীতিসহ সামগ্রিক বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য কী পরামর্শ থাকবে আপনার?
-এই সরকার তো স্বল্প সময়ের জন্য এসেছেন। তারা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের কাজ হাতে নিয়েছেন। ভারত যদি গণমানুষের প্রত্যাশাটাকে মনে রেখে সামনে আসে তাহলে অন্তর্বর্তী সরকার সাড়া দেবেন বলে মনে করি। সাড়া দেয়াটাই উচিত হবে। জুলাই বিপ্লবে একটা বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে। এটা হয়েছে বড় ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাধ্যমে। গত ১৫ বছরে নানা ধরনের অত্যাচার-অবিচার হয়েছে। যার কারণে রাজনৈতিক কিছু প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তারপর কিন্তু সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু সকলের মধ্যেই একটা রাজনৈতিক সচেতনতা বেড়েছে। আমাদের সচেতন হওয়া উচিত যাতে ভবিষ্যতে এই ধরনের সমস্যা আর তৈরি না হয়। এখন একটা পরিবর্তন দেখছি সংখ্যালঘু যারা তারাও এগিয়ে আসছে।
অনুলিখন: পিয়াস সরকার