নির্মূল এবং নিষিদ্ধের রাজনীতি ভালো ফল বয়ে আনে না তা প্রমাণিত

কাজল ঘোষ | সাক্ষাৎকার
ডিসেম্বর ২৮, ২০২৪
নির্মূল এবং নিষিদ্ধের রাজনীতি ভালো ফল বয়ে আনে না তা প্রমাণিত

ছাত্র জীবনে সক্রিয় ছিলেন রাজপথে। তারপর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। দেশ গড়ার কাজে অংশ নিতে যোগ দেন সরকারি চাকরিতে। গণকর্মচারী হিসেবে প্রজাতন্ত্রের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন টানা ৩০ বছর। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে অবসরে যান। দেশের গুরুত্বপূর্ণ পট পরিবর্তনের সরব সাক্ষী আবু আলম শহীদ খান হালে টকশোর আলোচিত মুখ। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের চার মাসের মূল্যায়নে জনতার চোখ মুখোমুখি হয়েছিল এই আমলার, যিনি নিজেকে একজন গণকর্মচারী হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। সাক্ষাৎকারে উঠে আসে সরকারের নির্বাচনী রোডম্যাপের কথা, বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার নেপথ্যের কথা, আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশ নেয়া না নেয়া নিয়ে বিতর্কসহ চলমান নানা ইস্যু। বিস্তারিত  জনতার চোখ-এর পাঠকের জন্য। 
 

প্রশ্ন: দীর্ঘদিন প্রশাসনে ছিলেন, কেমন দেখছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসন? 
উত্তর: গণকর্মচারী হিসেবে ৩০ বছর কাজ করেছি। বাংলাদেশে আমরা যে সিভিল সার্ভিসের কাঠামো ও কাজ দেখি বিশেষ করে প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেই কাঠামোটা বৃটিশ ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। ভারত ভাগের পরে নেহেরুর মন্ত্রিসভায় তাদের সিভিল সার্ভিসের কাঠামো কেমন হবে তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল তখন মন্ত্রিসভায় কয়েকজন সদস্য এমনকি নেহেরু নিজেও বৃটিশ সিভিল সার্ভিসের কাঠামোটি ভারতীয় মডেলে রূপান্তরের প্রস্তাব করেন। যারা কংগ্রেসের রাজনৈতিক লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। তখন বল্লভ ভাই প্যাটেল ভারতের জন্য যুক্তরাজ্যের ‘স্টিল ফ্রেম’ আমলাতন্ত্র রাখা এবং গড়ে তোলার পরামর্শ দেন। কারণ গণতন্ত্র এবং আমলাতন্ত্র পরস্পরের পরিপূরক। দল নিরপেক্ষ সৎ, দক্ষ, মেধাবী কর্মচারীরা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, শুরু থেকেই এই ‘স্টিল ফ্রেম’ আমলাতন্ত্রকে দুর্বল করে দেয়া হয়। দীর্ঘ সামরিক শাসন, শক্তিশালী বেসামরিক প্রশাসন গড়ে উঠতে দেয়নি এবং আমরা মুক্তিযুদ্ধের পরে সেই বেসামরিক প্রশাসনটি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। আমাদের বিজয়ের পরে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিরপেক্ষ মেধাবী দক্ষ গণকর্মচারী তৈরির ব্যাপারে তেমন মনোযোগী হননি। বিগত ৫৪ বছরের সামরিক, আধা-সামরিক, সামরিক বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার, ভোটের সরকার, বিনা ভোটের সরকার, গণতান্ত্রিক সরকার গণকর্মচারীদের শক্তিশালী কাঠামো গড়ে তুলতে মোটেই আগ্রহী ছিল না। বরং সরকারগুলো গণকর্মচারীদের দলীয় আজ্ঞাবহ ভৃত্যে পরিণত করার চেষ্টা করেছে এবং গণকর্মচারীদের কেউ কেউ পদ, পদবি এবং পদোন্নতির লোভে নিজেদের দলীয় কর্মী ও নেতার পর্যায়ে নামিয়ে ফেলেছিলেন। গত পনের বছরের পরিস্থিতি এক কথায় ভয়ঙ্কর ছিল। ৫ই আগস্টের পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকার সেই প্রশাসন পুলিশ বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পেয়েছেন। তাই তারা সংস্কারের লক্ষ্যে কমিটি বানিয়েছেন। সংস্কার কমিটি কাজ করছে; কিন্তু আমরা জানি না তারা কতোটুকু কাজ শেষ করেছে। জনপ্রত্যাশা হচ্ছে সংস্কারের মধ্যদিয়ে আমরা এমন একটি কাঠামো পাবো যা জনকল্যাণ, জনস্বার্থ এবং রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় ব্রতী হবে। গত ৪ মাসে অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কিছু রদবদল করেছেন। আমলা, পুলিশ কর্মচারীদের সক্রিয় করার চেষ্টা করেছেন। তবে এখনো প্রশাসনে অনেক দুর্বলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী প্রশাসন জনগণের নিরাপত্তা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নতি এবং অন্যান্য নিয়মিত রাষ্ট্রীয় কাজ পুরোপুরি করতে পারছেন না এমন একটা ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো- অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসনিক দুর্বলতা সুস্পষ্ট।  
 

প্রশ্ন: সংস্কার নিয়ে নানা বিতর্ক। এরমধ্যেই প্রাথমিক প্রস্তাবনা দেয়ার কথা। আপনি কীভাবে দেখছেন?
উত্তর: সংস্কার নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ১০টি কমিশন গঠন করেছে। তাদের কাজ-কর্ম সম্পর্কে জনগণ খুব বেশি অবগত নন। কোনো কোনো কমিশন ওয়েবসাইটে মতামত চেয়ে প্রশ্নপত্র প্রকাশ করেছেন। কমিশন অংশীজনদের আলোচনায় বসেছে বা আলোচনা করেছেন এমন খবর আমরা জানি না। সংবিধান সংস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ কমিশন গঠনের আগেই চেয়ারম্যান বদল করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো কমিশনের কার্যক্রম সম্পর্কে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। ইতিমধ্যে বেশকিছু বিতর্ক দানা বেঁধেছে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব দেয়ার আগেই পুরনো ধারা  অনুসরণ করে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। সংস্কার যেহেতু রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত; তাই কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা হয়নি বলে জানা যায়। কমিশন রিপোর্ট দেয়ার পরে তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হবে এমন ঘোষণা আছে। সংস্কার হচ্ছে একটি চলমান প্রক্রিয়া তাই কতোটুকু সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে করা সম্ভব সেরকম সুস্পষ্ট কোনো ঘোষণা নেই। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ সম্পর্কেও কোনো সুস্পষ্ট ঘোষণা দেয়া হয়নি। তাই সংস্কার এবং নির্বাচন এই দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। বিগত তিনটি নির্বাচনে নাগরিকরা যেহেতু ভোট দিতে পারেননি বা দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি; তাই নাগরিক এবং রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থকদের প্রধান এজেন্ডা হয়ে গেছে নির্বাচনী রোডম্যাপ। এ অবস্থায় জটিলতা নিরসনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার কি কি করতে চান এবং কখন নির্বাচন চান সেটি রোডম্যাপে ঘোষণা করতে পারেন। 
 

প্রশ্ন: বেশ কিছু নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগের কথা শোনা যাচ্ছে। নির্বাচনী রাজনীতিতে এর কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন? 
উত্তর: মাও সেতুং বলেছেন, শতফুল ফুটতে দাও। অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হওয়ার পর বেশকিছু নতুন রাজনৈতিক দল গড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে বিগত আন্দোলনের ছাত্র সমন্বয়করা একটি দল গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় আছেন বলে জানা যাচ্ছে। আগামী জানুয়ারি মাসে দলের ঘোষণা আসতে পারে। তারা ছাড়াও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা নতুন দল গঠনের ব্যাপারে আলোচনা করছেন বলে জানা গেছে। পুরনো রাজনৈতিক দলের প্রাক্তন এমপি এবং নেতারাও দল গঠনের ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ, বিএনপি’র মতো দুটি বৃহৎ দলের বাইরে ইসলামী ঐক্যজোট, জাপা এবং জামায়াতের সমর্থন দেখা যায়। নিবন্ধিত অন্যান্য দলগুলোর সেই অর্থে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই এবং নির্বাচনেও তাদের ফলাফল হতাশাব্যঞ্জক। দেশে একটি তৃতীয় ধারার দল গঠনের ব্যাপারে অনেকদিন ধরেই প্রচেষ্টা চলছে। কিন্তু সেরকম কোনো তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি গড়ে ওঠেনি। নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পরে জনগণ তাদেরকে কতোটুকু গ্রহণ করবে তা সময়ই বলে দেবে। ছাত্রদের আন্দোলনের কোনো পর্যায়ে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার কোনো ঘোষণা ছিল না। তাই তাদের দল গঠন প্রক্রিয়াকে অনেকে তীর্যক দৃষ্টিতে দেখছেন। অতীতে ছাত্র এবং তরুণদের পক্ষ থেকে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে জনগণের তেমন সমর্থন পাওয়া যায়নি। 
 

প্রশ্ন: সংস্কার আগে না নির্বাচন আগে- এ নিয়েও বিতর্ক চলমান। আপনার মত কী? 
উত্তর: ৫৪ বছরের বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থা নিয়ে যখন আমরা আলোচনা করি তখন শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ, নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার খুবই জরুরি বলে মনে হয়। সংস্কার যেহেতু চলমান প্রক্রিয়া সেহেতু সংস্কার কর্মসূচি নেয়া জরুরি ছিল। কিন্তু সরকারগুলো সেই সংস্কার কর্মসূচিতে হাত দেয়নি। জুলাইয়ে ছাত্র গণআন্দোলনের একটি বড় দাবি হচ্ছে- নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত যাতে স্বৈরাচারী বা অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কর্তৃত্ববাদী শাসন ফিরে না আসে। এ জন্য জনগণের কাছে সংস্কার খুব গুরুত্ব পেয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে, সংস্কার করতে গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করুক। কিছু মৌলিক সংস্কারে নজর দিয়ে আমাদের একটি জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। যেখানে সকল প্রাপ্তির জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। ভয়ভীতিহীন উৎসবমুখর পরিবেশে যাতে জনগণ ভোট দিতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। ভোটের আয়োজন এবং গণনা নিয়ে কেউ যেন কোনো প্রশ্ন না তুলতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের চেয়ে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত একটি সরকার গঠন পরিচালনায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তাই ডিম আগে না মুরগি আগে অর্থাৎ সংস্কার আগে না নির্বাচন আগে এই বিতর্কে না গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার এবং নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করে রাজনৈতিক দলগুলোর অবিশ্বাস, সন্দেহ আর আস্থাহীনতা নিরসন করতে পারেন।
 

প্রশ্ন: বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে টানাপড়েন লক্ষণীয়। অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ সঠিক পথে চলছে বলে মনে করেন? 
উত্তর: বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিগত সময়ে হয় ভয়, প্রেম-ভালোবাসা, নয়তো ঘৃণা-বিদ্বেষ এই আবর্তেই ঘুরপাক খেয়েছিল। ভারত আমাদের নিকট প্রতিবেশী। শত্রু বা বন্ধু বানানো যায় কিন্তু প্রতিবেশী বদলানো যায় না। ভারতের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত হচ্ছে প্রায় ৪০০০ কিলোমিটারের মতো। ভারত আমাদের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার। আমাদের আছে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। বাংলাদেশের জন্য ভারতের জনগণের অবদান ভোলা যায় না। ভারতের সঙ্গে আমাদের বেশ কিছু বিষয় নিয়ে যেমন-অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, সীমান্ত হত্যাসহ বেশ কিছু ইস্যুতে সমস্যা রয়েছে। এগুলোর সম্মানজনক সমাধান জরুরি। আমাদের স্বাধীনতা- সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। দেশে দেশে সহযোগিতার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের যে মডেল তা হতে পারে আমাদের সম্পর্ক গড়ে তোলার ভিত্তি। প্রায় মরে যাওয়া সার্ককে আমরা শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নিতে পারি। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি হওয়া উচিত দু’দেশের মানুষের কল্যাণ, অর্থনৈতিক উন্নতি এবং পারস্পরিক সম্মানের। 
 

প্রশ্ন: নানা পদক্ষেপ নিয়েও বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না অন্তর্বর্তী সরকার। সাধারণ মানুষ জেরবার, এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ সম্ভব কি? 
উত্তর: সরকার চেষ্টা করছে- এটা মাঝে মাঝে দেখা যায়। বিশেষ করে ভোক্তা অধিকারসহ যারা বাজার মনিটরিংয়ের দায়িত্বে আছেন তারা যাচ্ছেন। বাজারে আমরা যে সমস্ত জিনিস আমদানি করি তাদের একটি বড় সিন্ডিকেট ছিল। সেই সিন্ডিকেটের দু’একজন হয়তো আড়ালে চলে গেছেন, কিন্তু সিন্ডিকেট পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে বা অন্তর্বর্তী সরকার এটা ভেঙে দিতে পেরেছে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। যে কারণে আমদানি পণ্যের মূল্য কিছুতেই কমছে না। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারতের সঙ্গে সরকারের টানাপড়েনের সম্পর্ক। যে কারণে ভারত থেকে আমদানি করা পিয়াজ, আলু, ডিম, ডালের বাজার নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। এই সমস্যার নিরসনের জন্য সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। বাজারে নতুন আমদানিকারকদের প্রবেশের সুযোগ করে দিতে হবে। এতদিন সিন্ডিকেটের সদস্যরা অন্যদের বাজারে প্রবেশ করতে বাধা দিতো। অভ্যন্তরীণ বাজারে কয়েক হাত ঘুরে অন্য গ্রাহকের কাছে যায় এবং প্রতিটি হাত বদলের সময় পণ্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। সরকার ইচ্ছা করলেও এই মধ্যস্বত্বভোগীদের যে কয়েক স্তর বাজারে সক্রিয় আছে তা কমাতে পারবে না। দেশে বেকারত্ব এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ার কারণে অনেকেই এই মধ্যস্বত্বভোগীর ভূমিকায় নেমেছে এবং এরাই পণ্যমূল্য বাড়ানো এবং অতি মুনাফা করার জন্য বাজারে সংকট সৃষ্টি করছে। এখানে সরকার এবং যারা বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করেন তারা প্রতিটি স্তরে মুনাফা নির্দিষ্ট করে দিতে পারে। আমরা যখন বাজার পর্যালোচনা করি তখন দেখি যে দামে গ্রাহকরা খুচরা বাজারে পণ্য কেনেন তার বিশ শতাংশও উৎপাদনকারী কৃষকরা পান না। মাঠে একটা লাউয়ের দাম যদি বিশ টাকা হয় সেটা খুচরা বাজারে ৮০ থেকে ১০০ টাকা হয়। 
 

প্রশ্ন: নির্বাচনের সময় নিয়েও নানা আলোচনা। আপনার কি মনে হয়?
উত্তর: প্রধান উপদেষ্টা ১৬ই ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে ইতিমধ্যেই একটি টাইমলাইনের কথা বলেছেন যদিও তা সুস্পষ্ট নয়। এখানে সংস্কারের তিনটি ধাপের কথা বলা হয়েছে। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কার এবং নির্বাচনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করা হবে।
 

প্রশ্ন: ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের বিদায় হয়েছে। নির্বাচন যখনই হোক তাতে আওয়ামী লীগের অংশ নিতে পারা না পারা নিয়ে বিতর্ক চলছে? 
উত্তর: ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন হয়েছে। সরকারের যিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। ছাত্র সমন্বয়কদের পক্ষ থেকে বারবার দাবি করা হচ্ছে যে, পতিত প্রধানমন্ত্রী এবং তার সঙ্গে যারা মন্ত্রিসভায় ছিলেন এবং ঐ দলের শীর্ষ নেতাদের গণহত্যার দায়ে বিচার করতে হবে। দুর্নীতি এবং অর্থ পাচারের বিচার করতে হবে। এখানে আমাদের সকলের মনে রাখা দরকার যে, বিচার একটি প্রক্রিয়া, এখানে মামলা করতে হয়, তদন্ত করতে হয়, সাক্ষী সাবুদ প্রমাণ আদালতে পেশ করতে হয়। তারপরে নিম্ন আদালতে মামলাটির নিষ্পত্তি হয়। এরপরে মামলার রায় নিয়ে উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে। সেখানে হাইকোর্ট ডিভিশন রায় দেয়ার পরও অ্যাপিলেট ডিভিশনে যেতে পারেন সংক্ষুব্ধ পক্ষ এবং এর জন্য যৌক্তিক সময় দিতে হবে। এই অবস্থায় কাউকে নির্বাচন করতে দেয়া হবে না বা কোনো দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হবে না সেই দাবিটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। এখন যদি আওয়ামী লীগ, ১৪ দল এবং জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না দেয়া হয় তখন নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলো কিনা এই প্রশ্নটি স্বাভাবিকভাবেই উঠবে। আমরা যদি ২০০৮ সালের নির্বাচনের ফলাফল দেখি সেখানে এই দলগুলো সম্মিলিতভাবে ৫৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল সেই ভোট এখন পাবে কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন করা যেতেই পারে। ভোট কতো শতাংশ পাবে সেটা নিয়ে প্রশ্ন থাকার পরও তারা যে বিপুল সংখ্যক মানুষের ভোট পাবেন তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা দরকার। একজন নাগরিক হিসেবে আমি মনে করি, সকল অন্যায়ের বিচার করতে হবে এবং আমি এটাও মনে করি যে, বিচারের নামে কারও প্রতি অন্যায় করা যাবে না। একজন নাগরিক হিসেবে আমি নির্মূল এবং নিষিদ্ধের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। কেননা, নির্মূল এবং নিষিদ্ধের রাজনীতি ভালো কিছু ফলাফল বয়ে আনে না- এটা প্রমাণিত। 
 

সাক্ষাৎকার'র অন্যান্য খবর