দীর্ঘদিন সুশাসনের জন্য কাজ করে আসছেন ড. বদিউল আলম মজুমদার। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আইনি লড়াইয়েও জয় পেয়েছেন। ৫ই আগস্টের পট পরিবর্তনের পর নির্বাচন কমিশন সংস্কারে আসে কাঙ্ক্ষিত সুযোগ। প্রত্যাশিত নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধান হিসেবে ইতিমধ্যেই জাতির উদ্দেশ্যে প্রস্তাবনা পেশ করেছেন। তবু কথা থাকে, থাকে বিতর্কও। শেষ বিচারে সংস্কার বাস্তবায়নের দায়িত্ব অংশীজনের কোর্টে-এমনটাই 'জনতার চোখ'কে বলেছেন ড. বদিউল আলম মজুমদার। সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো-
প্রশ্ন: একটি সফল গণ-অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে এবং এ বিষয়ে একটি কমিশন গঠন করেছে, যেখানে আপনি প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ইতিমধ্যে আপনারা সংস্কারের জন্য সুপারিশও জমা দিয়েছেন। এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে কতোটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে বলে মনে করেন?
বদিউল আলম মজুমদার: সংস্কার বা পরিবর্তন সহজ নয়, কারণ এটি প্রচলিত পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হয়, যা দীর্ঘদিন ধরে অনুসরণ করা হয়ে আসছিল। আমাদের সুপারিশগুলোর মোটাদাগে চারটি অংশীজন রয়েছে। প্রথমত, সরকার। আমার মনে হয় না সংস্কারের বিষয়ে তাদের কোনো আপত্তি আছে; বরং তারা এগুলো বাস্তবায়ন করতে চাইবে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কিছু বিষয়ে হয়তো তারা দ্বিমত পোষণ করতে পারে। তবে, আমাদের সুপারিশগুলো গভীর বিশ্লেষণ ও অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন যখন আমাদের পূর্ণাঙ্গ সংস্কার সুপারিশগুলো দেখবে, আমার মনে হয় তখন তাদের আপত্তি থাকবে না। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলো। যাদের মধ্যেই মূলত সংস্কারের বিষয়ে কিছুটা দ্বিমত থাকতে পারে। কিন্তু নির্বাচনী সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও খুব একটা বাধা আছে বলে আমার মনে হয় না। আমাদের পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাবগুলো দেখলে, আমার মনে হয় না খুব একটা প্রশ্ন থাকবে। আমরা নির্বাচনী অঙ্গকে পরিচ্ছন্ন করার চেষ্টা করেছি। যাতে দুর্বৃত্তরা নির্বাচনকে কলুষিত করতে না পারে। চতুর্থত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন হলো জনগণ, যারা সংস্কার ও পরিবর্তন চায়। অপকর্মের সঙ্গে জড়িতদের বিচার চায়। এজন্যই তো তারা রক্ত ও জীবন দিয়েছে। তাদের প্রত্যাশা অপরাধীদের বিচার এবং নির্বাচন ব্যবস্থার পুনর্গঠন।
প্রশ্ন: সংসদীয় স্থায়ী কমিটির অধীনে ইসি’র বিষয়ে তদন্তভার দেয়া হলে সেটি ইসি’র স্বাধীনতা খর্ব করবে বলে মন্তব্য করেছেন সিইসি। আপনার মতামত কী?
বদিউল আলম মজুমদার: যদি কেউ গুরুতর অন্যায় করে, যেমনটি আউয়াল কমিশন ও নুরুল হুদা কমিশন করেছে। তারা পার পেয়ে যাক- এটা কি আমরা কেউ চাই? যদি জনমত যাচাই করা হয়, তাহলে ৯৯.৯৯% মানুষ তাদের বিচার চাইবে। জবাবদিহিতা মানুষকে দায়িত্বশীল করে এবং সীমা লঙ্ঘন থেকে বিরত রাখে। কেউ যদি নুরুল হুদা বা আউয়াল কমিশনের মতো অন্যায় না করে, তাহলে তো কিছু হবে না।
প্রশ্ন: কিন্তু সিইসি যুক্তি দিয়েছেন, যদি পার্লামেন্টের স্থায়ী কমিটি তাকে ভোটকেন্দ্র স্থানান্তরের নির্দেশ দেয় এবং তিনি না মানেন, তাহলে মেয়াদ শেষে কমিশন সমস্যায় পড়তে পারে।
বদিউল আলম মজুমদার: যদি তারা অন্যায় না করে, তাহলে সমস্যায় পড়ার প্রশ্নই আসে না। বর্তমানে ইসি নির্বাহী বিভাগের অধস্তন। ইসি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হলেও আইনের খসড়া তৈরির পর তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হয় এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আইন মন্ত্রণালয় নেয়। সুতরাং তারা নির্বাহী বিভাগের কাছে দায়বদ্ধ। অর্থ মন্ত্রণালয় টাকা না দিলে তারা কিছু করতে পারে না। একবার তাদের বেতন-ভাতা বন্ধ করে দিয়েছিল না? এখন আমরা বলছি, নির্বাচনী ব্যয় প্রজাতন্ত্রের কনসুলেটেড অ্যাকাউন্টের উপর দায়বদ্ধ হবে। যার মানে অর্থ দিতে বাধ্য। আমরা তাদেরকে স্বাধীন করে দিয়েছি। ইসি’র বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠলে তাদের মেয়াদ শেষে পার্লামেন্টের স্থায়ী কমিটি তদন্ত করবে। এটি সংসদের উচ্চকক্ষের দায়িত্ব হবে, যেখানে সব দলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। অনেক দেশেই সংসদীয় কমিটির কাছে নির্বাচন কমিশন দায়বদ্ধ। অন্যায় না করলে কি কেউ কারও বিরুদ্ধে চড়াও হতে পারবে? গণতন্ত্র মানেই হলো-নজরদারিত্ব, দায়বদ্ধতা ও পাহারাদার থাকা। হাসিনার কাছে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়েছে বলেই তো ৫ই আগস্টের ঘটনা ঘটেছে। হাসিনা দানব হয়েছে।
প্রশ্ন: সীমানা পুনর্নির্ধারণ ও ভোটার তালিকা সংক্রান্ত দায়িত্ব স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষের হাতে দেয়ার সুপারিশেও ইসি’র আপত্তি রয়েছে।
বদিউল আলম মজুমদার: বর্তমানে এনআইডি সবক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। তারা নির্বাচন করবে কখন আর এগুলো ম্যানেজ করবে কখন? এটা কি তাদের কাজ? এটা ফেরত দেয়ার জন্য বলেছি, কারণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গেলে ওটা অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহারের আশঙ্কা থাকে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের কাছেও কি এটির তথ্য পাচার হয়নি? বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হয়নি? মানুষ এখনো হয়রানির শিকার হয় না? নির্বাচন কমিশনের পক্ষে এটা সম্ভব নয়, এটা এত বিরাট হবে। সীমানা পুনর্নির্ধারণ হলো সবচেয়ে বিতর্কের একটি জায়গা। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এ নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ ছিল। তৃতীয় পক্ষ এই দায়িত্ব নিলে তো খুশি হওয়ার কথা।
প্রশ্ন: সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হচ্ছে কিনা এ নিয়ে একটি বিতর্ক রয়েই গেছে, আপনার বক্তব্য জানতে চাই?
বদিউল আলম মজুমদার: এক্ষেত্রে আমি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে একমত। নির্বাচন কমিশনই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে।
প্রশ্ন: সংস্কার বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব রাজনৈতিক দলের কিন্তু কথা থাকে তাহলে আপনারা যে প্রস্তাব দিলেন তার বাস্তবায়ন কি নির্বাচিতরা করবে?
বদিউল আলম মজুমদার: কে বললো রাজনৈতিক দলের। আমরা যে সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছি সেগুলোর ভিত্তিতে কতোগুলো আইন করতে হবে। এগুলো করবে কে? এক্ষেত্রে অধ্যাদেশ জারি করতে হবে। সুতরাং এগুলো স্লোগান। চারটি অংশীজন আছে। বল অংশীজনের কোর্টে। রাজনৈতিক দল অবশ্যই, কিন্তু যারাই সরকারে থাকে তাদেরই এগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। অধিকাংশ বাস্তবায়ন তাদের করার কথা।
প্রশ্ন: নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন আয়োজনের সুপারিশ দিলেও ইসি জাতীয় নির্বাচনের কথা ভাবছে। এটি কি যথাযথ সিদ্ধান্ত?
বদিউল আলম মজুমদার: আমরা জনগণের সঙ্গে কথা বলেছি। অধিকাংশ মানুষ আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চান এবং আগে এই নির্বাচন হওয়া সম্ভব। এটা সকলের জন্য মঙ্গলকর। মানুষ মতামত দিয়েছে, আমরা তো এগুলো আবিষ্কার করিনি। মানুষের চাওয়া এবং আমাদের বুদ্ধি-বিবেচনা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমরা করেছি।
প্রশ্ন: সুষ্ঠু নির্বাচন নির্ভর করে দিন শেষে ব্যক্তির ওপর, ভারতে যেমনটা টিএন সেশনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে? আমাদের এখানেও ভালোদের সময়ে নির্বাচন ভালো হয়েছে। আপনার মত কি?
বদিউল আলম মজুমদার: এই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার জন্যই তো তারা শপথ নিয়েছেন। তারা জনগণের স্বার্থে দায়িত্ব পালন করবে। আমি তো কোনো সমস্যা দেখি না সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে।
প্রশ্ন: আবারো ফিরছি তত্ত্বাবধায়কে কিন্তু অনির্বাচিত সরকার বিতর্ক কি জিইয়ে থাকছে না? রাজনীতিকেরা যদি বলে এটা সুশীলদের কারসাজি?
বদিউল আলম মজুমদার: আর কতো শিক্ষা দরকার? আমরা প্রায় ২০০০ প্রাণ হারিয়েছি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের কারণে এবং ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষ আহত হয়েছে। এরপরও কি প্রমাণ দরকার যে, তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া আমাদের দেশে নির্বাচন হয় না। এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, কারিগরি বিষয় নয়। রাজনীতিবিদরা সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করে তারা নির্বাচিত হবে। তো আর কতো প্রমাণ লাগবে আমাদের।
প্রশ্ন: রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিক কোনো সংগঠন না রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। কেন করা হলো এবং এটি কি রাজনৈতিক দল মেনে নেবে বলে মনে করেন?
বদিউল আলম মজুমদার: আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে। ৯০ ভাগের বেশি মানুষ এটার বিরুদ্ধে। এগুলো ছাত্রের নামে লাঠিয়ালি। আমি ছাত্ররাজনীতি করেছি এজন্য বলছি। বিশ্বের শীর্ষ প্রযুক্তি কোম্পানিতে ভারতীয়রা রয়েছে, কিন্তু আমাদের কি একজনও আছে? কারণ আমাদের সেরকম একটা প্রতিষ্ঠানও নাই। ছাত্রদের কাজ হলো লেখাপড়া করা। বস্তুত হাসিনা এতদিন টিকতে পারতো না, যদি লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি না থাকতো। বহু আগে হাসিনার বিদায় হতো।
প্রশ্ন: শুধু ব্যবস্থা সংস্কার করে বিদ্যমান লোকবল ও কাঠামো দিয়ে কি কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন আয়োজন করা যাবে?
বদিউল আলম মজুমদার: পরীক্ষা করা যেত যদি আগে স্থানীয় নির্বাচন হতো। জাতীয় নির্বাচনে ভুল করলে ভয়াবহ পরিণতি হবে, কিন্তু স্থানীয় নির্বাচনে ভুল হলে তা সংশোধন করা সম্ভব।
প্রশ্ন: শিক্ষার্থীরা নতুন দল করলে তারা নির্বাচন করতে পারবে কিনা। কারণ নিবন্ধনের একটা সময়সীমা আছে।
বদিউল আলম মজুমদার: তারা কতোটুকু প্রস্তুত আমি নিশ্চিত না। আমি শুনেছি, তারা আগামী মাসেই ঘোষণা দিবে। আর প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, বছরের শেষে এবং আগামী বছরের মাঝামাঝি নির্বাচন। সেক্ষেত্রে যথেষ্ট সময় আছে বলে মনে করি। ্ত