আ ন্ত র্জা তি ক

মধ্যপ্রাচ্য সংকটে আলোচনায় অদৃশ্য মানচিত্র

জনতার চোখ ডেস্ক | আন্তর্জাতিক
মার্চ ১, ২০২৫
মধ্যপ্রাচ্য সংকটে আলোচনায় অদৃশ্য মানচিত্র

২০০৮ সাল। তখন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট। তিনি তখনকার ফিলিস্তিনি নেতা মাহমুদ আব্বাসকে একটি চুক্তির জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ওই চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি বয়ে আনতে পারে। সেটা ছিল দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক চুক্তির একটি প্রস্তাব- যা বর্তমান সময়ে অসম্ভব এক ব্যাপার। যদি ওই চুক্তি বাস্তবায়ন হতো তাহলে এতদিনে একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়ে যেতো। তাতে থাকতো ইসরাইলের হাতে দখল হয়ে যাওয়া পশ্চিম তীরের শতকরা ৯৪ ভাগ ভূখণ্ড। এমন প্রস্তাব দিয়ে মাহমুদ আব্বাসকে একটি মানচিত্র দেখিয়েছিলেন ওলমার্ট। এটা নিয়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানারকম কথা ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সেই মানচিত্র এ পর্যন্ত কখনোই প্রকাশ পায়নি। এহুদ ওলমার্টের ওই মানচিত্র ছিল দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমস্যার সমাধান। এর অধীনে ইসরাইল এবং ফিলিস্তিন পাশাপাশি রাষ্ট্র হিসেবে বসবাস করতো। এসব নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা নরমা পারসি তার সর্বশেষ সিরিজ ‘ইসরাইল অ্যান্ড দ্য প্যালেস্টাইনিয়ানস: দ্য রোড টু সেভেন্থ অক্টোবর’ নির্মাণ করেছেন। সোমবার থেকে তা আইপ্লেয়ারে পাওয়া যাওয়ার কথা। এতে ওলমার্ট তার সেই মানচিত্র প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ২০০৮ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর জেরুজালেমে এক মিটিংয়ে এই মানচিত্র তিনি দেখিয়েছিলেন মাহমুদ আব্বাসকে। তিনি ওই নির্মাতাকে বলেন, এটাই প্রথমবার আমি এই মানচিত্র প্রথম কোনো মিডিয়ার কাছে প্রকাশ করছি। অনলাইন বিবিসিতে সাংবাদিক পল অ্যাডামস এসব কথা লিখেছেন। 


দীর্ঘ প্রতিবেদনে তিনি আরও লিখেছেন, ওই মানচিত্রে বিস্তারিত তথ্য আছে। তাতে পশ্চিমতীরের শতকরা ৪.৯ ভাগ অংশ ইসরাইলের কাছে ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ওলমার্ট। এর অধীনে পড়তো বিশেষত ইহুদি বসতিস্থাপনকারীদের ব্লকগুলো। ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে এমনই আরেকটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। এহুদ ওলমার্ট বলেছিলেন, এর পরিবর্তে ইসরাইলের ভূখণ্ড থেকে সমপরিমাণ জায়গা ছেড়ে দেবে ইসরাইল। তা হবে পশ্চিমতীর এবং গাজা উপত্যকা সংলগ্ন। এই দু’টি এলাকার সঙ্গে ফিলিস্তিনের মূল ভূখণ্ডের সংযোগ হবে টানেল বা মহাসড়কের মাধ্যমে। এ নিয়ে আগেই অনেক আলোচনা হয়েছে। 
ফিলিস্তিনি নেতা মাহমুদ আব্বাস কি জবাব দিয়েছিলেন তা প্রামাণ্যচিত্রে তুলে ধরেছেন এহুদ ওলমার্ট। তিনি বলেন, ফিলিস্তিনি নেতা বললেন- প্রধানমন্ত্রী, এটা খুবই সিরিয়াস। খুবই, খুবই, খুবই সিরিয়াস। 


গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এহুদ ওলমার্টের পরিকল্পনায় জেরুজালেমের একটি কণ্টকিত ইস্যুর প্রস্তাবিত সমাধান ছিল। উভয় দেশই তাদের রাজধানী দাবি করতে পারতো জেরুজালেমকে। সেখানে একটি ‘হলি বেসিন’ তৈরি করা হবে। এর মধ্যে থাকবে ওল্ড সিটি, ধর্মীয় স্থাপনা ও সংলগ্ন এলাকাগুলো। এসব ইসরাইল, ফিলিস্তিন, সৌদি আরব, জর্ডান ও যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বয়ে গঠিত একটি ট্রাস্টি কমিটির হাতে থাকবে। তারাই প্রশাসনিক কার্যক্রম চালাবে। এই মানচিত্রে ইহুদি বসতির বাস্তবায়নের প্রভাব হতো ব্যাপক। পশ্চিমতীর এবং জর্ডান উপত্যকায় বিক্ষিপ্তভাবে বসবাস করতেন কয়েক ডজন সম্প্রদায়ের মানুষ। যদি ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হতো তাহলে এদেরকে সেখান থেকে সরিয়ে নিতে হতো।  


২০০৫ সালে গাজা উপত্যকা থেকে কয়েক হাজার ইহুদি বসতি স্থাপন জোরপূর্বক সরিয়ে নেন ইসরাইলের আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারন। কিন্তু ইসরাইলের ডানপন্থিদের কাছে এটাকে দেখা হয় জাতীয় একটি ক্ষত হিসেবে। পশ্চিম তীর থেকে মানুষজনকে সরিয়ে নেয়া হতো অসীম পর্যায়ের এক বৃহত্তর চ্যালেঞ্জ। কারণ, এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতেন হাজার হাজার বসতি স্থাপনকারী। ফলে বাস্তবে ভয়াবহ এক সহিংসতার আশঙ্কা ছিল।  কিন্তু সেই পরীক্ষা কখনো সামনে আসেনি। 


ফিলিস্তিনের তখনকার প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস মানচিত্রে যতক্ষণ স্বাক্ষর করবেন না ততক্ষণ পর্যন্ত ওই মানচিত্রের একটি কপি তার হাতে হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানান এহুদ ওলমার্ট। এমনভাবেই তাদের মিটিং শেষ হয়। কারণ, আব্বাস ওই মানচিত্রে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এই মানচিত্র নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে তার কথা বলতে হবে। তাদেরকে আস্থায় নিতে হবে যে- কি প্রস্তাব করা হয়েছে। ওলমার্ট বলেন, পরের দিন মানচিত্র বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে একটি মিটিং করতে একমত হন দুই নেতা। এহুদ ওলমার্ট বলেন, আমরা এর অংশ হয়েছিলাম। আমরা ঐতিহাসিক একটি পদক্ষেপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। 
কিন্তু সেই মিটিং আর কখনো হয়নি। 
ওই রাতে জেরুজালেম থেকে তারা গাড়ি চালিয়ে যান। সেই সময়ের কথা, গাড়ির  ভেতরের পরিবেশ সম্পর্কে কথা বলেছেন মাহমুদ আব্বাসের তখনকার চিফ অব স্টাফ রফিক হুসেইনি। তিনি ওই প্রামাণ্যচিত্রে এ প্রসঙ্গে বলেন- অবশ্যই আমরা হেসেছিলাম। ফিলিস্তিনিরা বিশ্বাস করেছিলেন এই পরিকল্পনা কখনো কার্যকর হবে না। ওদিকে এর সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন এক দুর্নীতিতে জড়িয়ে যায় এহুদ ওলমার্টের নাম। ততক্ষণে তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দেয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। তার বিষয়ে হুসেইনি বলেন, এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, ওলমার্ট যত ভালো মানুষই হোন না কেন। আদতে তিনি একটি খোঁড়া হাঁসের মতো। তাই আমরা এই পরিকল্পনা নিয়ে আর কোথাও যাইনি। 


গাজা পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর জটিল এক বিষয়। হামাস নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে ইসরাইলে এক পর্যায়ে রকেট হামলা হয়। তার কয়েক মাস পরে ডিসেম্বরে ওলমার্ট সেখানে বড় রকমের অভিযান ‘অপারেশন কাস্ট লিড’ পরিচালনার নির্দেশ দেন। এর ফলে তিন সপ্তাহের তীব্র যুদ্ধ হয়। এহুদ ওলমার্ট বলেন, যদি ওই চুক্তিতে মাহমুদ আব্বাস স্বাক্ষর করতেন তাহলে তা হতো খুবই স্মার্ট কাজ। যদি ইসরাইলের কোনো প্রধানমন্ত্রী ভবিষ্যতে এই চুক্তি বাতিল করার চেষ্টা করতেন, তাহলে আব্বাস বিশ্ববাসীকে বলতে পারতেন- এর ব্যর্থতা ইসরাইলের। 
এরপরে ফেব্রুয়ারিতে ইসরাইলে নির্বাচন আসে। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের তীব্র বিরোধী লিকুদ পার্টির নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। কিন্তু ওলমার্টের সেই পরিকল্পনা, মানচিত্র চলে যায় দৃষ্টির আড়ালে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট ওই প্রামাণ্যচিত্রে বলেন, এখনো তিনি মাহমুদ আব্বাসের জবাবের অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু তিনি যে পরিকল্পনা করেছিলেন তা ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত বন্ধের হারিয়ে যাওয়া সুযোগের দীর্ঘ তালিকায় যুক্ত হয়েছে। 


ফিলিস্তিনিরা কখনো সুযোগ হাতছাড়া করেন না বলে ১৯৭৩ সালে ইসরাইলের সাবেক কূটনীতিক আববা এবান কটাক্ষ করেন। তখন থেকেই ইসরাইলি কর্মকর্তারা বার বার এই বাক্যটি পুনরুল্লেখ করেন। কিন্তু পরিবর্তিত বিশ্ব তার চেয়েও জটিল। বিশেষ করে উভয় পক্ষ যখন ১৯৯৩ সালে ঐতিহাসিক ওসলো চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, তখন থেকে। এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে হোয়াইট হাউসের সবুজ লনে করমর্দন করেছিলেন তখনকার ফিলিস্তিনি প্রধানমন্ত্রী ইয়াসির আরাফাত ও ইসরাইলি সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন। তারা প্রকৃত আশাকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই চুক্তির ফলও ফেল করেছে। তারপর থেকে পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল থেকে জটিল হয়েছে। দায়ী করার ব্যাপক সুযোগ এসেছে। প্রকৃত সত্য হলো, তারপর কখনোই তারকার আলো সঠিকভাবে পড়েনি। 


পল অ্যাডামস লিখেছেন, ২৪ বছর আগে আমি তাদের মধ্যে অসঙ্গতি দেখেছি। ২০০১ সালে মিশরের অবকাশযাপন কেন্দ্র তাবা’তে ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনি মধ্যস্থতাকারীদের আবার একটি চুক্তি নিয়ে বসেছেন। ফিলিস্তিনি প্রতিনিধিদলের একজন সদস্য একটি ন্যাপকিনে একটি খসড়া মানচিত্র এঁকেছিলেন এবং আমাকে বলেছিলেন- তারা একটি যোগ্য ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয় দেখছেন। কিন্তু সেই আলোচনা সেখানে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। পশ্চিমতীর এবং গাজার সড়কে যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে তার মধ্যে হারিয়ে যায় এ উদ্যোগও। দ্বিতীয় অভ্যুত্থান বা ইন্তিফাদা শুরু হয় আগের সেপ্টেম্বর থেকে। আবারো ইসরাইলে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়। প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক এরই মধ্যে পদত্যাগ করেছেন। কয়েক সপ্তাহ পর নির্বাচনে তাকে আরামের সঙ্গে পরাজিত করেন অ্যারিয়েল শ্যারন। 

আন্তর্জাতিক'র অন্যান্য খবর