কলকাতার চিঠি

ট্রাম্প বোমায় ভারতে উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে

পরিতোষ পাল, কলকাতা | আন্তর্জাতিক
মার্চ ১, ২০২৫
ট্রাম্প বোমায় ভারতে উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প কিছুটা চিরাচরিত ছকের বাইরে হাঁটেন। বিশ্বের বহু রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে তার সম্পর্কের ইতিহাস নেতিবাচক। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির ক্ষেত্রে তা নয়। এই অভিমত স্বয়ং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের। কিন্তু জয়শঙ্কর যাই বলুন না কেন, ট্রাম্প ছক কষেই একের পর এক বোমা ফাটিয়েছেন বিভিন্ন দেশকে দেয়া মার্কিন অনুদান নিয়ে। ভারতের বিরুদ্ধে তিনি তিন তিনবার বোমা ছুড়েছেন। একবার তো মোদিকেই আঘাত করেছেন। আবার প্রতিবেশী বাংলাদেশের দিকেও বোমা ছুড়েছেন বেশ জোরালো মাত্রায়। বাংলাদেশকে ২৯ মিলিয়ন ডলার  (২৫২ কোটি টাকা) অনুদান বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে ট্রাম্প সেই অনুদানকেও একই ভাবে অপ্রয়োজনীয় বলেছেন। তবে বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অনুদান বিতর্ক তীব্র আকার ধারণ করেনি। সেখানে ভারতে রাজনৈতিক উত্তেজনার পারদ দিন দিন ক্রমশ চড়ছে। 


আন্তর্জাতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশকে অর্থ সাহায্য করে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৬১ সাল থেকেই চলছিল এই ব্যবস্থা। বিদেশিদের মার্কিন সাহায্য দেয়ার বিভিন্ন সংস্থাকে এককরে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি তৈরি করেছিলেন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা  (ইউএসএইড)। স্বাস্থ্য থেকে বিপর্যয় মোকাবিলা সহ বিভিন্ন খাতে এই অর্থ দেয়া হতো। এটি একটি স্বশাসিত সংস্থা হলেও মার্কিন বিদেশ সচিবের অধীনেই এটি পরিচালিত হয়ে এসেছে। এতদিন পরে ডনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় বসার পরই ব্যয় সাশ্রয়ের লক্ষ্যে তার মুখ্য উপদেষ্টা ইলন মাস্ক সব অনুদান বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। পরে ট্রাম্প সেই ঘোষণাকে সমর্থন করে বিস্ফোরক নানা তথ্য প্রকাশ্যে হাজির করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার  (ইউএসএইড) অনুদান নিয়ে ভারতে যে বিতর্ক দানা বেঁধেছে, তাতে ইন্ধন দিয়েছেন ট্রাম্প স্বয়ং। ভারতের নির্বাচনকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে আরও বেশি সংখ্যক ভোটারদের ভোটদানে উৎসাহিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অনুদান প্রসঙ্গে ২১শে ফেব্রুয়ারি ডনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ইউএসএড ভারতে যে ২১ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছিল, তা ‘ঘুষ’ ছিল। পরদিনই ট্রাম্প বলেন, আমার বন্ধু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে ২১ মিলিয়ন ডলার যাচ্ছিল। আমরা ভারতে ভোটের হার বাড়ানোর জন্য ২১ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছিলাম।  


তিনি আরও বলেছেন, ভারতকে তাদের নির্বাচনের জন্য আমরা এত টাকা কেন দেবো? বরং ওরা আমাদের সাহায্য করুক। সেটা কেমন হবে? ভারতের কোনো টাকার প্রয়োজন নেই। এর আগে ট্রাম্প বলেছিলেন, ভারতে পূর্বতন বাইডেন প্রশাসন অর্থ দিয়েছিল নির্বাচনে পরিবর্তনের লক্ষ্যে। ট্রাম্পের এই মন্তব্যকে হাতিয়ার করে ভারতের শাসক দল বিজেপি সরাসরি কংগ্রেসে নেতা রাহুল গান্ধীকে আক্রমণ করে বলেছিল, নির্বাচনে বিদেশি হস্তক্ষেপ চাওয়ার দাবি করেছিল কংগ্রেসই। বিজেপি’র মুখপাত্র গৌরব ভাটিয়া তথ্যসহ বলার চেষ্টা করেছিলেন যে, কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ শাসনামলে (২০০৪-২০১৩ সাল) ভারতে দুই হাজার মিলিয়ন ডলারের  বেশি তহবিল এসেছে। বিজেপি’র অভিযোগ কংগ্রেস দেশের সার্বভৌমত্ব ও দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিতে চেয়েছিল বলেই এই অর্থ দেয়া হয়েছিল। সেখানে  মোদি কোনো বিদেশি শক্তির কাছে ভারতের স্বার্থ বিক্রি করবেন না বলে জানার ফলে মাত্র ১.৫ মিলিয়ন ডলার অনুদান এসেছিল।


বিজেপি’র আক্রমণ কংগ্রেসকে বিপাকে ফেলবার আগেই ট্রাম্পের অনুদানের সঙ্গে মোদির নাম নেয়া ও ঘুষের প্রসঙ্গ উত্থাপনের পরই বিজেপি আমতা আমতা করা শুরু করে দিয়েছে। এবার কংগ্রেস তেড়েফুড়ে আক্রমণ শানিয়ে চলেছে। মোদির নাম উল্লেখ করা নিয়ে কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রী কেন চুপ করে রয়েছেন সেই প্রশ্ন তুলেছেন।  কংগ্রেসের জনসংযোগ বিভাগের চেয়ারম্যান পবন খেরা দাবি তুলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যে নরেন্দ্র মোদিকে ২১ মিলিয়ন ডলার ঘুষ দিচ্ছিল বলে অভিযোগ করেছে, তার পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উচিত তার বন্ধু ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলে এই অভিযোগ খারিজ করা।


বিজেপি নেতারা এরপর থেকে গা বাঁচাতে নানা উল্টাপাল্টা কথা বললেও মোদি সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে ভারতে এই অর্থ এসেছে অনেকদিন ধরেই। ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপ হচ্ছে বলেও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রক সরাসরি মন্তব্য করেছে। তবে মোদির আমলে অর্থ  আসা নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাফ জানিয়েছেন, ইউএসএইড-কে ভারতে কাজ করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল সরল বিশ্বাসে, ভালো কাজের জন্য। বছরের পর বছর ধরে ওই সংস্থা ভারতে কাজ করছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, সমপ্রতি মার্কিন প্রশাসনের তরফে তহবিল সম্পর্কিত কিছু তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। তিনি বলেছেন, ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপ হচ্ছে, যা উদ্বেগের। 
জয়শঙ্করের মতে, ইউএসএইড নিয়ে আমরা কাজ করি কিনা, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। এখন কথা উঠছে, যুক্তরাষ্ট্রের এই অনুদান খারাপ কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। যদি এই অভিযোগ সত্যি হয়, দেশের মানুষের এটা জানার অধিকার আছে যে, কারা সেই খারাপ কাজের সঙ্গে যুক্ত।


এরপরই বিরোধী সব দল আক্রমণ আরও তীব্র করেছে। কংগ্রেস প্রশ্ন তুলেছে, বিজেপি তো দাবি করছে, ২০১২ সালে ভারতে ভোটের হার বাড়াতে ইউএসএইডের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের চুক্তি হয়। কংগ্রেসের জন্য সেই টাকা ঢালা হলে ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে কংগ্রেস মাত্র ৪৪টি আসন পেলো, বিজেপি ২৮২টি আসন পেলো কীভাবে? সেই চুক্তি কেন ২০২০-তে নতুন করে করা হলো? ২০০১ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে ভারতে ইউএসএইডের ২৯০ কোটি ডলার এসেছে। মোদি থেকে ‘আধুনিক চাণক্য’ অমিত শাহ এতদিন এর খোঁজ পাননি? এই অর্থ কি বিরোধী দল, নাগরিক সংগঠন, সংবাদমাধ্যমকে দুর্বল করার কাজ চলছিল? বিদেশি তহবিলের টাকা ভারতে ঢোকার ক্ষেত্রে এত কঠোর আইন। তা সত্ত্বেও সরকার কোনো খোঁজ রাখে না? এ কেমন সরকার চলছে? এর সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেসসহ বিরোধীরা শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি তুলেছে।


বিদেশি অর্থ যে নির্বাচনে ব্যবহার করা হয়েছে তা নিয়ে অনেকেরই কোনো সন্দেহ নেই। ভারতের সাবেক নির্বাচন কমিশনার কুরেশি মেনে নিয়েছেন যে, ইউএসএইডের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের চুক্তি হয়েছিল। তবে তাতে অর্থ বরাদ্দের কোনো বিষয় ছিল না। 


তবে ভারতের মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআইএম) মতে, ভোট প্রভাবিত করার জন্য  বিদেশি অনুদান নিশ্চিতভাবেই ব্যবহার করা হয়েছে। সিপিআইএম নেতা মোহাম্মদ সেলিম বলেছেন, বিদেশি অর্থ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার (এনজিও) মাধ্যমে কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখতে একসময় প্রধানমন্ত্রী আই কে গুজরাল সরকারের আমলে একটি কমিটি হয়েছিল। সেই কমিটির প্রধান হিসেবে কাজ করেছিলাম। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর আর কোনো কমিটি করেনি। সেই কমিটি তুলে দিয়েছে। তিনি সরকারের উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছেন, সাহস থাকলে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার শ্বেতপত্র প্রকাশ করুক, কীভাবে অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট করতে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করতে এই অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে।


তবে ভারতে মার্কিন অনুদান কারা পেয়েছে তা নিয়ে সরকার খোঁজ করে দেখার কথা বললেও তথ্য সামনে আসবে কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের অবশ্য আশঙ্কা কিছু এনজিওকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সরকার মুক্ত হতে চাইবেন। ইতিমধ্যেই অর্থ মন্ত্রকের যে তথ্য সামনে আনা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, ভোটের জন্য কোনো অর্থ খরচ করা হয় নি। যা খরচ হয়েছে তা সাতটি অন্য প্রকল্পের জন্য। অর্থ  মন্ত্রকের মতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সাতটি প্রকল্পের জন্য ইউএসএইড ৭৫০ মিলিয়ন ডলার দিয়েছিল। ভারত সরকারের সঙ্গে অংশীদারিত্বে ইউএসএইড এই অনুদান পুরোটাই ব্যয় করেছে।  


ভারত সরকার ট্রাম্পের অভিযোগের উত্তরে নানা ভাবে বলা হচ্ছে যে, অনুদানের অর্থ ভোটের কাজে ব্যবহার করা হয় নি। উল্টো ভারতের পক্ষ থেকে অনুদান বিতর্কের দায় ট্রাম্পের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা চলছে। বলা হচ্ছে, এই অনুদান-বিতর্ক ট্রাম্পের তৈরি করা। তিনি এবং তার দল তার পূর্বসূরি বাইডেন প্রশাসনের বৈদেশিক অর্থ অনুদানের নীতিতে অবিশ্বাসী। ইউএসএইডের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক নেই। তাই ধারাবাহিক ভাবে জলঘোলা করছেন। ঘরোয়া রাজনীতিতে লাভের অঙ্ক কষেই ট্রাম্প এগোচ্ছেন বলে মনে করা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, এই অভিযোগকে আমলে নেয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ট্রাম্পের মতো মানুষ নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কথা ভেবে এই খেলা খেলতেই পারেন। 

আন্তর্জাতিক'র অন্যান্য খবর