এই সময়

সংস্কার হওয়া, না-হওয়া

মোজাম্মেল হোসেন | মতামত
জুলাই ৫, ২০২৫
সংস্কার হওয়া, না-হওয়া

ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসন উৎখাতের বর্ষপূর্তির সময় আমরা দেখছি দেশ পরিচালনাকারী অন্তর্বর্তী সরকার এ সময়ে অতীব গুরুত্ব দিয়েছে সংস্কার কার্যক্রমে। এ জন্য যেমন বিস্তৃত প্রস্তুতি ও দীর্ঘ সময় নেয়া হচ্ছে তেমনি সংস্কার নিয়েই আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে বেশি। এমনকি সন্দেহের কথাও উঠেছে যে, সরকার কি প্রকৃতপক্ষে সংস্কার চায় না- নির্বাচনকে এড়িয়ে যাওয়া বা নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার অজুহাত হিসেবে সংস্কার নিয়ে উঠ-বস করা দেখানো হচ্ছে?
 

তবে সন্দেহ নেই যে, যদি আমরা সংবিধানে গণতন্ত্র রেখেও বার বার গণতন্ত্রের বরখেলাপ, নির্বাচন বিনষ্ট ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে ফিরে ফিরে আসা ঠেকাতে চাই, যদি শেখ হাসিনার মতো একনায়কত্বকামী নেতা-নেত্রীর উত্থান সহজে যাতে ঘটতে না পারে তা চাই, যদি ভয়াবহ দুর্নীতি ও নাগরিক জীবনে নানা অত্যাচার-উৎপাত বন্ধ করতে চাই; তবে দেশের রাষ্ট্র কাঠামোতে, সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক নেতাদের আচরণ-কার্যকলাপে বেশ কিছু সংস্কার আনতেই হবে। অন্তত সরকারের প্রধান নির্বাহী তথা প্রধানমন্ত্রী যাতে জবাবদিহির ঊর্ধ্বে সবকিছুর সর্বেসর্বা না হয়ে উঠতে পারেন এবং সরকার, সংসদ, ক্ষমতাসীন দল প্রতিটির প্রধান পদাধিকারী হয়ে সর্বময় ক্ষমতা এক হাতে কুক্ষিগত না করতে পারেন, ক্ষমতার ভারসাম্য থাকে তেমন ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে আমাদের বিগত দিনের অভিজ্ঞতা থেকেই। 
আমরা স্মরণ করতে পারি যে, ২০১৮ সালে রাজধানীতে বাসচাপা পড়ে দু’জন স্কুলছাত্রের মৃত্যুর পরে সড়ক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার দাবিতে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের এক নজরকাড়া আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। এই শিশুদের স্লোগান ও হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ এবং ‘রাষ্ট্র মেরামত’-এর মতো শব্দ আমরা  পেয়েছিলাম। ছাত্ররা আমাদের শিখিয়েছিল যে, সড়ক দুর্ঘটনা কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়, পরিবহনের নিয়ম-কানুন না মানার জন্য এগুলো প্রকৃতপক্ষে হত্যাকাণ্ড। কাকতালীয়ভাবে ঠিক জুলাই-আগস্টের ১১ দিন ধরে ঐ আন্দোলনে তারা রাস্তায় মোটরগাড়ি ও চালকের লাইসেন্স পরীক্ষা করেছিল। দুঃখের বিষয় আইন সংস্কারের একটি অকার্যকর পদক্ষেপ নিলেও শেখ হাসিনার সরকার তখন শিশুদের আন্দোলনটিকেও বৈরী দৃষ্টিতে দেখে, রাজনৈতিক শক্তি এর সুযোগ নিতে পারে মনে করে ছাত্রলীগকে ‘হেলমেট বাহিনী’ হিসেবে নামিয়েও আন্দোলনটি দমন করে। শিশুদের ও নাগরিকদের মনের ভাষা পড়তে সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতার জের টেনেই সরকারকে ২০২৪ সালে পতিত হতে হয়। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।
 

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূস ক্ষমতা গ্রহণের দু’সপ্তাহ পরে গত বছরের ২৫শে আগস্ট জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া প্রথম ভাষণে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের কথা বলেন। তার ভাষায়, “...ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানকে সফল পরিণতি দিতে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা, আইন-শৃঙ্খলা খাত এবং তথ্য প্রবাহে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পূর্ণ করে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা হবে।”
এর পর ১১ই সেপ্টেম্বর থেকে অল্পদিনের মধ্যে পর্যায়ক্রমে তিনি মোট ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেন। এ ছাড়া একটি আছে গুম বিষয়ক তদন্ত কমিটি ও আরেকটি ব্যাংক খাত টাস্কফোর্স। সংস্কার কমিশনগুলোর কাজ চূড়ান্তভাবে সমন্বিত করে জাতীয়ভাবে একমতে পৌঁছানোর লক্ষ্যে প্রফেসর ইউনূস নিজে সভাপতি হয়ে, এই উদ্দেশ্যে আনীত মার্কিন প্রবাসী অধ্যাপক আলী রীয়াজকে সহ-সভাপতি করে একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করেন। 
সংস্কারের জন্য প্রধান উপদেষ্টা যে কর্মকৌশলটি নেন তা হচ্ছে জনগণকে আস্থায় না নিয়ে, নিজের ও উপদেষ্টা পরিষদের পক্ষ থেকে ঢাকার বাইরে কোথাও একদিনের জন্যও কোনোরকম জনসংযোগে গিয়ে জনগণের মনের স্পন্দন বোঝার চেষ্টা না করে, প্রধানত দীর্ঘদিন দেশের বাইরে অবস্থানকারী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কয়েকজন আমেরিকান ও বিদেশি বিশেষজ্ঞদের এনে তাদের দিয়ে দিস্তা দিস্তা কাগজে প্রতিবেদন ও সুপারিশ লিখিয়ে তারপর সেগুলোর ভিত্তিতে তিরিশটির মতো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্যে আসার চেষ্টা। আওয়ামী লীগের নেতারা যেহেতু পলাতক ও দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাই আওয়ামী লীগ বাদে এই দলগুলোর মধ্যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ হলো ছুটকা-ফাটকা ইসলামী দল ও কয়েকটি স্বল্প প্রভাবের বাম ও মধ্যপন্থি দল। প্রধান উপদেষ্টা  ঘোষণা করেছেন, যতগুলো বিষয়ে ঐকমত্য হবে তার ভিত্তিতে জুলাই সনদ নামে একটি চার্টার ঘোষণা করা হবে এবং তার ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। 
প্রথম ছয়টি কমিশন চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমাংশের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদনগুলো জমা দেয়। রাজনৈতিক  দলগুলোর সঙ্গে প্রথমে পৃথক পৃথক, পরে একত্রে এমন দফায় দফায় বৈঠকী আলোচনায় বাস্তবায়নযোগ্য সুনির্দিষ্ট সংস্কার প্রস্তাবের পরিবর্তে দেশের সংবিধানের মূলনীতিগত ও আদর্শগত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক ও সময়ক্ষেপণ করায় জনমনে সন্দেহ-সংশয় ও নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পর্কে শঙ্কা বাড়তে থাকে। 

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত। জুলাইয়ের মধ্যে সনদ ঘোষণার প্রতিশ্রুতি আছে প্রধান উপদেষ্টার। সুখের বিষয় এই লেখার সময় পর্যন্ত সাংবিধানিক প্রশ্নে ৭০ অনুচ্ছেদের প্রয়োগ সীমিত করে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা বাড়ানো, একজন প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকা দুই মেয়াদ বা ১০ বছরে সীমিত করা, সংসদের স্থায়ী কমিটিগুলোর সভাপতি পদ বিরোধী দলের জন্য সম্প্রসারিত করা, রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতিসহ নির্বাচন কমিশন প্রভৃতি সাংবিধানিক সংস্থাগুলোর নিয়োগ পদ্ধতিসহ কয়েকটি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সকল দলের সকল বিষয়ে একমত হওয়া অবশ্যই অবাস্তব চিন্তা। জনগণের আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে নির্বাচিত সংসদে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই এর সমাধান করা উচিত। যথাসম্ভব জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠাও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের উপর নির্ভরশীল। 

 

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ঐকমত্যে পৌঁছানোর বাস্তব সম্ভাবনাকে বিবেচনায় নিয়ে সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলোর উপর মনোনিবেশ করলে কাজ আরও সহজ হতো। তারা কম গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কিত বিষয়গুলোতে অহেতুক সময় ব্যয় করেছেন। এসব কারণেও প্রক্রিয়াটি ঝুলে গেছে এবং সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। কিছু সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে আদেশক্রমে কার্যকর করা সম্ভব। তবে সংবিধান বিষয়ক সংস্কারগুলো অবশ্যই নির্বাচিত সংসদে যথাযথ প্রক্রিয়ায় হতে হবে। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে থাকলো- এটাই আমাদের লাভ বা সান্ত্বনা। 
ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এত দীর্ঘ বৈঠকে প্রধানত সাংবিধানিক-রাজনৈতিক সংস্কারের বিষয়গুলো নিষ্পত্তির চেষ্টা করেছে। অন্যান্য কমিশনের প্রস্তাবগুলোর ভাগ্য এ সময়ে আড়ালেই রয়ে গেল, যদিও সারাংশ জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়েছে। বিশেষ করে নারী বিষয়ক কমিশনের প্রতিবেদনে নারীর সমঅধিকারের কিছু বিষয় আসাতে যে প্রচণ্ড বিরোধিতা এসেছে ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল ইসলামী রাজনৈতিক মহল থেকে তাতে প্রফেসর ইউনূসের সরকার আর ঐ ঝাঁপি খুলবেন বলে মনে হয় না। ইসলামী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর এই বাড়াবাড়ি অবশ্যই ইউনূসের অন্তর্বর্তী নীতির ফল। অথচ নারী কমিশন তাদের প্রতিবেদন ইউনূসের কাছে জমা দিলে তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন, যেগুলো সম্ভব সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। 
প্রফেসর ইউনূস প্রচেষ্টাটি শুরু করার সময়ই আজ থেকে সাত মাস আগে গত ১০ই নভেম্বর ‘সংস্কারের গতি-প্রকৃতি’ শিরোনামে একটি লেখা শুরু করেছিলাম এই বাক্য দিয়ে যে, “সংস্কারের গল্পটা অনেক বড় করে ফাঁদা হয়েছে। যেন আকাশ-পাতাল স্বর্গ-মর্ত্য কতো কিছু সংস্কার করে ফেলা হবে তুড়ি মেরে।” বোঝাই যায়, সতর্কীকরণ ছিল আমার ভাবনার মূল সুর। এখন বলতে পারি, অতি সামান্যই কার্যকর হতে যাচ্ছে এবং তা-ও হওয়া না-হওয়ার দোলায় দুলবে। তবে আমরা আশা করবো অতি প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো আমাদের রাজনৈতিক নেতারা হতে দেবেন। ১৯৯০-এর তিন জোটের রূপরেখার মতো রাজনীতিবিদরা ছেঁড়া কাগজের ঝুড়িতে ফেলবেন না জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। 
কতো কিছুই না আমাদের দেশে সংস্কার করা প্রয়োজন। জুলাই অভ্যুত্থানের মতো এত বড় আলোড়নের পরেও সুযোগ পেয়ে ইউনূসের সরকার অতি প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো যা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল, সংবিধান সংস্কার করা লাগতো না, সেগুলোও করলো না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রাজনৈতিক দলের কর্মী ও অপরাধীচক্রের দ্বারা যে দোকান-বাজারে, নির্মাণকাজে, পরিবহনে ব্যাপক চাঁদাবাজি হয় তা বন্ধ করার দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়া যেতো। এতে জনগণ ও সমাজের বিরাট উপকার হতো। এখন দেখা যাচ্ছে বিএনপি ক্ষমতায় না যেতেই তাদের ক্যাডাররা নামে-বেনামে চাঁদাবাজির উৎসবে মেতে উঠেছে। এমনকি নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। জনগণের চরম দুর্ভোগের উৎস এই অনাচারগুলো সমাজ থেকে দূর করার জন্য সংস্কারের পদক্ষেপ জরুরি ছিল না? অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাগণ ও রাজনৈতিক নেতারা কী বলেন? ্ত

 

মতামত'র অন্যান্য খবর