মাত্র দু’মাস আগে জুলাই-আগস্টের যে দেশ কাঁপানো ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে পনের বছর জগদ্দল পাথরের মতো জেঁকে বসে থাকা হাসিনা সরকারের পতন ঘটলো, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দেশত্যাগ করতে বাধ্য হলেন- সেই আন্দোলনের শুরুর পর্যায়ে ছাত্ররা ‘চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’ বলে একটি স্লোগান দিয়েছিল। সেই স্লোগানটির শানে-নজুল হচ্ছে ১৪ই আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন ধরে তার মতো করে সাজানো এক ধরনের মেকি সংবাদ সম্মেলনগুলোর একটিতে তাঁবেদার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘সরকারি চাকরি মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা পাবে না তো কি রাজাকারের নাতি-নাতনিরা পাবে?’
সেই দিনই আমি প্রমাদ গুনেছিলাম যে, প্রধানমন্ত্রী অহেতুক নতুন করে বিভেদটি আরও উস্কে দিলেন; যার পরিণতি খারাপ হতে পারে এবং তৎক্ষণাৎ আমার ফেসবুক পোস্টে আশঙ্কাটি প্রকাশ করেছিলাম। আরও অনেকে এই মত প্রকাশ করেছিলেন। ছাত্র-তরুণরা শান্তিপূর্ণভাবেই আন্দোলন করছিল সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, যাতে নারী ও প্রান্তিক মানুষ ছাড়াও ১৯৭১-এর মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় প্রজন্ম পর্যন্ত ৩০ শতাংশ কোটা ছিল। অতি সহজেই আলাপ-আলোচনা করে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ২০১৮ থেকে চলে আসা এই আন্দোলনটির ন্যায্য মীমাংসা করা যেতো। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তার ক্ষমতার দম্ভ ও আত্মম্ভরিতা থেকে তা করেননি। তার দল আওয়ামী লীগও একই ব্যর্থতায় শামিল ছিল। যা হওয়ার তাই হয়েছে। সকলেই জানেন। ছাত্র-তরুণরা অপমানিত হয়েছে মনে করে সেই রাতেই ফুঁসে উঠে রাস্তায় নামলো বহু বিতর্কিত স্লোগান ‘আমি কে, তুমি কে? রাজাকার রাজাকার’ ধ্বনি নিয়ে। আওয়ামী লীগের লাঠিয়াল বাহিনী ছাত্রদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। এর ২৫তম দিনে পুলিশ ও অজ্ঞাতনামা সন্দেহভাজন বন্দুকধারীদের গুলিতে শত শত ছাত্র-মানুষের রক্তের স্রোতের মধ্যে ক্ষমতা ছেড়ে দেশত্যাগ করলেন। তার পনের বছরের নানা দুষ্কৃত ও অপশাসনের কারণে জনমনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের পটভূমিতে তার অনমনীয়তার জন্য এটা ছিল অনিবার্য।
আমার ব্যাখ্যায় ছাত্রদের রাজাকার স্লোগানটি ছিল অভিমানবশত ও ব্যঙ্গাত্মক। আমার সঙ্গে অনেকে একমত হননি। আমি এখনো আমার ব্যাখ্যাকে সঠিক মনে করি। ইতিহাসে ঝড়ের মতো কোনো বড় ঘটনার পরে ধুলি সরে না যাওয়া পর্যন্ত প্রকৃত বস্তু দেখা যায় না। গত দু’মাসে আপনা-আপনি দেখা যেতে শুরু করেছে। বোঝা যাচ্ছে ছাত্র-তরুণরা, যাদেরকে একটি বৈশ্বিক সংজ্ঞায় ১৯৯৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণকারী ইন্টারনেট প্রভাবিত প্রজন্ম বা জেন-জি বলে অভিহিত করছি তারা গণহারে অবশ্যই রাজাকার-মনস্ক হতে পারে না, কিন্তু কোটা থেকে সরকার পতন নিশ্চিত করা ঐ আন্দোলনের নেপথ্যে কিছু ডানপন্থি দলের ছাত্র সমর্থকও ছিল। তৎকালীন সরকারও তা বলেছিল, যদিও সময়মতো শনাক্ত করে জনগণ থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এখন আন্দোলনকারী, বহু ভাইবোনের মৃত্যুতে বিষণ্ন প্রজন্মের কাছে প্রশ্ন হিসেবে আসছে, আমরা কী চেয়েছিলাম, কী পাচ্ছি? যা পাচ্ছি তা কি আমরা চেয়েছিলাম? আমরা কি ভুল করে কিছু চেয়েছিলাম? জেন-জি তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই মনোভাব প্রকাশ করবে। তা প্রকাশ পাচ্ছে। এ যেন রবীন্দ্রনাথের ‘মরীচিকা’ কবিতার দুর্জ্ঞেয় উক্তি ‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না’! কবিতাটি প্রেমের কবিতা না মানবসভ্যতা ও মানবজীবন সম্পর্কে দার্শনিক জিজ্ঞাসা তা নিয়ে সাহিত্যে নিরন্তর আলোচনা।
সে আলোচনা চলুক। তা আমাদের আলোচ্য নয়। গত দু’মাসে একে একে নানা ঘটনা ঘটেছে, ঘটছে। বলা হচ্ছে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের, অনেকের ভাষায় বিপ্লবের বা নতুন বাংলাদেশের অঙ্গীকার ও আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কারের কাজ চলছে। সেটা ভালো। আকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু সে কাজের গতি যে খুব ধীর তা সকলেই দেখছেন। কমিশন প্রধানদের ঘোষণা দিয়ে তাতে রদবদল, কমিশনের সদস্য নির্বাচন ও অফিস স্থাপনে দীর্ঘসূত্রতা, সংস্কারের পরিধি, সময়সীমা ও নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় সম্পর্কে নীরবতা ইত্যাদি।
জুলাই-আগস্টের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানটি এমন বিদ্যুৎগতিতে এগিয়েছে এবং কোটা আন্দোলন থেকে অতিরিক্ত রক্তপাত ও ‘একদফা’ তথা সরকারের পতন পর্যন্ত ঘটিয়েছে যে, এই আন্দোলনের কোনো ঘোষিত রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছিল না। আন্দোলন পরিচালনাকারী, সবেমাত্র পয়লা জুলাই গঠিত ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামের প্ল্যাটফরমের সমন্বয়কদের দেয়া অল্প সময়ে দ্রুত পরিবর্তনশীল ৪-দফা, ৮-দফা ও ৯-দফার কোনোটিতেই কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্য বা কর্মসূচি, সংস্কারের দাবি কিছুই নেই। সেগুলো ছিল সরকারি আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিকার চাওয়া কিছু সাময়িক দাবি এবং ছাত্র-জনতার জন্য বিক্ষোভ প্রভৃতি আন্দোলনের বাস্তব পদক্ষেপ সংক্রান্ত নির্দেশনা। একমাত্র একদফাই ছিল রাজনৈতিক দাবি তথা প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ। এই পদত্যাগের পরে রাজনৈতিক পদক্ষেপ কী হবে, দেশ কোন্্দিকে যাবে তা তারা ঘোষণা করেননি। তখনকার ‘বৈষম্যবিরোধী’ ধারণাটি ছিল সরকারি চাকরিতে ‘মেধাবী’ বনাম বিশেষত মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান নামে ‘কোটায় অন্তর্ভুক্তদের’ বৈষম্যের অবসান, সকলের সমান সুযোগ। যেহেতু সমাজে যুগ যুগ ধরে ধনবৈষম্য, শ্রেণিবৈষম্য, নিপীড়ন, বঞ্চনা, অবিচার, সুযোগের অসমতা প্রভৃতি রয়েছে এবং শেখ হাসিনার শাসনে সেগুলো তীব্রতর হয়েছে তাই বৈষম্যহীনতার ডাকে আপামর জনতা অকাতরে সাড়া দিয়েছে। এই আর্থ-সামাজিক বৈষম্য কমিয়ে আনতে যদি ধীরস্থিরভাবে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে জনগণ দেখে তাহলে অবশ্যই ধৈর্য ধরবে ও মেনে নেবে। কিন্তু জনগণের এই চাওয়া কি পাওয়া যাচ্ছে?
সংস্কারের লক্ষ্য স্পষ্ট না করা হলেও একটি কথা বলা হচ্ছে যে, আর যেন ‘ফ্যাসিবাদ’ বা অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসন ফিরে না আসতে পারে সেই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা করা। এর পক্ষে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা অনস্বীকার্য। শেখ হাসিনা তিন তিনটি জাতীয় নির্বাচনে জনগণকে মহা ধাপ্পা দিয়েছিলেন। এটা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। কাজেই নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করা যেন জনগণ ভোট দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে সরকার বদল করতে পারে, প্রধানমন্ত্রীর হাতে সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত না হওয়ার মতো সংবিধানে ভারসাম্য তৈরি, একাধারে দু’বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকার বিধান, সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী একজন না হওয়া, নির্বাচনে টাকার খেলা ও সন্ত্রাস বন্ধ এবং জনপ্রতিনিধিত্বের বিস্তার ঘটানোর জন্য আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন প্রভৃতি সংস্কার জনগণের কাছে সরলভাবে বোধগম্য, সমর্থনযোগ্য ও বাস্তবায়নযোগ্য। কিন্তু এই সিরাতুল মুস্তাকিম বা সরল পথের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক কথা বলা হচ্ছে। জনগণকে না জানিয়ে তথা রাজনৈতিক সংলাপ না করে অন্তর্বর্তী সরকার এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়ে নিচ্ছেন যা জনগণের মধ্যে বিস্ময় ও প্রশ্নের উদ্রেক করছে যে, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও সারবস্তুকে অপসারণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হচ্ছে কেন? এর সঙ্গে গণতন্ত্র ও সুশাসনের সম্পর্ক কী? বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্যে এই নিবন্ধের পরিসরে সরকারের অতি সামপ্রতিকতম একটি সিদ্ধান্ত ও একটি বক্তব্যের উল্লেখ করতে চাই।
বুধবার ১৬ই অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক আদেশে জাতীয় দিবস হিসেবে চালু ৮টি দিবস উদ্যাপন বা পালন না করার তথা বাতিলের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। এই দিবসগুলোর মধ্যে কয়েকটি রয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুই ভাই ও মায়ের জন্মদিন বা সরকারি কর্মসূচি স্মার্ট বাংলাদেশ ধরনের যেগুলো তার বাড়াবাড়ির পর্যায়ের ও যুক্তিহীন। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে উদ্ভূত জাতীয় স্বাধীনতার গতিপথ নির্ধারণকারী ৭ই মার্চ, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দিন ১৫ই আগস্ট, রাষ্ট্রের সংবিধান প্রবর্তনের দিন ৪ঠা নভেম্বর যা অন্যান্য অনেক দেশের মতো প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে পালনের পক্ষে অভিমত রয়েছে তা বাতিলের সিদ্ধান্তে মনে হতেই পারে যে অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় স্বাধীনতার ঐতিহাসিক পথরেখা ও স্মারকগুলো মুছে ফেলতে চায়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ ইউনেস্কোর বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়েছে। এর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ই মার্চকে জাতীয় শিশু দিবস রূপে পালনও গণ্য করা যেতে পারে, যেমন নজির অন্য দেশেও আছে।
এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার সময় সরকারের একজন উপদেষ্টা, ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, এই সরকার বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা বলে মনে করে না।
বঙ্গবন্ধুর অবস্থান জাতির জন্য তার সংগ্রামের মধ্যদিয়ে ঐতিহাসিকভাবেই অর্জিত হয়েছে এবং এখন সংবিধানে রয়েছে। এই ‘মনে করা’ বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারের মৌলিক রাজনৈতিক অবস্থান হিসেবেই ব্যক্ত হলো যার এখতিয়ার তাদের আছে কি না তা বিবেচ্য। নাহিদ ইসলাম বাংলাদেশের জন্য অন্য নেতাদের অবদানের উল্লেখ করে অনেক দেশে ফাউন্ডিং ফাদার্সের ধারণা স্মরণ করিয়েছেন। প্রতিটি দেশেরই ইতিহাস ভিন্ন ভিন্ন। তিনি প্রাসঙ্গিকভাবে যে নেতাদের নামোল্লেখ করেছেন তাতে বঙ্গবন্ধু ও ৯ মাস বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ নেই। কাজেই এই সরকারের মনোভাব অধিক ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই।
আমরা শুধু এটুকু আবেদন জানাবো, যেন অন্তর্বর্তী সরকার এমন কোনো সিদ্ধান্ত না নেন যা জাতীয় ঐক্যের বিনাশ ঘটায় ও জাতির জন্য আত্মঘাতী হয়।