সা ম্প্র তি ক

যে সংস্কার সবচেয়ে বেশি জরুরি

মোজাম্মেল হোসেন | মতামত
নভেম্বর ২৩, ২০২৪
যে সংস্কার সবচেয়ে বেশি জরুরি

আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা তীব্র ছাত্র গণআন্দোলনে তার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার এক বছর আগে, অর্থাৎ ৭ই জানুয়ারি ২০২৪-এর কুখ্যাত ‘ডামি নির্বাচন’ অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে একাধিকবার একটি উক্তি করেছিলেন যে, বিএনপি সভা-সমাবেশ-আন্দোলনে খরচ করার ‘এত টাকা কোথায় পায়?’ সংবাদমাধ্যমের পুরনো খবর ঘেঁটে পেলাম অন্তত দুইবার তিনি জনসমক্ষে এই প্রশ্ন তুলেছেন। প্রথমবার ২০২৩ সালের পয়লা আগস্ট ফার্মগেটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে কৃষক লীগের রক্তদান অনুষ্ঠানের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে। দ্বিতীয়বার ভারতে জি-২০ সম্মেলনে যোগদান ও জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিয়ে এসে সে বিষয়ে বলতে গণভবনে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে। 
ঐ বক্তব্য বিস্ময় ও কৌতুক উদ্রেককারী। কারণ একই প্রশ্ন যদি আওয়ামী লীগকে করা যায়? আওয়ামী লীগ তো দল চালাতে বিএনপিসহ অন্য দলগুলোর চেয়ে দৃশ্যত অনেক বেশি খরচ করেছে। জনগণ কি এই টাকার উৎস জানে? নির্বাচন কমিশন কি জানে?


কতোখানি কৌতুকের বিষয় যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ঐ সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, “সাংবাদিকদের অনুরোধ করবো, এই যে তাদের টাকার উৎস কোথা থেকে। সেটা একটু খবর নেয়া দরকার। তারা এত টাকা কোথা থেকে পায়? আওয়ামী লীগের তো একটা সুবিধা আছে যে, নিজের খাইয়া নৌকা। কিন্তু তাদের তো সেটা নেই।” (বিডিনিউজ ২৪.কম, ৬ই অক্টোবর, ২০২৩)।
বুঝুন। আওয়ামী লীগ নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে দল চালায়! শেখ হাসিনার ঐ বক্তব্যের পরে আমি ফেসবুকে কিছু কথা লিখে একটি নাতিদীর্ঘ পোস্ট দিয়েছিলাম ‘বিএনপি এত টাকা  কোথায় পায়? রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয় স্বচ্ছ হোক’ শিরোনামে। সেই পোস্টটির মূল অংশ উদ্ধৃত করেই আজকের আলোচনাটা পাড়লে বিষয়বস্তু তুলে ধরা আমার জন্য সহজ কবে। লিখেছিলাম, “...আমার মনে প্রথমেই এই প্রশ্ন এসেছে যে, বিএনপি’র অর্থের উৎস সন্ধানের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের দিলেন কেন? বিএনপি এই দেশের রাজনৈতিক দল, নেতারা এই দেশের নাগরিক। তারা যদি অজ্ঞাত উৎস থেকে অগাধ টাকা পায় ও খরচ করে তাহলে তা তো আইনগতভাবে সরকারি সংস্থাগুলোই তদন্ত করতে পারে এবং তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারে। এটা অবশ্যই করা উচিত, কারণ অজ্ঞাত উৎসের বিপুল পরিমাণ টাকার চলাচল, যাদের হাত দিয়েই হোক, জাতীয় নিরাপত্তাকেও বিঘ্নিত করতে পারে।  সরকারি সংস্থা ছাড়া নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি’র আয়-ব্যয়ের বিষয় নির্বাচন কমিশন দেখতে পারে। 


“এবার আসি যে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হতে পারে সে বিষয়ে। রাজনৈতিক দল দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। ? এর সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যদিয়ে দেশের শাসকরা নির্বাচিত হন। তারা দেশ চালান। রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতিটি টাকার হিসাব বাজেট ও নিরীক্ষা পদ্ধতির আওতাধীন। নাগরিকদের বার্ষিক আয়কর রিটার্ন দিতে হয়। প্রয়োজনে সম্পত্তির হিসাব ও আয়ের উৎস জানাতে হয়। সকল শিল্প-বাণিজ্য ও সেবা প্রতিষ্ঠানকে নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের কাছে নিবন্ধিত হতে হয়। এজন্য বিস্তারিত আইন-কানুন-বিধিমালা রয়েছে। তাহলে রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয়ের হিসাব স্বচ্ছভাবে রাখা ও নিরীক্ষার অধীন করা হবে না  কেন? নির্বাচন কমিশনে বার্ষিক ও প্রার্থীর নির্বাচনে ব্যয়ের হিসাব  দেয়ার যে নিয়ম আছে তা পালন করা হয় খুব শিথিলভাবে, নামকাওয়াস্তে। এবং কোনোরকম পরীক্ষা বা যাচাই করা হয় না। মিথ্যা তথ্য দেয়ার সুযোগ আছে। 


“রাজনৈতিক দল চালাতে টাকা লাগে। সদস্যদের চাঁদা, সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদের অনুদান, দলের পরিচালিত ব্যবসা ও ব্যাংকে রাখা তহবিল প্রভৃতি দলের আয়ের উৎস। বড় একটি আয় হলো ব্যবসায়ী ও ধনীদের কাছ থেকে পাওয়া ও চাপ দিয়ে নেয়া চাঁদার অর্থ। মানুষের ব্যাপক ধারণা আছে যে বিদেশ থেকেও টাকা আসে যা গোপন ও অস্বচ্ছ। রাজনৈতিক দলের তহবিল হিসাবের বাইরে রাখা ও অস্বচ্ছতা বিপজ্জনক। এটিকে স্বচ্ছতার মধ্যে আনা উচিত। আমি একেবারে আজগুবি কথা বলছি না। পশ্চিমের উন্নত গণতন্ত্রের  দেশগুলোতে রাজনৈতিক দলের হিসাব প্রকাশ্য, স্বচ্ছ ও নিরীক্ষিত।  কোন ধনী ব্যক্তি কোন দলের সমর্থক তা তারা জানিয়েই চাঁদা  দেন, নির্বাচনপ্রার্থীকে প্রকাশ্যেই অর্থ সাহায্য করেন, গোপনে নয়। নিরীক্ষা বা অডিটও বাধ্যতামূলক। আমাদের দেশে ব্যবসায়ীরা পরস্পরবিরোধী একাধিক রাজনৈতিক দলকেও চাঁদা দেন গোপনে। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলের আদর্শ ও কর্মসূচিকে সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ নয়, ক্ষমতায় গেলে ওই দলের কাছ থেকে সুবিধা নেয়ার আকাঙ্ক্ষাই বড়। এগুলো তো অনুচিত ও ক্ষতিকর, অর্থাৎ দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টির সহায়ক। তহবিল সংগ্রহের অস্বচ্ছতা রাজনৈতিক দলের কর্মীদেরও দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলে। এ থেকে বেরিয়ে আসা, রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয় ও তহবিল ব্যবহারের স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় ও সামাজিক পরিসরে আলোচনা শুরু করা উচিত।”


এখন আসি বর্তমানে। এই ভাবনা যখন ফেসবুকে পোস্ট করেছি তখন রাজনৈতিক দলের ভেতরের গলদ দূর করার মতো এমন চিন্তার প্রসার ঘটানো বা উদ্যোগ নেয়ার মতো কোনো বাস্তব অবস্থাই ছিল না। পনের বছর ধরে শেখ হাসিনার একচ্ছত্র ক্ষমতার দমবন্ধ করা শাসন চলছিল। কারও কোনো কথাই শাসকদের কান পর্যন্ত পৌঁছাতো না এবং তারা কোনো কিছুরই মানে কোনোরকম জবাবদিহিরই তোয়াক্কা করতেন না। ৫ই আগস্ট ২০২৪ তারিখে হাসিনা সরকারের পতনের মধ্যদিয়ে ঐ জগদ্দল পাথর নেমে যাওয়ার ফলে এক বিরাট রাজনৈতিক পরিবর্তিত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। এখন অনেকগুলো বিষয়ে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। নির্বাচন ব্যবস্থা, সংবিধান, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, পুলিশি ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন প্রভৃতি ক্ষেত্রে কমিশন গঠন করে সংস্কারের প্রস্তাব তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। কমিশনগুলো ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে। অনেক বড় পরিসরে এই সংস্কারের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে, যার কতোটা সম্ভব, নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অরাজনৈতিক, সুস্পষ্ট সাংবিধানিক অনুমোদনহীন অন্তর্বর্তী সরকারের সে এখতিয়ার আছে কি-না, তারা পারবেন কি-না ইত্যাদি নানা তর্ক-বিতর্কের মধ্যে কাজটা চালিয়ে নেয়া হচ্ছে। সংস্কারের পরিধি ও গভীরতা যা-ই হোক, সকল ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানে যখন মরিচা ধরেছে তখন সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই আছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলের যে সংস্কার প্রয়োজন সে বিষয়ে বিস্ময়করভাবে আলোচনা কম এবং কোনো কমিশনও গঠিত হয়নি। তবে আশা করা যায়- নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে যে কমিশন কাজ করছে  সেখানে রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয় প্রস্তাব করা হবে। রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের হাতে ন্যস্ত। 


কিন্তু বিষয়টির দিকে তাকালে আমরা দেখবো যে রাজনৈতিক দলের শুধু নিয়ম-বিধি নয়, রাজনৈতিক সংস্কৃতি তথা রাজনৈতিক দলের ব্যবহারিক দিক, আচার-আচরণে বড় ধরনের পরিশীলন ও সংস্কার দরকার। রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান উপাদান। সাংবিধানিক আইন অনুযায়ী রাজনৈতিক দলের মনোনয়নে ব্যক্তি নির্বাচনপ্রার্থী হয়ে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ও তাদের মধ্য থেকে জনগণের বেছে নেয়া সংসদ সদস্যরাই সরকার গঠন করেন। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কী হতে পারে? শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের যে পনের বছরের স্বৈরাচারী অসভ্য শাসনের ইতি ঘটানো হলো তার গোড়ায় রয়েছে ভোটাভুটির নিরপেক্ষতা তথা নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়ে তিন তিনটি জাতীয় নির্বাচনে জবরদস্তি ক্ষমতা দখল। তা থেকে সবরকম স্বেচ্ছাচারিতা আওয়ামী লীগের জন্য অনুমোদন করা হয়। আমরা যে নির্বাচন কমিশনকে পক্ষপাতদুষ্ট বলি, প্রশাসন ও পুলিশকে দলবাজ বলি এবং এই জন্য সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি বলে মনে করি, তা কতোটুকু সঠিক? কমিশন ও পুলিশ-প্রশাসন সবকিছুকে দলীয়করণ করা কি ক্ষমতাসীন দলের কাজ নয়? ক্ষমতাসীন দল চাইলেই নির্বাচন সঠিকভাবে হতো- এটাই হচ্ছে সত্যের শতকরা ৮০ ভাগ। আর ২০ ভাগ দোষ অন্য সকল প্রতিষ্ঠানের। আর সেই রাজনৈতিক দলকেই আমরা স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ দিয়ে রেখেছি। তারা যথেচ্ছ চাঁদাবজি করতে পারে, তারা দলের ভেতরে কোনো গণতন্ত্রের চর্চা করবে না, সংগঠনের সকল স্তরে নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি তৈরি করবে না, নির্বাচনের প্রার্থী মনোনয়নে স্থানীয় সংগঠনের কোনো ভূমিকা ছাড়া কেন্দ্রে বসে শীর্ষ নেতা মনোনয়ন বাণিজ্য করবেন আর আমরা জাতীয় ক্ষেত্রে গণতন্ত্র পেয়ে যাবো? এটা আমরা কীভাবে আশা করতে পারি? তাই রাজনৈতিক দলের সংস্কার খুব বেশি প্রয়োজন। এবং তার প্রধান দু’টি ক্ষেত্র হলো দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র এবং আয়-ব্যয়ের হিসাবের স্বচ্ছতা। 

মতামত'র অন্যান্য খবর