প র্যা লো চ না

আইজুদ্দিন কী আবার দেয়ালে ফিরবে

লুৎফর রহমান | মতামত
জানুয়ারী ১৮, ২০২৫
আইজুদ্দিন কী আবার দেয়ালে ফিরবে

নব্বই-এর দশকে দেয়ালে দেয়ালে লেখা ‘কষ্টে আছি আইজুদ্দিন’ ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। মুন্সীগঞ্জের এই আইজুদ্দিন দেয়ালে লিখে তার কষ্টের বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। পরে এই দেয়াল লিখনের এ বাক্য তিনটি জনপ্রিয় হয়ে উঠে মানুষের কাছে। নানা কিসিমের কষ্টের প্রকাশ করতে মানুষ জুড়ে দেয় এই তিন বাক্য। এত বছরে আইজুদ্দিনের কষ্টের অবসান হয়েছে কিনা তা অজানা। তবে এই দেশের কয়েক কোটি মানুষ এখন আইজুদ্দিনের কাতারে। তাদের কষ্টের কথা দেয়ালে লিখা না হলেও বাতাসে ভাসছে। রাজনীতির দৈন্যদশা আর লুটপাটতন্ত্রের কারণে দিনের পর দিন ধুঁকতে থাকা আইজুদ্দিনদের কষ্ট লাগবের চেষ্টা খুব একটা হচ্ছে না। বরং এক কষ্ট থেকে আরও বহু কষ্টের রাস্তা তৈরি হচ্ছে।  
জুলাই-আগস্ট বিপ্লব সাধারণ মানুষের কাছে সীমাহীন প্রত্যাশা তৈরি করেছিল। অতীতের লুটপাটতন্ত্র থেকে মুক্তি মিলবে। নিত্যপণ্যের বাড়তি দামে পিষ্ট হওয়া পরিস্থিতি থেকে মুক্তি মিলবে। সরকারি দপ্তরে কাজ করতে গিয়ে ঘুষ দিতে হবে না। চাওয়া মাত্র সেবা মিলবে। রাজনৈতিক দলের দখল ও চাঁদাবাজির পাঠ চুকে যাবে। রাজনৈতিক জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হবে। রাষ্ট্রে মানুষের মানবিক অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা হবে। 


কিন্তু এসব চাওয়া কি পূর্ণ হয়েছে? না! বরং চারদিকে হতাশা। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার পুরনো হতে চলেছে। সঙ্গে মানুষের প্রত্যাশার রং ফিকে হয়ে আসছে। মাফিয়া চক্রের প্রশাসন এখনো প্রায় আগের মতোই চলছে। নিজেদের সুবিধা আদায়ের প্রতিযোগিতা সর্বত্র। সুযোগ বুঝে নিজেদেরটা আদায় করে নেয়ার পুরনো কৌশলে একটুও বদল হয়নি। ফলে বোঝা ভারী হচ্ছে আইজুদ্দিনদের মাথায়। 


সরকার পরিবর্তন হলেও মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা যায়নি। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সব শ্রেণি- পেশার মানুষের কষ্ট বেড়েছে। জীবনযাপন কঠিন হয়ে উঠেছে। এই কষ্ট মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের বেশি। সরকারি চাকরিজীবীরাও এর বাইরে নেই। এই সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কষ্ট দূর করার দায়িত্ব সরকারের। 


কিন্তু আমরা কি দেখলাম? সরকারি কর্মচারীদের কষ্ট বিবেচনায় নিয়েছে সরকার। তাদের জন্য মহার্ঘ ভাতা দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগামী অর্থবছর থেকেই এই ভাতা যুক্ত হতে পারে এমন পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ১০ থেকে ২০ শতাংশ হারে এই ভাতা দিতে সাত থেকে আট হাজার কোটি টাকা জোগাড় করতে হবে সরকারকে। এই টাকা কোথা থেকে আসবে? কারা জোগাড় করবে? 
উত্তর একটাই, জনগণের কাছ থেকেই আসবে। কষ্টে থাকা আইজুদ্দিন ধাঁচের লোকজনরাই এই টাকা  দেবে। এই টাকা জোগাড়ের সহজ কৌশলটা হলো ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানো। এই সহজ পথেই সরকার হাঁটছে। অর্থবছরের মাঝপথে ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়িয়ে অধ্যাদেশ জারি করা হলো। প্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের, সেবার উপর ভ্যাট বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের জীবনধারণের ব্যয় নতুন করে বাড়তে চলেছে। প্রয়োজনে একবেলা রেস্তরাঁয় খেতে যাওয়া মানুষটির জন্য দুঃসংবাদ হয়ে এসেছে বাড়তি ভ্যাট। হোটেলে বসে এক কাপ চা খেতেও গুনতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ। আপনার হাতে থাকা অতি প্রয়োজনীয় সেল ফোনটি সচল রাখতে গুনতে হবে বাড়তি অর্থ। পাড়ার টং দোকানে বিমর্ষ আলোচনা এই ভ্যাট নিয়ে। সেখানে যারা যায় তাদেরও নাকি কষ্ট বেড়েছে! 
শুধু কী ভ্যাট বেড়েছে। এই ভর মওসুমে চালের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। অন্যদিকে কম আয়ের মানুষদের কম দামে টিসিবি’র মাধ্যমে যে চাল দেয়া হতো তাও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে কম আয় দিয়ে জীবনধারণে নানা  কৌশল খুঁজে নিয়েছে মানুষ। এই কৌশল খোঁজা এখনো চলছে। খাবারের তালিকা ছোট হচ্ছে। কেউ শহর ছেড়ে গ্রামে যাচ্ছেন, কেউ গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হচ্ছেন।  কৌশল বদল হলেও স্বস্তি মিলছে না। মানুষের স্বস্তির জন্য সরকারের তরফে বড় উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন ছিল। অন্তত আশা দেখাতে পারলেও মানুষ ভরসা পেতো। কিন্তু সময় বদলে সেই ভরসার জায়গা ক্ষীণ হয়ে আসছে। নতুন করে ভ্যাট-ট্যাক্স আরোপ মানুষকে বরং দুর্ভাবনায় ফেলেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও প্রথাগত সরকারের পথেই হাঁটছে- এমনটা ধারণা করতে শুরু করেছে মানুষ। এ কারণে বিশ্বাস আর ভরসার জায়গা ছোট হয়ে আসছে। 


জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের আগের আওয়ামী লীগ সরকারও জনমুখী বলে দাবি করতো। মানুষের জন্য সরকার সবকিছু করছে- তা বলে বেড়াতো। আদতে তারা লুটপাটতন্ত্র কায়েম করেছিল। সরকারি কোষাগারে টান পড়লেই মানুষের পকেটে হাত দিতে দ্বিধা করতো না। ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়াতে কারও বুক কাঁপতো না। ১০ টাকা ভ্যাট বাড়িয়ে আবার জনস্বার্থের কথা বলে মায়াকান্না দেখিয়ে দুই টাকা কমানোর ঘোষণা দেয়া হতো। এতে আবার কেউ কেউ বাহবা দিতেন। প্রশংসা করতেন। লুটপাট করে লাখ কোটি টাকা পাচার করে একদল অলিগার্ক অনেকটা মগের মুল্লুক তৈরি করেছিল। ব্যাংকগুলো তাদের নিজস্ব পকেট হয়ে উঠেছিল। রাষ্ট্রীয় অর্থের সীমাহীন লুটপাটতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এই লুটপাটের বড় সহযোগী ছিল প্রশাসন। রাতে ভোট করে সরকার টিকিয়ে রাখতে, ডাণ্ডা মেরে মানুষকে ঠাণ্ডা করে রাখতে প্রশাসন ও পুলিশ যে ভূমিকা পালন করেছিল তাতে মানুষের মনে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো ক্ষোভের লাভা তৈরি হয়েছিল। জুলাই-আগস্টে সেই ক্ষোভের লাভা প্রতিবাদী ঝড় হয়ে এসেছিল। ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র। যেই ক্ষোভ থেকেই একটি চরম কর্তৃত্ববাদী শাসন কর্পূরের মতো উড়ে গেছে। 
জুলাই-আগস্টের বিপ্লব মানুষকে ফের আশাবাদী করে তুলেছিল। নতুন আশা নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল। ফ্যাসিবাদী শক্তির গুলির সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের শক্তি আর সাহসের জানান দিয়েছিল। 


কিন্তু সেই লাল বিপ্লবের পর এখন যে অবস্থা চলছে সেটি হয়তো বিপ্লবীদের চিন্তায় ছিল না। 
যেই মানুষের রক্তের উপর ভর করে ফ্যাসিবাদ দূর হয়েছে সেই মানুষকে চাপে ফেলে সরকার কেন শতাধিক পণ্য ও সেবায় শুল্ক কর বাড়িয়ে ১২ হাজার কোটি টাকা জোগাড় করতে চাইছে তা অনেকের বোধে আসছে না। জনরোষের কথা চিন্তা করে সরকার অবশ্য কয়েকটি পণ্য ও সেবায় ভ্যাট পুনর্বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছে। হয়তো কয়েকটি পণ্য ও সেবায় ভ্যাট আগেরটাই থাকবে। সরকারের পক্ষ থেকে বার বার বলা হচ্ছে নতুন করে ভ্যাট মানুষের জীবনে খুব একটা প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু অর্থনীতির নিচের ক্লাসের ছাত্ররাও এই যুক্তি মানতে চাইছেন না। এত গেল মানুষের জীবন- জীবিকার কষ্টের কথা। 


সিভিল প্রশাসন নিয়ে মানুষের ক্ষোভ কী কমেছে। উত্তর হবে নিশ্চয় না। গত কয়েক মাসে প্রশাসনে যে অস্থিরতা চলে আসছে তা এখনো বিদ্যমান। সেবার চিত্র একটুও বদলায়নি। বরং অনেক ক্ষেত্রে সরকারকে জিম্মি করে, মানুষকে জিম্মি করে দাবি আদায়ের চেষ্টা হচ্ছে দফায় দফায়। বঞ্চিতের জিকির তুলে পদোন্নতি, সুযোগ- সুবিধা আদায় করে নেয়া হচ্ছে। মহার্ঘ ভাতা আদায়ের যে আয়োজন সেটিও এমন একটি উদ্যোগ বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ সরকার পরিবর্তনের পর যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দেশের অর্থনীতির হাল কেমন তা সাধারণ মানুষের চেয়ে সরকারি কর্মচারীদের বেশি অনুধাবন করার কথা। সেটি অনুধাবন করেও সুযোগ-সুবিধা আদায়ের প্রতিযোগিতা বলে দেয় প্রশাসন একটুও বদলায়নি। সাধারণ মানুষের কষ্ট ও দুর্দশা কারও মনে দাগ কাটে না। 
ভ্যাট-ট্যাক্সের সঙ্গে নগরে থাকা মানুষের জন্য আরও নানা সমস্যা  তৈরি হচ্ছে একের পর এক। বলা হচ্ছে আবাসিক সংযোগে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। শিল্প খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। রাজধানীর বাসিন্দারা শীত আসলেই গ্যাস নিয়ে ভুগতে থাকেন। দিনের রান্না রাতে করতে হয়। তিতাসকে গ্যাসের বিল দেয়ার সঙ্গে বাড়তি জ্বালানি কিনতে হয়। বাইরে থেকে খাবার কিনতে বাড়তি খরচ করতে হয়। 
সামনে বিদ্যুতের দামে বাড়বে না- এমনটাও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। 
সংস্কার আর নির্বাচন নিয়ে চারপাশে এত আওয়াজের মাঝে মানুষের এই দুর্দশা লাঘবে কোনো চিন্তা হচ্ছে কিনা তা আমরা জানতে পারছি না। বলা হচ্ছে আগামী অর্থবছরের জন্য সাড়ে আট লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রণয়নের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এই বাজেট প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের জন্য নিশ্চয়ই নতুন করে ভ্যাট-ট্যাক্সের আওতা বাড়ানো হবে। নতুন নতুন খাতে ভ্যাট যুক্ত হবে। আর সেই বাড়তি টাকা সাধারণ মানুষকেই যোগান দিতে হবে নিজের প্রয়োজনের তালিকা সংক্ষিপ্ত করে। নিজেদের খাবারের তালিকা আরও ছোট করে। 
আর এভাবে অতীতের তরিকা ধরে সরকার এবং প্রশাসন চলতে থাকলে সামনে মানুষের ক্ষোভ যে আবার সড়কে গড়াবে না, আইজুদ্দিনরা আবার তাদের কষ্টের কথা দেয়ালে লিখতে শুরু করবে না- তার নিশ্চয়তা কী কেউ দিতে পারবে? 

মতামত'র অন্যান্য খবর