এটা খুবই ভালো খবর যে, সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলোর মধ্যে চারটি কমিশন তাদের রিপোর্ট প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করতে পেরেছে। একেবারে শুরুতে যে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছিল, সেগুলোই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেই ছয়টির চারটির রিপোর্ট পাওয়া গেল। আশা করা যায় বাকি দু’টিও দ্রুতই পাওয়া যাবে।
সেভাবে যদি বলি, আমার বিবেচনায় গত প্রায় অর্ধবছরে ড. ইউনূস সরকারের এটা একটা বড় কাজ। এটি তাদের কাছ থেকে আমাদের একটা বড় প্রাপ্তি। রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থায় যে সংস্কারের কথা শুরু থেকেই বলা হচ্ছিল, জনগণের মধ্যেও যে সংস্কারপ্রত্যাশা জন্ম নিয়েছিল, সেই পথে এটা একটা বড় পদক্ষেপ।
এর মধ্যে বিভিন্ন মিডিয়াতে যতটুকু প্রকাশিত হয়েছে, সংস্কার প্রস্তাবগুলো একেবারে মন্দ নয়। কিছু কিছু বিষয় নিয়ে হয়তো বিতর্ক হবে, বেশ বড় বিতর্কই হয়তো দেখা দেবে, তারপরও যেহেতু এইসব প্রস্তাবই চূড়ান্ত কিছু নয়, তাই আশা করা যায় সেই বিতর্ক থেকেও হয়তো ভালো কিছু বের হয়ে আসবে। সামনে অনেক কিছুই নির্ভর করবে রাজনৈতিক দল বা সরকার- কোন পক্ষের কতোটুকু ছাড় দেয়ার মানসিকতা আছে তার উপর।
এরই মধ্যে জানা গেছে, ফেব্রুয়ারি থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসবে সরকার। তাদের সঙ্গে বসে আলোচনা করবে এই সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে। কে কোন কোন প্রস্তাবের সঙ্গে একমত, অথবা কোন কোন বিষয়ে কার কার বিকল্প প্রস্তাব আছে-সেসব নিয়েই আলোচনা হবে। যতগুলো বিষয়ে সকলে একমত হবে, সেগুলোই কেবল গ্রহণ করা হবে সংস্কারের জন্য। গৃহীত সেসব প্রস্তাবের বিষয়ে সকল দলের মধ্যে ঐকমত্য হবে। হয়তো এ বিষয়ে একটা দলিলও স্বাক্ষরিত হবে, যেন তারা ক্ষমতায় যাওয়ার পর এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন।
আপাতদৃষ্টিতে এমন ঐকমত্যকে অনেকের কাছে বেশ জটিল ও প্রায় অসম্ভব মনে হলেও আমার কিন্তু তা মনে হয় না। আমার ধারণা-সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে বিতর্ক তেমন একটা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত নির্বাচন চায়। তারা জানে, সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে যত বেশি বিতর্ক হবে, সময় লাগবে, ততই পিছিয়ে যাবে নির্বাচন। তাই ধারণা করি, যার মনেই যা থাকুক না কেন, এ আলোচনা বা বিতর্কে কেউ লম্বা সময় নেবে না।
এই আলোচনায় যদি বেশি সময় না লাগে, তাহলে নির্বাচন কী দ্রুত হবে? হলে কতোটা দ্রুত? নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সেই বক্তব্যটি নিশ্চয়ই মনে আছে। তিনি বলেছিলেন রাজনৈতিক দলগুলো যদি চাপ দেয় তাহলে মিনিমাম সংস্কার করে ২০২৫ সালের শেষ দিকেই তিনি নির্বাচন দিয়ে দেবেন। আর যদি তাকে তার প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার করতে দেয়া হয়, তাহলে নির্বাচন করতে আগামী বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ‘প্রত্যাশিত মাত্রা’ বলতে আমরা কী বুঝবো? কার প্রত্যাশা? জনগণের, রাজনৈতিক দলগুলোর নাকি খোদ ড. ইউনূসের? নাকি যারা একটা ‘শক্তিশালী’ কিংস পার্টি করার স্বপ্ন দেখছেন তাদের? এই কোনো একটি প্রত্যাশার সঙ্গে কিন্তু অপরটির মিল হবে না।
প্রত্যাশার এত ভিন্নতার পরও কিন্তু আমার মনে হয়, এ বছরের মধ্যেই নির্বাচন হওয়া সম্ভব। বিএনপি এরই মধ্যে দাবি তুলেছে, তারা এ বছরের মাঝামাঝির মধ্যে নির্বাচন চায়। জামায়াতও নির্বাচন চায় ২০২৫ সালের মধ্যে। আমার তো মনে হয় রাজনৈতিক দলগুলোর এমন চাহিদার মধ্যে তেমন কিছু ভুল নেই। প্রত্যাশিত সংস্কার করেও এ বছরের মধ্যেই নির্বাচন দেয়া সম্ভব।
বিষয়টা নিয়ে আমি বরং একটু ডিটেইলে বলি। যেভাবে চলছে- আশা করা যায়, এ মাসের মধ্যেই সবক’টি সংস্কার প্রস্তাব চলে আসবে। অন্ততপক্ষে প্রথম যে ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়েছিল, সেগুলোর রিপোর্ট অবশ্যই আসবে। সেক্ষেত্রে ফেব্রুয়ারির প্রথম থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করলে সেটা কতোদিন লাগতে পারে? আগেই বলেছি, দেখবেন-এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর খুবই ইতিবাচক মনোভাব। কারণ তারা দ্রুত নির্বাচন চায়, তাই এই আলোচনা নিয়ে তারা সময়ক্ষেপণ করতে চাইবে না। তাহলে দুই মাসের মধ্যে আলোচনা শেষ হয়ে যেতে পারে। ঠিক আছে, গ্রেস পিরিয়ড হিসেবে না হয় আরও একমাস ধরলাম। তিন মাসে আলোচনা শেষ। অর্থাৎ এপ্রিল মাসের মধ্যেই আলোচনা, বিতর্ক, সমঝোতা সব হয়ে যাবে। এরপর আর কী করার বাকি থাকবে? ড্রাফটিং, সমঝোতা চুক্তি-এসবের জন্য আরও একমাস না হয় দেয়া গেল। তাহলে মে মাস, ততদিনে সব শেষ। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনের পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী মার্চ মাসের মধ্যে নতুন ভোটার তালিকাও শেষ হয়ে যাবে। তাহলে জুন মাসের শুরু থেকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কথা চিন্তা করা যেতে পারে। এরপর তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব। অর্থাৎ সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মধ্যে নির্বাচন হতেই পারে। আংশিক সংস্কার নয়, প্রত্যাশিত সংস্কার করেই নির্বাচন হতে পারে।
আমার ধারণা, প্রধান উপদেষ্টা এর আগে যে টাইম লাইনের কথা বলেছেন, যদি তার সঙ্গে আমার এই হিসাবটা একটু বিবেচনায় নেন, তাহলে বুঝতে পারবেন, আসলেই আরও দেড় বছর অপেক্ষা করার কোনো দরকার নেই। তাছাড়া ধারণা করি, এরই মধ্যে নিশ্চয়ই তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন, যে প্রত্যাশা নিয়ে জনগণ তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল, সেই প্রত্যাশা এখন অনেকটাই ঝাপসা হয়ে এসেছে। উনি আসলে দেশ খুব ভালোভাবে চালাতে পারছেন না। মানুষ হতাশ। এই হতাশা বিরক্তিতে পরিণত হওয়ার আগেই যদি একটা ভালো নির্বাচন দিতে পারেন, নির্বাচিতদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যেতে পারেন, তাহলে হয়তো তার এতদিনের অর্জিত সম্মান এই জাতি আরও অনেকদিন উচ্চারণ করবে।