সা ম্প্র তি ক

সীমান্ত-হত্যা ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ‘আলাদা টোন’

মোজাম্মেল হোসেন | মতামত
ফেব্রুয়ারি ১, ২০২৫
সীমান্ত-হত্যা ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ‘আলাদা টোন’

আগামী ১৭ থেকে ২০শে ফেব্রুয়ারি নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী তথা যথাক্রমে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) মহাপরিচালক পর্যায়ে সীমান্ত সম্মেলন হবে। গত ৩০শে জানুয়ারি সচিবালয়ে একটি প্রস্তুতি সভা হয়েছে। সাংবাদিকদের তথ্য দিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম (অব.) যা জানান তাতে দেখা যায়, সীমান্ত পরিস্থিতি ও ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন দিক রয়েছে যেগুলো সম্মেলনে আলোচিত হবে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সীমান্তে ভারতীয় রক্ষীদের গুলি করে নিরীহ ও নিরস্ত্র বাংলাদেশিদের হত্যা করা। এই জানুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, লালমনিরহাট ও জয়পুরহাট- এই চার জেলাসংলগ্ন সীমান্তের পাঁচ জায়গায় ভারতীয়দের কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার কাজে আইন লঙ্ঘন করে শূন্যরেখার ১৫০ গজের মধ্যে আসা নিয়ে দুই দিকের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও গ্রামবাসীদের মধ্যেও উত্তেজনা হয়। সীমান্তে হত্যা ছাড়া ভারতীয়দের ফেনসিডিল উৎপাদন ও চোরাচালান, নদীপথে আগরতলা থেকে শিল্পবর্জ্য আসা, মুহুরীর চরে পিলার বসানো ইত্যাদি এবং পানি বণ্টন, ভারতীয় মিডিয়ায় অপপ্রচার ইত্যাদিও আলোচ্যসূচিতে আছে বলে উপদেষ্টা জানান। 
সংবাদ ব্রিফিংয়ে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, দীর্ঘদিন ধরে সীমান্ত সম্মেলনে এইসব আলোচনা হচ্ছে। এবার নতুন কী? 
জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘নতুন এটা যে, আগে যেভাবে কথা বলতো, এবার কথার টোনটা আলাদা হবে।’ 
দেখা গেল সংবাদপত্র, পোর্টাল ও টেলিভিশন চ্যানেলের প্রায় সবগুলো ইংরেজি শব্দ ‘টোন’ উদ্ধৃতিচিহ্নে রেখে খবরটির শিরোনাম করেছে। এবার বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে আলাদা স্বরে বা সুরে কথা বলবে। ২০২৪-এর ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটানোর আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র সমন্বয়করা কয়েকজন সম্প্রতি ‘ভারতের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে...মাথা উঁচু করে’ কথা বলার পক্ষে বক্তৃতা দিয়েছেন। দুইজন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বিজিবিকে সীমান্তে ‘পিঠ না দেখানোর’ আদেশ দিয়েছেন। এ বিষয়টি নিবন্ধের শেষে আবার উল্লেখ করবো। তার আগে সীমান্ত-হত্যা প্রসঙ্গ। 
 

বহুবার বহু রকম আলোচনা সত্ত্বেও সীমান্তে হত্যা বন্ধ হয়নি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও এরশাদ সবার শাসনামলেই সীমান্ত-হত্যা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানায়, বিএসএফের হাতে ২০২৩ সালে ৩১ জন ও ২০২৪ সালে ২৫ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় কোনো ভিন্নতা নেই। একই চিত্র। ২০২৫-এর প্রথম আট দিনে দু’জনের মৃত্যু হয়। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, ৭ই জানুয়ারি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার বড় কেয়ারা সীমান্তে ভারতীয় এলাকার ভেতরে জহুর আলী (৫৫)কে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভারতীয়দের পোস্ট করা ছবি দেখে তার গ্রামের লোকেরা শনাক্ত করেন এবং বিএসএফ ও ভারতীয় গ্রামবাসী তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ করেন। তিন দিন পরে বিএসএফ লাশ বিজিবি’র কাছে বুঝিয়ে দেয় এবং ঠাণ্ডায় ও হৃদরোগে তার মৃত্যু হয়েছে বলে জানায়। ৮ই জানুয়ারি সন্ধ্যায় সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার চিনাকান্দি সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে সাইফুল ইসলাম (২৪) নিহত হন। সংবাদপত্রে স্থানীয় সূত্রের খবর, চারজন তরুণ অবৈধভাবে সুপারি নিয়ে ভারতে যাচ্ছিলেন। বাকি তিন জন গুলিবিদ্ধ সাইফুলকে নিয়ে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে গেলে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। 
 

এভাবে সীমান্তে যারা মারা যায় তারা এত গরিব ও চোরাচালানের পণ্য আনা-নেয়ার মতো অবৈধ কাজ করে যে খবরগুলো সাধারণত মিডিয়ায় ছোট করে প্রকাশ করা হয়। প্রতিটি ঘটনার কূটনৈতিক পর্যায়ে প্রতিবাদ হয় না, দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর চৌকি বা জেলা প্রশাসন পর্যায়ে প্রতিবাদ ও বার্তা আদান-প্রদান, লাশ হস্তান্তর-গ্রহণ হয়। সুনামগঞ্জে সাইফুল ইসলামকে  বিএসএফের গুলি করে হত্যায় বাংলাদেশের উদ্বেগ ও হতাশা পররাষ্ট্র সচিবের তরফ থেকে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনারকে জানানো হয়েছে এবং সীমান্তে সকল হত্যার তদন্ত ও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দিল্লিকে জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। 
 

সাম্প্রতিক কাঁটাতারের বেড়া বিষয়ে ভারতের অননুমোদিত চেষ্টার ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিমউদ্দিন হাইকমিশনার প্রণব ভার্মাকে নিজ দপ্তরে ডেকেছিলেন। 
আমরা স্মরণ করতে পারি যে, চৌদ্দ বছর আগে ২০১১ সালের ৭ই জানুয়ারি কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী থানার অনন্তপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত ফেলানী খাতুন নামের এক চতুর্দশী গ্রাম্য বালিকার মৃতদেহ কাঁটাতারের বেড়ায় পাঁচ ঘণ্টা ঝুলে ছিল। মেয়েটি ভারতে থাকা তার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে বাবার সঙ্গে ফিরছিল। এই মর্মান্তিক দৃশ্যের সংবাদচিত্র সারা বিশ্বকে আলোড়িত করে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর নজর কাড়ে ও প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়। এই পটভূমিতে বাংলাদেশের দাবির মুখে ভারতে সংশ্লিষ্ট সীমান্তরক্ষীদের কোর্ট মার্শালে বিচার হয় কিন্তু সাজা হয় না। ফেলানীর বাবা নূরুল ইসলাম রায় প্রত্যাখ্যান করে হাইকমিশনের মাধ্যমে পুনর্বিচার চান এবং ভারতে গিয়ে সাক্ষীও দেন। তবে নিরাপত্তা বাহিনীর আদালতে দ্বিতীয়বারও গুলি নিক্ষেপকারী সিপাই খালাস পায়। এরপর ভারতীয় সংগঠন মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম) পুনর্বিচার ও ক্ষতিপূরণের জন্য ভারতের সুপ্রিম কোর্টে রিট আবেদন করে। বহুবার তারিখ পেছানোর ফলে শুনানি এখনো হয়নি। এবার ঢাকায় কয়েকটি সংগঠনের আয়োজনে ৭ই জানুয়ারি ফেলানীকে স্মরণ করা হয় এবং প্রতিবছর ‘ফেলানী হত্যা দিবস’ পালনের দাবি তোলা হয়। গত ১৬ই জানুয়ারি জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কুড়িগ্রাম শহর থেকে ফেলানীর গ্রামের বাড়ি পর্যন্ত ‘মার্চ ফর ফেলানী’ বা পদযাত্রা ও জনসভা করে। এতে নেতৃত্ব দেন নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক ও জুলাই ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সারজিস আলম।
 

ফেলানী ট্র্যাজেডির মতোই গত ১লা সেপ্টেম্বর সন্ধ্যারাতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে স্বর্ণা দাস নামে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী চতুর্দশী কিশোরীর মৃত্যু হয়েছে। সে তার মা ও আরও কয়েকজনের সঙ্গে দালালের সহায়তায় সীমান্ত পার হতে কাঁটাতারের বেড়ার কাছে পৌঁছুলে এভাবে তার জীবনের ইতি ঘটে। স্বর্ণার ভাই অবৈধভাবে ত্রিপুরায় বসবাস করে। 
ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে বাংলাদেশি নাগরিকদের এমন মৃত্যু মর্মান্তিক ও অগ্রহণযোগ্য ঘটনা। প্রত্যেক স্বাধীন দেশের আত্মরক্ষা ও সীমানা সুরক্ষিত রাখার অধিকার থাকলেও এই ঘটনাগুলো যেহেতু কোনো রাষ্ট্রের আক্রান্ত না হয়েও কেবল মামুলি সীমান্ত-অপরাধে বিনা বিচারে প্রাণ সংহার তাই একে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যায় কি-না তা আইনজ্ঞরা বলতে পারবেন। দীর্ঘদিন ধরে এই হত্যাকাণ্ডের পুঞ্জীভূত সংখ্যা জানলে বিস্মিত হতে হয়।
 

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের আগের হিসাব ছিল ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১১ বছরে সীমান্তে মৃত্যুর সংখ্যা ৫২২। আরেকটি সংগঠন বর্তমান সরকারের একজন উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান পরিচালিত ‘অধিকার’-এর রেকর্ডে আছে ২০০১-এর পয়লা জানুয়ারি থেকে ২০১২-এর অক্টোবর পর্যন্ত ১ হাজার ৬৪ জন নিহত হয়েছেন। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী পাঁচটি সীমান্তের একটি বলে চিহ্নিত করেছে। 
 

বাংলাদেশিদের মৃত্যুর বিপরীতে বিজিবি’র হাতে ভারতীয় নাগরিক নিহত হওয়ার বিষয়ে বিএসএফ থেকে পাওয়া অভিযোগ অনুসারে মাত্র তিন জনের হিসাব পাওয়া যায়। ২০১২ সালে একজন ও ২০১৫ সালে দুই জন। বিজিবি ভারতীয় পক্ষকে জানিয়েছিল, এরা চোরাচালানি। 
 

সীমান্ত-হত্যা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে অনেক দেন-দরবার হয়েছে। দুটি প্রটোকল স্বাক্ষরিত আছে। ১৯৭৫ সালের যৌথ ভারত-বাংলাদেশ দুই সীমান্ত কর্তৃপক্ষের জন্য নির্দেশিকা এবং ২০১১ সালের ভারত-বাংলাদেশ সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা। ভারতীয় সরকারের পক্ষে সীমান্ত-হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার বহুবার অঙ্গীকার সত্ত্বেও হত্যা থামেনি। বাংলাদেশ-ভারতের ৪ হাজার ৯৭ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ভারতীয়রা ৩ হাজার ১৪১ কিলোমিটারে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ শেষ করেছে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ঘনিষ্ঠতম দুই প্রতিবেশীর শান্তির সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বন্ধুত্ব ও মর্যাদা কোনোটারই প্রতীক নয়। 
 

ভারতীয় সীমান্ত কর্তৃপক্ষের মনোভাবও অত্যন্ত রূঢ়। যেমন ২০২২ সালের জুলাই মাসে বিএসএফের মহাপরিচালক পঙ্কজকুমার সিং সীমান্তে নিহত বাংলাদেশিদের সম্পর্কে ঢাকায় বসেই বলেছিলেন ‘ওরা ক্রিমিনাল’। তিনি দাবি করেছিলেন যে, ঘটনাগুলো রাতে ঘটে এবং বিএসএফ জওয়ানরা আক্রান্ত হয়ে আত্মরক্ষার্থে গুলি করতে বাধ্য হয়। ফেলানী ও স্বর্ণারা কীভাবে আক্রমণ করে তা অবশ্য বোধগম্য নয়। পঙ্কজ সিং মাদক, গরু চোরাচালান, জাল টাকার ব্যবসা প্রভৃতি অপরাধের কথা বলেন। তিনি কি জানেন না যে, পাঞ্জাব ও উত্তর প্রদেশ থেকে গরু বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত আনতে ভারতীয় ক্রিমিনালদেরই জড়িত থাকতে হয়? অন্য সব অবৈধ ব্যবসার তালিকাও কি এক হাতে বাজতে পারে? অবৈধ ব্যবসায়ে ভারতীয়রা নাই? নিরস্ত্র বাংলাদেশি গরিব নাগরিকদের সীমান্তে গুলি করে মেরেই কি চোরাচালান ও অবৈধ ব্যবসার সমাধান করা যাবে?
 

আমরাও ইস্যুটিকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সীমান্তে ভারতের আধিপত্যবাদী আচরণ ও বিএসএফ পরিচালিত হত্যা বলে প্রতিবাদ করি। অভিযোগ করি কিন্তু সমস্যাটির উৎস খুঁজতে ও স্থায়ী সমাধানের পথ বের করতে অন্যান্য দিক সাধারণত খতিয়ে দেখি না। যদি দেখতে চাই তাহলে প্রথম প্রশ্নটি হবে, কেন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে শুধু বাংলাদেশি নাগরিকরাই ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে মারা যায়? ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান, নেপাল ও মিয়ানমারের সীমান্ত আছে। ওই সব সীমান্তে কেন কোনো নিরস্ত্র মানুষের গুলি খেয়ে মরার খবর অন্তর্জাতিক মিডিয়ায় পাওয়া যায় না ও বাংলাদেশের মতো শোরগোল ওঠে না? 
 

এর সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত জবাব হচ্ছে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ও সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর মানুষের নিদারুণ দারিদ্র্য। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা চোরাচালানে, টুকটাক অবৈধ ব্যবসায়ে লিপ্ত হয়, খেটে খেয়ে বাঁচতে ভারতে যায়। ভারতীয়রা কিন্তু এদিকে আসে না। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার যে সংগঠনগুলো বিএসএফের সীমান্ত-হত্যার নিন্দা ও প্রতিবাদ করে তাদের দলিলে বাংলাদেশিদের ওপারে যাওয়ার কথা আছে, ভারতীয়দের এপারে  আসার কথা নেই। এটা আমাদের জন্য নিশ্চয়ই মর্যাদাকর নয়। সীমান্ত-হত্যা বন্ধ করার জন্য আমরা ভারতকে অবশ্যই জোরালোভাবে বলবো। তবে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, স্থায়ী সমাধানের জন্য দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা নিয়ে আমাদের জনগণের দারিদ্র্য দূর করতে হবে। 
আরেকটি কার্যক্রমকে আমাদের দেশে অহেতুক নেতিবাচকভাবে দেখা হয়েছে। তা হচ্ছে সীমান্ত-বাণিজ্য। সীমানার দু’দিকে অনধিক ৮-১০ কিলোমিটার জায়গায় অথবা বিভিন্ন স্থানে সীমান্ত-হাট বসিয়ে চাহিদাসম্পন্ন প্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্কমুক্ত বা উদার শুল্ক সুবিধা দিয়ে, মুদ্রায় লেনদেন ছাড়াও বার্টার বা পণ্য-বিনিময়ব্যবসা চলতে পারে। তাতে স্বল্প আয়ের মানুষের আর্থিক সংস্থান হয় ও চোরাচালান বন্ধ হতে পারে। সীমান্তের দু’দিকের পরিবারগুলো অবাধে দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারে। স্বাধীনতার পরে এমন একটি ধারণায় কাজ শুরু হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। চোরাচালান রমরমা হয়েছে। সীমান্ত-হাটের কিছু জটিলতা আছে, তবে সদিচ্ছা থাকলে তা অতিক্রম করা যায়। মূল কথা হলো সীমান্তে গরিব মানুষের লাগাতার মৃত্যু স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হলে  দেশের দারিদ্র্য দূর করতে হবে। 
 

এবার আসা যাক ভারতের সঙ্গে ‘আলাদা টোনে’ কথা বলার প্রশ্নে। যারা ১৯৭১-এ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, যারা রাজনৈতিকভাবে  বরাবরই ভারতবিরোধী তারা অভিযোগ করে থাকে যে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, বিশেষত আওয়ামী লীগ ভারতের কাছে ‘নতজানু পররাষ্ট্রনীতি’ অনুসরণ করে।
অবশ্যই একটি সার্বভৌম স্বাধীন দেশের সরকারকে অন্য যেকোনো দেশের সঙ্গে সমমর্যাদায় মাথা উঁচু করে কথা বলতে হবে। আমরা অপেক্ষা করবো দিল্লিতে বিজিবি-বিএসএফ সীমান্ত সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কথিত ‘টোন’ শোনার জন্য। 
 

প্রসঙ্গত, ২০২৪-এর অভ্যুত্থানের পরপরই ১৩ই আগস্ট তৎকালীন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.) হাসপাতালে বিজিবি’র আহতদের দেখতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সীমান্তে আমাদের লোক মারে, বিজিবি পতাকা বৈঠক করতে বাধ্য হয়। আমি বলেছি যে, পিঠ দেখাবেন না। এনাফ ইজ এনাফ।’ আবার বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা  লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) গত ৩১শে ডিসেম্বর চট্টগ্রামে বিজিবি’র অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘ভারতীয় সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ যাতে কোনো অবস্থাতেই পিঠ নয়, বুক দেখায়, সে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।’
 

বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে আমাদের সীমান্তরক্ষীরা কখনোই পিঠ দেখানোর অপবাদ পেতে পারেন না। বরং এর বিপরীত। ২০০১ সালে সিলেটের পদুয়া সীমান্তে বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে অবস্থান নিয়ে বিএসএফ তাদের দু’টি চৌকির সংযোগ ঘটাতে বাংলাদেশের ভূমিতে রাস্তা নির্মাণ করছিল। আমাদের ‘বাংলাদেশ রাইফেলস’ বা বিডিআর নামের তৎকালীন সীমান্তরক্ষীরা নিষেধ করলেও তারা অগ্রাহ্য করে। তখন বিডিআর বিএসএফের প্রায় ৭০ জনকে আটক করে। সেখানে পতাকা বৈঠকে মিটমাট হলেও বিএসএফ ক্রুদ্ধ ছিল। ১৮ই এপ্রিল কুড়িগ্রাম জেলার বড়াইবাড়ি গ্রামে ভারতের আসাম সংলগ্ন সীমান্তে বিএসএফ বাংলাদেশের ভেতরে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঢোকে। গ্রামবাসীরা খবর দিলে অল্পসংখ্যক বিডিআর তাদের চ্যালেঞ্জ করে এবং চার ঘণ্টা তুমুল গোলাগুলিসহ প্রায় ২৪ ঘণ্টাব্যাপী বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সীমান্ত সংঘর্ষ হয়। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ১৬ জন বিএসএফ জওয়ান নিহত হয়। বিডিআরের মারা যায় ২ জন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত কয়েকটি ছবির মধ্যে একজন ভারতীয় জওয়ানের মৃতদেহ হাত-পা বেঁধে বাঁশে ঝুলিয়ে নেয়ার দৃশ্য ভারতে ও বাইরে প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। সীমান্ত বৈঠক এবং ঢাকা ও দিল্লির সর্বোচ্চ সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগের মাধ্যমে উত্তেজনা স্তিমিত হয় এবং সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকে। 
এই ঘটনাটির সময় বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অটল বিহারি বাজপেয়ী। তার চেয়েও বড় কথা, ‘নতজানু পররাষ্ট্রনীতি’ বা ‘সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপস’ বা বিডিআর-বিজিবি’র ‘পিঠ দেখানো’র আশঙ্কা কোনোটাই সত্য নয়।

 

মতামত'র অন্যান্য খবর