সা ফ ক থা

একাত্তরকে অস্বীকার ও রাজনীতিতে ধর্মের কার্ড

সোহরাব হাসান | মতামত
ফেব্রুয়ারি ১, ২০২৫
একাত্তরকে অস্বীকার ও রাজনীতিতে  ধর্মের কার্ড

৫ই আগস্টের ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনীতির মাঠে জামায়াতে ইসলামীই বিএনপি’র প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুযোগ পেলেই জামায়াতের নেতারা দুই রসুনের একই গোড়া বলে তীর্যক আক্রমণ করছেন বিএনপিকে। শুরুতে বিএনপি নীরব থাকার নীতি নিলেও এখন কৌশল বদলেছে। অন্যদিকে জামায়াত যেই ছাত্র-তরুণদের ওপর ভরসা করেছিল, সেই ছাত্র-তরুণেরাও তাদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থানকে মেনে নিতে পারছেন না।
সমপ্রতি উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লিখেছেন, দেশের মানুষের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম এবং বাংলাদেশের জন্মকে স্বীকার করেই এদেশে রাজনীতি করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যারা যাবেন, তারাও মজলুম বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে যাওয়ার কারণে অতীতে পরাজিত হয়েছেন, সামনেও পরাজিত হতে বাধ্য।...মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ ফ্যাসিস্ট হতে পারেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ছিল আপামর জনগণের লড়াই। মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশের ফ্যাসিস্ট, ইসলামফোবিক ও খুনি হয়ে ওঠার কারণে আপনি খোদ মুক্তিযুদ্ধ বা সব মুক্তিযোদ্ধাকে অস্বীকার কিংবা প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেন না। এটা রাষ্ট্রের ভিত্তির সঙ্গে গাদ্দারি!
এর সঙ্গে যদি আমরা জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের মুক্তিযুদ্ধ মূল্যায়ন লক্ষ্য করি, তাহলে স্পষ্ট হবে তিনি কাদের উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলেছেন। ইসলামী ছাত্রশিবিরের মাসিক প্রকাশনা ‘ছাত্র সংবাদ’-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটাক্ষ করা হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত জনৈক আহমেদ আফঘানি লিখেছেন, ‘অনেক মুসলিম না বুঝে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল, এটা তাদের ব্যর্থতা ও অদূরদর্শিতা ছিল। আল্লাহ তায়ালা তাদের ক্ষমা করুন।’
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দীন নাসির বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছাত্রশিবিরের দলীয় পত্রিকায় এ ধরনের আপত্তিকর বক্তব্য প্রচারের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এসেও নিজেদের দলীয় প্রকাশনায় মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করাকে ভুল ও অদূরদর্শিতা হিসেবে প্রচার করা এবং ‘পাপকাজ মনে করে’ ক্ষমা প্রার্থনা করা একটি গর্হিত এবং ন্যক্কারজনক ঘটনা। প্রকৃতপক্ষে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ কোনো ধর্মযুদ্ধ ছিল না। এটি ছিল অত্যাচারী, জালিম, দখলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্বিচারে গণহত্যার বিরুদ্ধে মজলুম বাংলাদেশিদের প্রতিরোধের যুদ্ধ। ধর্ম, বর্ণ, গোত্রনির্বিশেষে আপামর জনসাধারণের অংশগ্রহণের কারণে মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি সত্যিকারের জনযুদ্ধ।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘কেউ ভুল করে কিংবা না বুঝে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে, এই বক্তব্য একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও তাদের দোসরদের ধৃষ্টতা ও নিজেদের পরাজয়ের গ্লানি চাপা দেয়ার অপকৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়। ছাত্রশিবিরের এরূপ কাণ্ডজ্ঞানহীন প্রচারণার কারণে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের বুদ্ধিবৃত্তিক পুনর্বাসনের প্রেক্ষাপট তৈরি করবে।’
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দীন নাসির মনে করেন, ‘ছাত্রশিবির যদি এই ন্যক্কারজনক মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বয়ানকে নিজেদের দলীয় প্রকাশনা থেকে প্রত্যাহার করে জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা না করে, তাহলে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতি ছাত্রশিবিরের আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার নৈতিক অধিকার হারিয়ে ফেলবে।’ আওয়ামী লীগ এত দিন নিজেদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সিপাহশালার বলে দাবি করতো। গত বছর আগস্টে ক্ষমতা হারানোর পরও দফায় দফায় কর্মসূচি ঘোষণা করে আসছে। কিন্তু জামায়াত বা শিবিরের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বক্তব্যের কোনো প্রতিবাদ তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুকে দেখলাম না। একটি দল যদি জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতা অনুধাবন করতে না পারে, সেটি ধীরে ধীরে জনবিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য। অন্তর্বর্তী সরকারের অনেক দুর্বলতা ত্রুটি থাকতে পারে, তাকে কোনোভাবে অবৈধ বলা যায় না। সেটা মানুষ মেনেও নেবে না। আওয়ামী লীগের নেতারা অজ্ঞাত স্থান থেকে যেসব গরম বার্তা প্রচার করছে, তাতে দলের কোনো লাভ হচ্ছে না। বরং দেশের ভেতরে নেতাকর্মীদের বিপদ ডেকে আনছেন। নেতাদের উচিত ছিল- যেকোনো বিপদে কর্মীদের পাশে থাকা। বিএনপি ১৫ বছর কাজটি করতে পারলেও আওয়ামী লীগ ৫ মাসও কেন পারলো না। সবকিছু ষড়যন্ত্র বলে চালিয়ে দিলে হবে না।
যতই দিন যাচ্ছে, নির্বাচনের দাবি জোরদার হচ্ছে। বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জনজীবনের নিরাপত্তা ও দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে ফেব্রুয়ারি মাঠে নামবে বলে জানানো হয়েছে। এই বৈঠকে নতুন দল গঠন নিয়ে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করার কথাও বলা হয়েছে। বিএনপি’র সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের কর্মসূচির সঙ্গে বিএনপি’র কর্মসূচির কোনো যোগসূত্র নেই।

 

এদিকে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতের বাইরের ইসলামী দলগুলোর গুরুত্ব বেড়ে গেছে। ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমানের বৈঠকের পর বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বৈঠক করেছেন। ইসলামী আন্দোলনের আমীরের সঙ্গে বৈঠকের কয়েকদিন আগে খেলাফত মজলিসের সঙ্গেও বৈঠক করেছে বিএনপি। বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাজধানীর পুরানা পল্টনে ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে ইসলামী আন্দোলনের আমীর ও চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। নির্বাচনের সময় নিয়ে পুরোপুরি একমত না হলেও ইসলামী শরিয়াহবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়াসহ ১০টি বিষয়ে একমত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে দল দুটি। বৈঠক শেষে বিএনপি ও ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের ঘোষণায় দুই দলের মধ্যে দূরত্ব কমানোর ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
গত ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ‘সংস্কার ও নির্বাচন’সহ বিভিন্ন বিষয়ে বিএনপি’র সঙ্গে যে ক’টি রাজনৈতিক দলের মতবিরোধ সামনে আসে, এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন অন্যতম। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের পতনের পর বিভিন্ন স্থানে ‘দখল, চাঁদাবাজি’ নিয়ে জামায়াতের পাশাপাশি বিএনপিকে লক্ষ্য করে বক্তব্য রেখে আসছিলেন ইসলামী আন্দোলনের আমীর সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম ও জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমীর সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম।
 

ইসলামী আন্দোলন ও বিএনপি’র এই বৈঠকের পেছনে রাজনীতির হিসাবনিকাশ আছে। জামায়াতে ইসলামী পীরবাদের বিরোধী প্রচণ্ডভাবে। বিভিন্ন স্থানে দরগাহ ও পীরের আস্তানা ও মাজারে হামলার পেছনে তাদের ইন্ধন আছে বলে অভিযোগ আছে। যদিও জামায়াতের নেতাদের দাবি, তারা এসব হামলায় বিশ্বাসী নয়। সরকারও এসব হামলার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ার কথা বলেছে। ছাত্রনেতারাও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তারপরও একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটে চলেছে। গেল সপ্তাহে ঢাকার কেন্দ্রস্থলে কুতুব শাহের ওরস উপলক্ষে আয়োজিত প্যান্ডেল ভেঙে দিয়েছেন একদল লোক।
 

বিবিসি’র খবরে বলা হয়, নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসলামপন্থি দল হিসেবে পরিচিত ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে নিজেদের সঙ্গে রাখার জন্য এক ধরনের রশি টানাটানি শুরু হয়েছে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তার সাবেক জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে।
 

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ অবশ্য বৈঠককে ‘রাজনৈতিক শিষ্টাচার’ ও দশ দফাকে ‘স্বাভাবিক রাজনৈতিক ঐক্যমত’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বিএনপি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে বলেই সবার সঙ্গে আলোচনা করে থাকে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
 

কে কার রশি কতো দূর টেনে নিতে পারবে, সেসব নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচনা আছে। এ ধরনের আলোচনা থেকে ডানপন্থি দলগুলোই বাড়তি সুবিধা নিয়ে থাকে। অতীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র ঝগড়ার সুযোগে জামায়াত ও জাতীয় পার্টি সুবিধা নিয়েছে। কেউ বিএনপি’র ঘাড়ে সওয়ার হয়ে কেউ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য করে সরকারের শরিক হয়েছে। বিরোধী দলের আসন অলঙ্কৃত করেছেন। অথচ বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে রাজনৈতিক কর্ম-সম্পর্ক থাকলে, এক দল ক্ষমতায় থেকে অন্য দলকে নিশ্চিহ্ন করতে না চাইলে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথই পাল্টে যেত। ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপি’র সমঝোতা নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু তাদের একটি কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- ২০০৭ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগও খেলাফতে মজলিস নামে একটি দলের সঙ্গে ৫ দফা চুক্তি করেছিল। সেই চুক্তিতেও আওয়ামী লীগ কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোনো আইন করবে না বলে অঙ্গীকার করেছিল। পরবর্তীকালে যদিও আওয়ামী লীগ সেই চুক্তি থেকে সরে আসে। বিএনপিও একই অঙ্গীকার করেছে ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে। ভোটের রাজনীতিতে ধর্মের কার্ড খেলে খুব লাভ হয় না।
সাধারণ মানুষ ধর্ম ও রাজনীতিকে এক করে দেখতে চায় না। তারা মনে করেন, ধর্ম হলো ব্যক্তিগত বিশ্বাস, আর রাজনীতি হলো রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতি।

 

 

মতামত'র অন্যান্য খবর