সা ফ ক থা

যে প্রেক্ষাপটে দ্রুত নির্বাচন জরুরি

হাসান মামুন | মতামত
মার্চ ১৫, ২০২৫
যে প্রেক্ষাপটে দ্রুত নির্বাচন জরুরি

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়টি সামনে এসেছিল। তাতে কেউ তেমন আপত্তিও করেনি। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা ও তার নানামাত্রিক অপরাধের সহযোগীদের বিচারের দাবি তো ছিলই। পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন কবে হবে, তা নিয়ে মানুষকে বেশি মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি তখন। প্রায় সবাই বলছিল, বিচার ও সংস্কারের পর উপযুক্ত সময়ে নির্বাচন হোক। জাতীয় নির্বাচনই আলোচনায় ছিল তখন। স্থানীয় নির্বাচনের প্রসঙ্গ কেউ তুলেছিল বলে মনে পড়ে না। এখন কোনো কোনো মহল থেকে অবশ্য জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন করার কথা তোলা হচ্ছে। আছে ‘গণপরিষদ নির্বাচন’ আয়োজনের দাবিও। তবে যথাসম্ভব দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হওয়ার দাবিই জোরালো। 


হাসিনা সরকার পতনের পর ক’দিন দেশে কোনো সরকার ছিল না। কে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হবেন, তা নিয়েও ছিল জল্পনা-কল্পনা। শেষে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো গ্লোবাল ইমেজধারী ব্যক্তি এ দায়িত্ব নেয়ায় মানুষ আশ্বস্ত হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও যায় ইতিবাচক বার্তা। রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তীকালে বাংলাদেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই পথ চলবে, এমন আশাবাদ তৈরি হয়েছিল চারদিকে। অন্তর্বর্তী সরকারের ছয়-সাত মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর তাতে চিড় ধরেছে বললে অবশ্য ভুল হবে না। প্রত্যাশিত সংস্কার তো পরে; বিচারের ক্ষেত্রেও অগ্রগতি কম। গণ-অভ্যুত্থানে হতাহতদের তালিকা করে তাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের চিত্রটিও হতাশা জাগায়। সরকার রুটিন কাজও ঠিকমতো করতে পারছে না বলে সমালোচনা বেড়েছে। একটা অস্থির সময়ে দেশ পরিচালনায় সাফল্য দেখানো অবশ্য কঠিন। তবে ছয়-সাত মাস পরও এ আশাবাদ তৈরি হচ্ছে না যে, সামনে সরকার সুষ্ঠুভাবে দেশ চালাবে। 


ড. ইউনূসের ওপর আস্থা অটুট থাকলেও উপদেষ্টা পরিষদের ওপর সেটা আছে বলে মনে হয় না। অনাস্থা তৈরি হয়েছে মূলত তাদের দক্ষতা নিয়ে। অন্তর্বর্তী সরকারের ‘রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা’ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সরকার মাঠে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি নিরপেক্ষ থাকবে, এ প্রত্যাশা মার খাওয়া নিয়ে আলোচনা বাড়ছে। সেটা বাড়ছে প্রধান উপদেষ্টার কোনো কোনো বক্তব্যের কারণেও। উপদেষ্টা পরিষদের একাংশের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়ার কারণেও কম প্রশ্ন উঠছে না। এর একাংশ এখনো সরকারে রয়ে গেছে কেন, তারও সদুত্তর নেই। সরকারে থেকে তাদের কারও কারও ‘বিতর্কিত বক্তব্য’ প্রদানও অব্যাহত। এসব কারণে সামনে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনাও কমছে না। অথচ রাজনৈতিক ভবিষ্যতের চিত্রটি এখন স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। মানুষ স্বভাবতই অনিশ্চয়তায় থাকতে চাইছে না। উন্নয়ন সহযোগীরাও এখানে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার অবসান দেখতে আগ্রহী। 


ক্ষমতাচ্যুতদের অপরাধের বিচার কে না চায়! ন্যায়বিচারে বিশ্বাসী সবাই এটা চাইবে। আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ও এ ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারকে সহায়তা জোগাবে বলে আশা। হালে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন জুলাই-আগস্টের আন্দোলন দমনের ওপর যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার সহযোগীদের বিচারের দাবি হয়েছে প্রবলতর। তবে এসব ঘটনায় দায়ের মামলার প্রাথমিক বিচার সম্পন্ন করতেও সময় লাগবে। তড়িঘড়ি বিচার করতে গেলে ‘ন্যায়বিচার’ নিশ্চিত করা যাবে না, এটা প্রধান উপদেষ্টা নিজেও বলেছেন। এদিকে সংস্কারের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, সেটা এখনো প্রাথমিক স্তরে। সব সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন জমা দেয়নি এখনো। প্রধান ছয় কমিশনের বাছাইকৃত সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সংলাপ শুরুর পর্যায়ে রয়েছে সরকার। ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ চেষ্টা করবে মূল সুপারিশগুলোর বিষয়ে দলগুলোকে এক জায়গায় আনতে। তবে কাজটা মোটেও সহজ নয়; একইসঙ্গে সময়সাপেক্ষ। 


ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত ঐকমত্য কমিশনের রাজনৈতিক সংলাপ শুরুর সময়টায় দেশে রমজান চলছে। এ সময়ে পণ্যবাজারে যে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়ে থাকে, সেটা অবশ্য এবার পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এজন্য অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা সেভাবে কৃতিত্ব দাবি না করলেও মানুষ তাদের প্রশংসা করছে। ‘রোজার বাজার’ সামনে রেখে সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল বৈকি। যাতে জরুরি পণ্যের সরবরাহ পর্যাপ্ত এবং দাম সহনীয় থাকে, সে লক্ষ্যে তাদের চেষ্টা ছিল সুস্পষ্ট। কৃষিতেও উৎপাদন পরিস্থিতি ভালো এবার। বাজারে এর সুফল মিলছে। তবে একই সময়ে ছিনতাই, ডাকাতিসহ অপরাধ বেড়ে যাওয়াটাও অস্বীকার করা যাবে না। তথ্য-উপাত্তে দেখা যাচ্ছে, গেল বছরের একই সময়ের তুলনায় বিশেষত দস্যুতা বেড়েছে। রাজনৈতিক হানাহানিও অব্যাহত। এ মুহূর্তে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামের বিশেষ অভিযান চললেও তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে। অপরাধের ভিডিও কনটেন্ট দ্রুত সামনে চলে আসাতেও মানুষ উদ্বিগ্ন হচ্ছে বেশি। নারী ও শিশু নিগ্রহের ঘটনায় আবার জোরালো প্রতিবাদ হচ্ছে নাগরিক সমাজে। বহির্বিশ্বেও ওইসব খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় বাংলাদেশ নিয়ে উৎকণ্ঠা বাড়ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকার ও দেশের ভাবমূর্তি।  
অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্য তেমন উৎকণ্ঠিত দেখা যাচ্ছে না। প্রধান উপদেষ্টা তার একাধিক সাক্ষাৎকারে আইনশৃঙ্খলার অবনতির দিকটি স্বীকার করতে চাননি। পরিস্থিতির যে আশানুরূপ উন্নতি হয়নি, সেটা অবশ্য স্বীকার করেছেন। এর মূল কারণ হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ডকে দায়ী করেছেন। তার সঙ্গে পুরো একমত হওয়া কঠিন এজন্য যে, দেশে ‘মব ভায়োলেন্স’ বন্ধ হয়নি এখনো। এসব যে মূলত গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী পক্ষগুলো থেকেই হচ্ছে, সেটাও জানা। ছয়-সাত মাসেও সরকার এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে পারেনি কেন, তারও সদুত্তর নেই। এতদিনেও পুলিশকে সরকার সক্রিয় করতে পারেনি। এ বাহিনীকে হাসিনা সরকার শেষ করে দিয়ে গেছে, এটা তো কারও অজানা নয়। পুলিশ ছাড়া দেশ চলবে না, এটাও অনস্বীকার্য। সেনাবাহিনীকে বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে মাঠে রাখা হলেও তারাও পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রত্যাশিত সক্রিয়তা দেখাচ্ছে না। সেনাদের সক্ষমতা নিয়ে কারও সন্দেহ নেই। তবে তাদের জোরালোভাবে ব্যবহারের প্রশ্নে সরকারের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে বলেই মনে হয়। পেশাগত দাবি ঘিরে রাজপথ দখলে নিয়ে চাপ সৃষ্টির সংস্কৃতিও দমিত হচ্ছে না। ইউনূস সরকার শুরু থেকে এ ব্যাপারে কঠোর হয়নি বলে সমালোচনা রয়েছে। 


ইতিপূর্বে এ ধরনের আরও চারটি অন্তর্বর্তী (‘তত্ত্বাবধায়ক’) সরকারের শাসনামল দেখেছে জনগণ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে এবারই তাদের হচ্ছে ভিন্ন অভিজ্ঞতা। আশা ছিল, ক্রমে এর উন্নতি হবে। স্পষ্টতই তা হতে দেখা যাচ্ছে না। সরকার চাইলে জটিল মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিতেও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা যে সম্ভব, তা কিন্তু ভালোই দেখা যাচ্ছে রোজার বাজারে। সরকার সচেষ্ট হলে এবং পক্ষপাতহীনভাবে কাজ করলে আইনশৃঙ্খলায়ও যে উন্নতি ঘটানো যেত, সেটা জোর দিয়েই বলা যায়। ভারতে বসে শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীরা যত তৎপরতাই চালাক- গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষ শক্তিগুলোর সহায়তায় সরকার তা মোকাবিলা করতে পারবে না কেন? বাস্তবতা হলো, গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষ শক্তিগুলো একতাবদ্ধ থাকেনি। সরকারও তাদের ঐক্য ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে বলে মত রয়েছে। এজন্য গণ-অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বকেও দায়ী করা হচ্ছে। তারা আবার দায়ী করছে একটি বড় রাজনৈতিক দলের দুর্বৃত্ত প্রকৃতির নেতাকর্মীদের। সে দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে এদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ব্যর্থ হতেও দেখা যাচ্ছে। 


হাসিনা সরকার পতনের পর দেশে কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, সেটা অবশ্য কারও ধারণার মধ্যে ছিল না। অন্তর্বর্তী সরকার কেমন ‘পারফর্ম’ করবে, তাও ছিল অজানা। ভালো হতো গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন একটি সরকারের কাছে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর হলে। হাসিনা গং সে পথ একেবারেই রুদ্ধ করে দিয়েছিল ২০১৮ সালের ‘রাতের ভোটে’। অতঃপর একটা গণবিস্ফোরণের মুখোমুখি হওয়াটাই ছিল তাদের কপালে। বাস্তবে সেটা অনেক রক্তক্ষয়ীও হলো। হাসিনা সরকার প্রস্থান করলো একটি ভেঙে পড়া, অস্থিতিশীল দেশ রেখে। নজিরবিহীন লুটপাটে এর অর্থনীতিও বিপর্যস্ত। বছরের পর বছর চলা উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে মানুষ দিশাহারা। এর মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপের কারণেও শিল্প খাতে চলছে শ্রমিক ছাঁটাই। এদিকে ‘নির্বাচনের রোডম্যাপ’ এখনো অস্পষ্ট বলে বিনিয়োগ বাড়ছে না। কর্মসংস্থান হচ্ছে না অবনতিশীল পরিস্থিতিতে। বিদেশি ঋণ সহায়তা ছাড়েও মন্দা চলছে। এ অবস্থায় সামনে জাতীয় বাজেট দিতে হবে ‘অনির্বাচিত’ অন্তর্বর্তী সরকারকে। এতে সব পক্ষকে খুশি রাখা তার পক্ষে আরও কঠিন হবে। 


নজিরবিহীন গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী পরিস্থিতিও নজিরবিহীন। এ অবস্থায় সরকার বলছে, রাজনৈতিক ঐকমত্য হলেও সব সংস্কার তার দ্বারা সম্ভব হবে না। কিছু সংস্কার নির্বাচিত সরকারকেই করতে হবে। যথাসম্ভব দ্রুত নির্বাচনের দাবি জোরালো হয়ে ওঠাতেই সরকার এভাবে কথা বলছে বৈকি। একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া সৃষ্ট পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়- এ মতও এখন জোরালো। সংস্কার বিষয়ে নির্বাচিত সরকারকে অবিশ্বাস করে বক্তব্য দিয়েও লাভ নেই। এত বড় গণ-অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কার প্রশ্নে বিরোধী দল আর নাগরিক সমাজের দায়িত্বও উড়িয়ে দেয়া যাবে না। একইসঙ্গে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বেশিদিন বজায় রাখা যাবে না, সেটা সেনাপ্রধানের বক্তব্যেও স্পষ্ট। ‘নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি’কেই তিনি বেশি দায়ী করেছেন উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য, সেটাও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। শুধু বিচার ও সংস্কার নয়; জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারেও রাজনৈতিক দলগুলোকে দ্রুত একমত হতে হবে। ছয় মাসের মধ্যে একটা গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইসির প্রস্তুতি রাখাও জরুরি। 


লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

মতামত'র অন্যান্য খবর