প র্য বে ক্ষ ণ

ডাকসু ফলাফল ভবিষ্যৎ রাজনীতির সতর্কবার্তা

শহীদুল্লাহ ফরায়জী | অনুসন্ধান
সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৫
ডাকসু ফলাফল ভবিষ্যৎ রাজনীতির সতর্কবার্তা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) কেবল ক্যাম্পাসভিত্তিক একটি প্রতিনিধি প্রতিষ্ঠান নয়; বরং জাতির রাজনৈতিক চেতনার আদি পরীক্ষাগার। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ, গণ-আন্দোলন থেকে স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম-প্রতিটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে ডাকসু ছিল জাতির অগ্রণী মশাল। তাই এর প্রতিটি নির্বাচনী ফলাফল কেবল একটি প্রাতিষ্ঠানিক হিসাব নয়; বরং জাতীয় রাজনীতির গতিপথ ও ভবিষ্যৎ সমাজ বিন্যাসের সূচক।


ডাকসু আসলে এক ক্ষুদ্র রাষ্ট্র, যেখানে জাতির সম্ভাব্য পথরেখা ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ আগে থেকেই প্রতিফলিত হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একে মাইক্রো-পলিটিক্যাল ল্যাবরেটরি-একটি পরীক্ষাগার হিসেবে আখ্যায়িত করেন, যেখানে দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক সংকট, দ্বন্দ্ব ও নতুন সম্ভাবনার অঙ্কুরোদ্গম ঘটে। এখানে তরুণরা যে মেরূকরণ গড়ে তোলে, তা পরবর্তীতে জাতীয় জীবনে বৃহত্তর আকার ধারণ করে। ক্যাম্পাসের নির্বাচনী লড়াই আসলে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতিরূপ। ফলে, ডাকসুর ফলাফলকে কেবল ছাত্র রাজনীতির সীমায় আবদ্ধ করা যায় না; এটি ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রচিন্তা, ক্ষমতার ভারসাম্য এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষার দিকনির্দেশক হিসেবে মূল্যায়িত হয়।


সামপ্রতিক ফলাফলের তাৎপর্য: সামপ্রতিক ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল আমাদের সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বাস্তবতা তুলে ধরেছে। দক্ষিণপন্থি শক্তির উত্থান এবং প্রগতিশীল দাবি-দাওয়ার দুর্বলতা কেবল ক্যাম্পাস রাজনীতির ঘটনা নয়; এটি ভবিষ্যৎ জাতীয় রাজনীতির পুনর্গঠনের ইঙ্গিত। একদিকে তরুণ প্রজন্মের হতাশা, বিক্ষুব্ধতা এবং মূলধারার ব্যর্থ রাজনীতির প্রতি অনাস্থা, অন্যদিকে প্রগতিশীল শক্তির সাংগঠনিক দুর্বলতা ও আদর্শিক প্রচারের অভাব-এই শূন্যতাই জামায়াত-শিবিরকে সুযোগ করে দিয়েছে।
এই ফলাফলকে কেবল পরাজয় বনাম বিজয় হিসেবে দেখা ভুল হবে। বরং এটি জাতীয় রাজনীতির জন্য একটি সতর্কবার্তা। গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তি তরুণ প্রজন্মের সামনে আদর্শ, স্বপ্ন এবং নৈতিক নেতৃত্ব স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার তরুণরা পাননি, বরং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ও আদর্শহীনতার ভগ্নাবশেষই পেয়েছে। এই শূন্যতা জামায়াত-শিবিরের উত্থানকে সুগম করেছে।
সুতরাং, ডাকসু’র ফলাফল কেবল একটি নির্বাচনী পরিসংখ্যান নয়-এটি আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনীতির দিশাহীনতা, আদর্শিক শূন্যতা এবং ভবিষ্যৎ সংগ্রামের জন্য নতুন কৌশল নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তার প্রতিচ্ছবি। প্রথমবারের মতো ছাত্রশিবির জয়লাভ করেছে, যা মুক্তিযুদ্ধের পর রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। এটি শুধু নির্বাচনী সাফল্য নয়, বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক মানসিকতার পরিবর্তনেরও প্রতিফলন।
ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের অপ্রত্যাশিত জয় এবং বিএনপি-সহ জুলাই অভ্যুত্থানপন্থি শক্তির পরাজয় শুধুমাত্র একটি সাংগঠনিক দৃশ্যই নয়; এটি আমাদের সামনে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির নৈতিক ভিত্তি ও দার্শনিক দিকনির্দেশকের গুরুত্বপূর্ণ এক পরীক্ষার মুখে দাঁড় করিয়েছে।
 

জুলাই অভ্যুত্থান ও তার সীমাবদ্ধতা: জুলাই অভ্যুত্থান নিছক একটি রাজনৈতিক ঘটনা নয়; এটি জনগণের নৈতিক বিদ্রোহ। জনগণ অবিচার, দমন ও লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে নিজেদের নৈতিক শক্তি প্রকাশ করেছিল। কিন্তু সেই মহৎ বিদ্রোহ ছাত্রসমাজে দীর্ঘস্থায়ী সাংগঠনিক রূপ নিতে পারেনি। ডাকসু’র সামপ্রতিক নির্বাচনে এর প্রতিফলন স্পষ্ট অনুপস্থিত। অর্থাৎ, জন-আন্দোলনের নৈতিকশক্তি যদি দর্শন, শিক্ষা ও সাংগঠনিক কাঠামোর ভেতর প্রবাহিত না হয়, তবে তা ক্ষণস্থায়ী উত্তাপ হয়ে থাকে এবং স্থায়ী পরিবর্তনে রূপ নিতে পারে না।
ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, ফরাসি বিপ্লব থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত-যখনই কোনো আন্দোলন কেবল ক্ষণস্থায়ী আবেগে সীমাবদ্ধ থেকেছে, তখনই তা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতে নিয়ন্ত্রিত হয়, বিপরীতে যেখানে আন্দোলনকে শিক্ষা, সংগঠন ও দর্শনের ভিত্তিতে দীর্ঘস্থায়ী করা হয়েছে, সেখানেই তা জাতির চরিত্র রূপান্তর করতে সক্ষম হয়েছে।
ডাকসু’র ফলাফল আমাদের সেই শিক্ষা মনে করিয়ে দেয়-যদি নৈতিক বিদ্রোহকে দর্শনে রূপান্তরিত না করা যায়, যদি তাকে সাংগঠনিক কাঠামো ও সংস্কৃতির ভিত না দেয়া যায়, তবে তা ইতিহাসের এক ক্ষণস্থায়ী বিস্ফোরণ হয়ে থাকে; স্থায়ী পরিবর্তনের ভিত্তি তৈরি করে না। এ ব্যর্থতাই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে আবারো অগ্রসর হওয়ার সুযোগ করে দেয়।
 

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বার্তা:মুক্তিযুদ্ধের নামে দীর্ঘদিন ধরে লুণ্ঠন, হত্যা, নির্বাচনহীনতা ও ইতিহাস বিকৃতির ভণ্ডামি চালিয়ে আসা রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সংকীর্ণ স্বার্থের জন্য ব্যবহার করেছে। এর ফলে নতুন প্রজন্মের একাংশ মুক্তিযুদ্ধকে ইতিবাচক প্রেরণার বদলে বিতর্কিত বা অস্বস্তিকর প্রতীকে রূপান্তরিত হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। এই বিকৃতি ও আত্মসাৎ-এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার আজ রাজনৈতিক বৈধতার মাপকাঠি নয়; বরং ক্ষমতা লুণ্ঠনের প্রতীক হয়ে উঠেছে। আর এই নৈতিক শূন্যতার সুযোগেই জামায়াত-শিবির নতুন করে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে।


নতুন মেরূকরণের ইঙ্গিত: বাংলাদেশের রাজনীতি এখন আর কেবল আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি’র দ্বন্দ্বে সীমাবদ্ধ নয়। ডাকসু’র ফলাফল দেখিয়েছে, দক্ষিণপন্থি শক্তি ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে একটি নতুন মেরূকরণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হচ্ছে। রাজনীতিতে মেরূকরণ অনিবার্য, কিন্তু প্রশ্ন হলো-সেই মেরূকরণ কি প্রগতির পক্ষে দাঁড়াবে, নাকি প্রতিক্রিয়াশীলতার দিকে জাতিকে ঠেলে দেবে?
 

ভোটাধিকার প্রয়োগ: ডাকসুতে ছাত্রসমাজ নির্বিঘ্নে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছে, যা শুধু একটি নির্বাচন নয়-এটি দেশের গণতন্ত্রে তরুণ প্রজন্মের সক্রিয় ও নৈতিক অংশগ্রহণের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। ফ্যাসিবাদের পতন এবং জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে এটি একটি ঐতিহাসিক প্রমাণ যে, তরুণরা দেশের ভবিষ্যতের প্রতি তাদের নৈতিক প্রতিশ্রুতি জানাতে সক্ষম। এই ঐতিহাসিক অর্জনকে আমরা আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। কারণ, এটি দেখিয়েছে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং নৈতিক নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে তরুণ সমাজ-আত্মবিশ্বাস, সাহস ও আদর্শিক দৃঢ়তা প্রদর্শন করতে পারে।


দার্শনিক করণীয়:
১. আত্মসমালোচনা ও নৈতিক সংকল্প: গণতান্ত্রিক শক্তিকে স্বীকার করতে হবে যে, তারা তরুণদের কাছে নৈতিক অনুপ্রেরণা ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। আত্মসমালোচনাই ইতিহাসে নতুন সংশ্লেষ জন্ম দেয়।
২. নৈতিক জাগরণ ও প্রজাতন্ত্র নির্মাণ: নৈতিকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত রাষ্ট্রে কেবল প্রযুক্তি, সংগঠন বা ক্ষমতার কাঠামো পরিবর্তন যথেষ্ট নয়। জাতির চেতনায় নৈতিক জাগরণ আনতে না পারলে কোনো পুনর্গঠন টেকসই হবে না। নৈতিক জাগরণের মধ্যদিয়েই গড়ে উঠতে পারে ‘নৈতিক প্রজাতন্ত্র’। যেখানে ক্ষমতার লড়াই নয়, সত্য, ন্যায়, মানবিকমর্যাদা ও আত্মশুদ্ধি হবে জাতির রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিত্তি।
৩. শিক্ষার পুনর্গঠন ও জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিবর্তন: বিশ্ববিদ্যালয়কে ইতিহাস, দর্শন ও মানবিক চেতনার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষা শুধুমাত্র কর্মী নয়, স্বাধীনচেতা নাগরিক গড়ার দায়িত্ব পালন করবে।
৪. নৈতিক রাজনীতির ভিত্তি স্থাপন: রাজনীতি যদি কেবল ক্ষমতার দ্বন্দ্বে সীমিত থাকে, তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা ও মুক্তচিন্তার উপর ভিত্তি করে নৈতিক রাজনীতি গড়ে তুলতে হবে।
৫. বিকল্প দর্শন নির্মাণ ও আদর্শায়ন: জুলাই অভ্যুত্থানকে কেবল আবেগের মুহূর্ত নয়, স্থায়ী আদর্শে রূপান্তর করা অপরিহার্য। আন্দোলনকে দর্শন, নীতি ও সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
৬. ক্ষমতার কাঠামোগত পুনঃনির্মাণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি: নতুন রাজনৈতিক প্রকৌশল গড়ে তুলতে হবে, যেখানে যুবশক্তি, শ্রমজীবী, নারী ও প্রান্তিক জনগণ সকলে অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এটার শাসনতান্ত্রিক রূপ হবে- ‘অংশীদারিত্বের গণতন্ত্র’। অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক মডেল কার্যকর হবে, যখন সাম্য, মানবিকমর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের দর্শন জনজীবনের সংস্কৃতিতে গেঁথে যাবে।
ডাকসু’র ফলাফল একটি জাগ্রত সতর্কবার্তা। এটি স্পষ্ট করে দিচ্ছে, যদি আমরা তরুণ প্রজন্মকে নতুন রাজনৈতিক নৈতিকতা, মুক্তচিন্তার দর্শন এবং ইতিহাসের শিক্ষার আলো না দিতে পারি, তবে তারা শূন্যতা ও নীরবতার ফাঁকে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতে ধরা পড়বে। ভবিষ্যৎ রাজনীতির করণীয় তাই এককথায় সংজ্ঞায়িত: আমাদের ইতিহাসকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে, নৈতিক আদর্শকে পুনঃনির্মাণ করতে হবে, এবং ছাত্রসমাজকে নৈতিক ও দার্শনিক নেতৃত্বের বাহক হিসেবে নতুন মুক্তির রাজনীতির পথে যুক্ত করতে হবে। এতে নাগরিকচেতনা, সামাজিক সুবিচার ও মানবিক মর্যাদার নতুন ভ্রূণবীজ গড়ে উঠবে, যা কেবল বর্তমান নয়, ভবিষ্যৎ জাতির চরিত্রকেও স্থিরভাবে সংজ্ঞায়িত করবে। 


লেখক: গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
faraizees@gmail.com

অনুসন্ধান'র অন্যান্য খবর