প র্য বে ক্ষ ণ

ভোটের মাঠে ‘আমরা সবাই রাজা’

সোহরাব হাসান | অনুসন্ধান
সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২৫
ভোটের মাঠে ‘আমরা সবাই রাজা’

নির্বাচনী মাঠে যেন ‘আমরা সবাই রাজা।’ নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, রাজনৈতিক মহলে বিতর্কও তত বাড়ছে। সমপ্রতি জামায়াতের এক নেতা চট্টগ্রামে বললেন, আগামী নির্বাচনে তারাই সরকার গঠন করবেন, বিএনপি বিরোধী দলের আসনে বসবে।
অন্যদিকে তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টির আরেক নেতার দাবি, আগামী নির্বাচনে তাদের দলই সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাবে। আর বিএনপি’র হিসাবনিকাশ হলো প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় তাদের বিজয় কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। রাজনীতিতে বর্তমানে যেই ধারা বইছে, সেটা অব্যাহত থাকলে কমপক্ষে বিএনপি ২৫০টি আসন পাবে। 
সভা-সমাবেশে প্রতিটি দলের নেতা তাদের পক্ষে গণজোয়ার দেখছেন। কিন্তু বাস্তবে যে কারও পক্ষে গণজোয়ার জাগেনি তার প্রমাণ  ‘জনগণের নির্বাচন-ভাবনা’ শীর্ষক জরিপ। ভোটারদের বড় অংশ এখনো কাকে ভোট দেবে, সে বিষয়ে মনস্থির করেননি। আবার যারা মনস্থির করেছেন, চিন্তাভাবনায় এলাকাভিত্তিক তারতম্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। 
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটাররা কাকে ভোট দেবেন-এমন প্রশ্নে দেশের আটটি বিভাগের মধ্যে ছয়টি বিভাগের উত্তরদাতারা বিএনপিকে এগিয়ে রেখেছেন। জামায়াত এগিয়ে রয়েছে রংপুর বিভাগে। আর বরিশাল বিভাগে এগিয়ে রয়েছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ দল আওয়ামী লীগ। বুধবার রাজধানীর জাতীয় আর্কাইভস মিলনায়তনে ‘জনগণের নির্বাচন ভাবনা’ শীর্ষক জরিপের দ্বিতীয় দফার দ্বিতীয় পর্বের ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানানো হয়। জরিপটি পরিচালনা করেছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইনোভিশন কনসাল্টিং। সহযোগিতা করেছে নাগরিক প্ল্যাটফরম ভয়েস ফর রিফর্ম ও বাংলাদেশ রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস অ্যান্ড ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক (বিআরএআইএন)। জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন ইনোভিশন কনসাল্টিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবাইয়াৎ সারওয়ার। জরিপে অংশ নেয়া ১০ হাজার ৪১৩ জনের মধ্যে ৪ হাজার ৭২১ জন ভোটে নিজেদের পছন্দের দলের কথা জানিয়েছেন। জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট, খুলনা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগে এগিয়ে রয়েছে বিএনপি। এসব বিভাগে বিএনপিকে সমর্থন করেছেন যথাক্রমে ৪০ দশমিক ৮ শতাংশ, ৪৫ দশমিক ৭ শতাংশ, ৪৪ দশমিক ৭ শতাংশ, ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ, ৪১ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ ভোটার।
 

অন্যদিকে ৪৩ দশমিক ৪ শতাংশ উত্তরদাতার সমর্থন নিয়ে রংপুর বিভাগে এগিয়ে আছে জামায়াতে ইসলামী। আর ৩১ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতার সমর্থনে বরিশাল বিভাগে এগিয়ে রয়েছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগ। জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ভোটারের ক্ষেত্রে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি’র পক্ষে সমর্থন বেড়েছে, উল্টো ঘটেছে জামায়াতের ক্ষেত্রে। আর শিক্ষা বাড়ার সঙ্গে ভোটাররা মত দিয়েছেন জামায়াতের পক্ষে, উল্টো ঘটেছে বিএনপি’র বেলায়। জেন-জি ও নারীদের মধ্যে জামায়াতের সমর্থন বেশি।
জরিপের ফলাফলে বলা হয়েছে, ৩৯ দশমিক ১ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, আগামী সরকার গঠনের জন্য সবচেয়ে যোগ্য দল বিএনপি। জামায়াতকে যোগ্য মনে করেন ২৮ দশমিক ১ শতাংশ উত্তরদাতা। ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ উত্তরদাতা যোগ্য দল মনে করেন আওয়ামী লীগকে। আর এনসিপিকে যোগ্য মনে করেন ৪ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতা।
সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জন্মভূমি রংপুরে। একানব্বইয়ের নির্বাচন থেকে জাতীয় পার্টির প্রভাব প্রতিপত্তি বেশি সেখানে। আবার বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের জন্মস্থান বগুড়াও রংপুর বিভাগে অবস্থিত। সেক্ষেত্রে বিএনপি ও  জাতীয় পার্টিকে টপকে জামায়াতের জয় স্বাভাবিক বলে মনে হয় না। তাহলে কি জাতীয় পার্টিকে হিসেবের বাইরে রেখে এই জরিপ করা হয়েছে? জাতীয় পার্টির বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার বা নির্বাচন কমিশন। নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে সরকার। আর নির্বাচন কমিশন নৌকা প্রতীক স্থগিত রেখেছে। সমপ্রতি জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিতে যে ভাঙন এলো, তারও উদ্দেশ্য আগামী নির্বাচন। 
প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশের পর নির্বাচন কমিশন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন রোববার থেকে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। প্রথম দিনেই নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা হবে। সবাইকে আস্থায় আনতে হলে নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে। প্রতীক ও নিবন্ধন নিয়ে যেই বিতর্ক তারও শান্তিপূর্ণ সমাধান প্রয়োজন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, সংবিধান ও নির্বাচনী আইনে না থাকায় আনুপাতিক হারে ভোট করার কোনো সুযোগ নেই। তবে প্রতীকের বিষয়টি তারা দ্রুতই সমাধান করতে পারেন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুর রউফ ১৯৯১ সালে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি একটি উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসের কাছে হার মেনেছিলেন এবং সেই নির্বাচনের ফলাফল জাতীয় রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বদলে দিয়েছিল।
 

একইভাবে যে আওয়ামী লীগ আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল, তারাই আবার পরবর্তী সময়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সেই ব্যবস্থা বাতিল করে নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছিল। তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা বাতিলের পর যে তিনটি নির্বাচন হয়েছিল, তাতে জনগণ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। 
সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে নাসির উদ্দীন কমিশন এর আগে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৯৭২ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের প্রস্তাব। এতে সশস্ত্র বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, নির্বাচনে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগে পুরো আসনের নির্বাচন বাতিল করার কথা বলা হয়েছে, প্রার্থীর বিদেশে থাকা সম্পদের হিসাব দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এসব প্রস্তাব প্রার্থীর জবাবদিহির আওতায় আনা ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করি।  
তবে নির্বাচন কমিশন একক প্রার্থীর ক্ষেত্রে ‘না’ ভোটের বিধান রাখার যে প্রস্তাব দিয়েছে, সেটি সুষ্ঠু নির্বাচনের স্থলে কারসাজির সুযোগ বাড়িয়ে দিতে পারে। উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি’র ৪৯ জন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছিলেন। এসব আসনে ‘না’ ভোটের ব্যবস্থা থাকলে নির্বাচনের গুণগত কোনো ফারাক হতো কি? বরং জয়ী দল এ কথা বলার সুযোগ পেতো যে, তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত নয়। অতএব কোনো বিধান চালুর আগে এর পরিণামের কথাও কমিশনকে ভাবতে হবে। নির্বাচন কমিশন যদি ‘না’ ভোট চালু করতে চায়, সব আসনের জন্যই সেটি করতে হবে। এখানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী ব্যক্তিদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। 
 

নির্বাচন কমিশন জোটবদ্ধ নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলীয় প্রতীক বহাল রাখার কথা বলেছে। এটা গণতান্ত্রিক রীতির সঙ্গে কতোটা যায়, সেই প্রশ্নও উঠবে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটে প্রতীকের বিষয়টি উন্মুক্ত ছিল। কেউ জোটের প্রতীকে, কেউ দলের প্রতীকে নির্বাচন করেছেন। ২০১৮ সালে বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীরাও ধানের শীষ প্রতীকে ভোট করেছেন (যেহেতু জামায়াতের নিবন্ধন স্থগিত ছিল)। দলীয় প্রতীক রাখা নিয়ে ছোট দলগুলো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তাদের আশঙ্কা, এতে বড় দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা বাড়বে এবং ছোট দলের প্রার্থীদের বাড়তি ঝামেলায় পড়তে হবে। 
নির্বাচন কমিশনের যে প্রস্তাব সবচেয়ে বেশি আলোচিত, সেটি হলো পলাতক আসামিদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা। আদালত কোনো ব্যক্তিকে পলাতক ঘোষণা করলে তার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ থাকার কথা নয়। পলাতক আসামিকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার প্রস্তাবটি ছিল মূলত নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের। সে সময়ে নির্বাচন কমিশন এই প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত করেছিল। গত মার্চ মাসে তারা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে লিখিতভাবে জানিয়েছিল, এমন বিধান অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারে। এরপর কেন নির্বাচন কমিশন ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিলো, সেই প্রশ্নের জবাবে কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে উভয় পক্ষের সন্তুষ্টির ভিত্তিতে এটা করা হয়েছে। প্রশ্নটা সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টির নয়, আইনের। সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহ্‌দীন মালিক পলাতক আসামিদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার প্রস্তাব সমর্থন করে ন্যায্য প্রয়োগ নিশ্চিত করার কথা বলেছেন। রাজনৈতিক দলের নেতারা আইনের অপব্যবহার না হওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন।  
 

নির্বাচন কমিশন আরও যেসব সংশোধনী প্রস্তাব এনেছে, সেগুলোও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। যেমন লাভজনক প্রতিষ্ঠানে থাকা ব্যক্তিকে নির্বাচনে প্রার্থী হতে না দেয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি থেকে পদত্যাগ করা, মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দেশে ও বিদেশে থাকা সম্পদের হিসাব দাখিল করা। কমিশন প্রস্তাব করেছে, রাজনৈতিক দল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত অনুদান নিতে পারবে; কিন্তু ৫০ হাজার টাকার বেশি হলে সেটি চেকের মাধ্যমে নিতে হবে। এতে প্রতিদ্বন্দ্বী দল ও প্রার্থীর পাশাপাশি অনুদানদাতার আয়-ব্যয়েও স্বচ্ছতা আসবে ধারণা করি। জরিপের ফল যাই হোক না কেন, তিনটি প্রহসনমূলক নির্বাচনের পর দেশের মানুষ দেখতে চাইবে এবারের নির্বাচনটি অবাধ ও সুষ্ঠু হোক, মানুষ নির্ভয়ে ভোট দিতে পারুক। ভোটের আগেই যদি নেতারা জয়-পরাজয় নিশ্চিত করে ফেলেন, তা হলে তো নির্বাচনের প্রয়োজন হয় না। 
 

অনুসন্ধান'র অন্যান্য খবর