জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতিতে আত্মপ্রকাশ ঘটে জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি’র। শুরু থেকেই সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলছিল একেবারেই নতুন রাজনৈতিক দলটি। একই মঞ্চে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিসহ নানা ইস্যুতে আন্দোলন করা দল দু’টি হঠাৎ কেন প্রকাশ্যে বিরোধে জড়ালো এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত মে মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের দুইটি ফেসবুক স্ট্যাটাস ঘিরে বিরোধের সূত্রপাত। যদিও ওই দুইটি স্ট্যাটাসের মধ্যে একটি স্ট্যাটাস কয়েক মিনিটের মধ্যে ‘সরিয়ে ফেললেও’ অনলাইনে তার স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়ে। তবে সর্বশেষ জুলাই সনদে স্বাক্ষরকে কেন্দ্র করে গত সপ্তাহে জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সম্পর্কের ছন্দপতন ঘটে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ এটাকে রহস্যজনক বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, কী কারণে তাদের সম্পর্কের ফাটল ধরছে তা আমরা বাইরের লোকদের জানার কথা না। কিন্তু ’২৪ জুলাইয়ের আন্দোলন সংগ্রামে জড়িতদের মাঝে এ ধরনের অনৈক্য আমরা চাই না।
জানা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের রূপরেখা দেয়ার পর দুই দলের টানাপড়েন শুরু হয়। পরবর্তীতে সেপ্টেম্বরে পাঁচ দফা দাবিতে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ সমমনাদের সমন্বয়ে শুরু হওয়া অভিন্ন কর্মসূচিতে এনসিপি যোগ না দেয়ায় দল দু’টির সম্পর্কের অবনতি প্রকাশ্যে আসে। জামায়াত জুলাই সনদে স্বাক্ষরের পর সেটা চূড়ান্ত রূপ নেয়। ফলে ফেব্রুয়ারিতে এনসিপি দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর দুই দলের সম্পর্কের মাত্রা তলানীতে গিয়ে পৌঁছে।
যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এনসিপিকে উদ্দেশ্য করে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের দেয়া বক্তব্যে। অনেকেই মনে করেন গোলাম পরওয়ারের এ বক্তব্য দুই দলের মধ্যকার ফাটল প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে।
আবার কারও কারও মতে, ঘটনার সূত্রপাত এনসিপি’র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের একটি ফেসবুক পোস্ট নিয়ে। রোববার নাহিদ ইসলাম ফেসবুকে তার পোস্টে বলেন, জামায়াতে ইসলামী পিআর পদ্ধতি নিয়ে যে তথাকথিত আন্দোলন শুরু করেছিল আসলে সেটি ছিল এক সুচিন্তিত রাজনৈতিক প্রতারণা। পোস্টে তিনি বলেন, সেই আন্দোলন পরিকল্পিতভাবে করা হচ্ছিল ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার প্রক্রিয়া ও জাতীয় আলোচনাকে গণ-অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র ও সংবিধান পুনর্গঠনের আসল প্রশ্ন থেকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতেই।
নাহিদ ইসলামের এ বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে জামায়াতে ইসলামীও। এ সময় সাতক্ষীরায় দলীয় এক সমাবেশে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল গোলাম পরওয়ার বলেন, একটা দল ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বলেছে আমরা সংস্কার, অংশীদারিত্বের রাজনীতি, দেশ গঠন, অভ্যুত্থানে কোনো ভূমিকা রাখিনি। আরে বাবা তোমরা নতুন ছাত্রদের দল, রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলে আরও বহুদূর যাইতে হবে। জন্ম নিয়েই বাপের সঙ্গে পাল্লা দিও না।
তিনি বলেন, ওনারা চাচ্ছেন আমরা ওনাদের একটু সমালোচনা করি। কেউ তো ওনাদের নাম নেয় না। জামায়াতের মতো বড় দল বললে যদি আমাদের নাম মুখে নেয়। আমরা আপনাদের অতো আমলে নেই না। জামায়াতের রাজনৈতিক ম্যাচিউরিটি বোঝার জন্য আরও অনেক দূর যেতে হবে।
তাৎক্ষণিক এর কাউন্টার দেন দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন। তিনি বলেন, রাজনীতিতে একপক্ষ আরেকপক্ষকে ব্যাশিং করে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য দিয়ে থাকে। তবে এনসিপিকে নিয়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটি শুধু অসৌজন্যমূলকই না, রাজনৈতিক ঔদ্ধত্যপূর্ণও বটে। ওনারা সিনিয়র রাজনীতিবিদ, বয়সে আমাদের বাবা- দাদাদের বয়সী, ওনাদের কাছ থেকে এই ধরনের বক্তব্য আমরা প্রত্যাশা করি না। একইভাবে দলটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেছেন, গোলাম পরওয়ার যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা রাজনৈতিক সৌজন্যতাকে আরও এক ধাপ পিছিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, আইনি ভিত্তির নিশ্চয়তা না পেলে জামায়াতে ইসলামী জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশ নেবে না- এমনটাই ধরে নিয়েছিল এনসিপি। তাদের সামপ্রতিক রাজনৈতিক বক্তব্যেও সেই ইঙ্গিত ছিল। এনসিপিও আইনি ভিত্তি ছাড়া সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশ না নেয়ার বিষয়ে অনড় অবস্থান নেয়। সরকারের পক্ষ থেকে একাধিকবার অনুরোধ এলেও তারা অবস্থান পরিবর্তন করেনি। দলটির ধারণা ছিল, জামায়াতসহ আরও কয়েকটি দলও আইনি ভিত্তি ছাড়া অনুষ্ঠানে যাবে না। তবে শেষ পর্যন্ত জামায়াত তাদের পূর্ব সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে সরকারের আহ্বানে সাড়া দেয় এবং সনদে স্বাক্ষর করে। বিষয়টি ভালোভাবে নেননি এনসিপি’র নেতাকর্মীরা; সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জামায়াতের সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনাও করেন তারা।
জামায়াত ও এনসিপি’র একাধিক সূত্র জানায়, সনদ স্বাক্ষর নিয়ে দুই দলের মধ্যে পূর্বে যোগাযোগ ছিল এবং উভয় দলই শুরুতে আইনি ভিত্তি ছাড়া সনদে স্বাক্ষর না করার পক্ষে অবস্থান নেয়। তবে সরকারের বারবার অনুরোধ এবং রাজনৈতিক কৌশল বিবেচনায় শেষ পর্যন্ত জামায়াত অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এনসিপিকেও সে বিষয়ে জানায়। এমনকি সনদ স্বাক্ষরের দিন জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এনসিপি’র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে ফোন করে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে অনুরোধ করেন; কিন্তু নাহিদ তাতে সম্মত হননি। তার আগে জামায়াতকে স্বাক্ষর না করতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন এনসিপি’র নেতারা। কিন্তু এনসিপি’র সে অনুরোধ রক্ষা করেনি জামায়াত।
নাহিদ ইসলামের ফেসবুক পোস্টের বক্তব্য অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর দাবি করে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের প্রধান এহসানুল মাহবুব জুবায়ের রোববার রাতেই এক বিবৃতিতে বলেন, ফেসবুক স্ট্যাটাসে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম দাবি পিআর পদ্ধতির সমালোচনা করে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর। জামায়াতে ইসলামীর পিআর দাবির আন্দোলনকে প্রতারণামূলক ও রাজনৈতিক কৌশল বলে যে মন্তব্য করেছেন, তা সর্বৈব মিথ্যা ও দুঃখজনক। তিনি তার বক্তব্যের মাধ্যমে কী বোঝাতে চাচ্ছেন, তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। তার কাছে এ ধরনের বালখিল্য বক্তব্য জাতি আশা করে না।
এদিকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এই টানাপড়েন উভয় দলের ভিন্ন রাজনৈতিক কৌশল এবং স্বার্থের সংঘাতের ফল। জামায়াত যখন যুগপৎ আন্দোলনে অন্যান্য দলকে পাশে চাইছে, ঠিক তখন এনসিপি নিজস্ব পথে চলার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে এ দূরত্ব ভবিষ্যতে দু’টি দলের রাজনৈতিক সমীকরণে কী ধরনের পরিবর্তন আনবে, তা কেবল সময়ই বলতে পারে।