মতিয়া চৌধুরী ষাটের দশকে অগ্নিকন্যা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। অগ্নিঝরা বক্তৃতা ও আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তিনি এই খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। মতিয়া চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন; ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী ছিলেন, পরে সংগঠন বিভক্ত হলে একাংশ তার নামেই পরিচিতি পায়-‘ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপ’।
মতিয়া চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় রাজনৈতিক সূত্রে নয়, তার প্রয়াত স্বামী বজলুর রহমানের মাধ্যমে। তিনি ছিলেন আমার সম্পাদক। বাইরে থেকে রাশভারী ও গম্ভীর মনে হলেও মানুষটি ছিলেন খুবই বন্ধুবৎসল। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে দলমতের বিভাজন করতেন না, বজলুর রহমানের কাছে সাংবাদিকতার পাঠ নিয়ে কেউ কেউ তাকে সরানোর জন্য আন্দোলন করেছেন, কিন্তু তিনি তাদের সঙ্গে শেষ দিন পর্যন্ত বন্ধুত্বের সম্পর্ক রেখে চলেছেন। বজলু ভাইয়ের সূত্রেই মতিয়া চৌধুরী আমাদের মতিয়া আপা হয়ে যান।
তার বাবা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। একজন পুলিশ কর্মকর্তার মেয়ে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবেন, এটা তৎকালীন গভর্নর মোনায়েম খান মানতে পারছিলেন না। সরকার হুকুম দিলো, মেয়েকে রাজনীতি থেকে বিরত রাখতে হবে, অন্যথায় তাকে চাকরি ছাড়তে হবে। মতিয়ার মামা মোস্তফা জামাল হায়দার ছিলেন বজলুর রহমানের বন্ধু। সেই সূত্রে মতিয়া আপার সঙ্গে বজলু ভাইয়ের সখ্য তৈরি হয়। একবার বজলু ভাই অসুস্থ হয়ে পড়লে মতিয়া আপা তার সেবা শুশ্রূষা করেন। বাবার ওপর যখন সরকারের প্রচণ্ড চাপ তখন মতিয়া আপা একদিন বজলুর রহমানকে গিয়ে বললেন, বিয়ের বিষয়ে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ১৯৬৪ সালের জুনে তারা বিয়ে করলেন।
২. ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আগেই মতিয়া চৌধুরী আইয়ুব-মোনায়েম খানের জেলখানার অতিথি। সে সময় খুব বেশি মেয়ে রাজনীতি করতেন না। আবার রাজনীতি করে জেলে যাওয়ার সংখ্যা ছিল আরও কম। মতিয়া আপা তার জেলজীবনের ঘটনা নিয়ে লিখেছেন, ‘দেয়াল দিয়ে ঘেরা’। তার বই থেকে জানতে পারি, মতিয়া আপা ১৯৬৭ সালের ৮ই জুন গ্রেপ্তার হন। অভিযোগ, কয়েক মাস আগে নেত্রকোনায় এক জনসভায় তিনি আপত্তিকর বক্তৃতা দিয়েছেন। এরপর তাকে আটক করা হয় দেশরক্ষা আইনে। মুক্তি পান ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় ২২শে ফেব্রুয়ারি। জেলের ভেতরের ও বাইরের ঘটনাবলি একজন রাজবন্দিকে কীভাবে আলোড়িত করে ‘দেয়াল দিয়ে ঘেরা’ বইয়ে তা উঠে এসেছে।
৩. ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে মতিয়া চৌধুরী আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এর আগেই ন্যাপ নানা ভাগে বিভক্ত। তিনি একটি গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এর আগে অবিভক্ত ন্যাপের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। পাকিস্তান আমলে জাতীয় রাজনীতিতে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি যে ভূমিকা রেখেছিল, বাংলাদেশ আমলে সেটি পারেনি। এর জন্য ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের আওয়ামী লীগ তোষণ নীতিই দায়ী। এই অবস্থায় আরও অনেকের মতো মতিয়া চৌধুরীও আওয়ামী লীগে শেষ আশ্রয় খুঁজে নেন। সেটা ভালো হয়েছে কি মন্দ হয়েছে, সেই বিচার ইতিহাস করবে।
৪. ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে মতিয়া চৌধুরী প্রথমে কৃষি ও খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। পরে খাদ্য মন্ত্রণালয় অন্যের হাতে চলে যায়। কৃষিমন্ত্রী হিসেবে তিনি বিশ্বব্যাংকের ভর্তুকি কমানো নীতির বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন। তার সময়েই দেশ ধান উৎপাদনে অনেকটা স্বাবলম্বী হয়। কৃষকেরা ১০ টাকা দিয়ে ব্যাংকের হিসাব খোলার সুযোগ পান। মন্ত্রী থাকতে মতিয়া চৌধুরী আরেকটি কাজ করেছিলেন, তার এলাকায় একাত্তরের গণহত্যার শিকার পরিবারগুলোর পুনর্বাসন। পাকিস্তানি বাহিনী কয়েকটি গ্রামের প্রায় সব পুরুষকে হত্যা করে। জনপদের নাম হয়েছিল বিধবাদের গ্রাম। নিজের বেতন-ভাতা দিয়ে তিনি এই অসহায় পরিবারগুলোকে জীবিকার ব্যবস্থা করেছিলেন।
১৯৯৮ সালের বন্যায় উত্তরাঞ্চলে মঙ্গা দেখা দেয়। মানুষকে লাইন দিয়ে সরকারি ভাণ্ডার থেকে ত্রাণসামগ্রী নিতে হতো। অভাবী মানুষের কাছে ঠিকমতো ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানো হচ্ছে কিনা, সেটা দেখতে মতিয়া আপা একবার তাদের লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। এই খবর সে সময়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল।
৫. আওয়ামী লীগের নেতারা ক্ষমতায় থাকতে শতসহস্র কোটি টাকার সম্পদ করেছেন। বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন; আর মতিয়া চৌধুরী আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও সংসদের উপনেতা হয়েও মগবাজারের ৭০০ বর্গফুটের পুরনো একটি বাসায় থাকতেন। মন্ত্রিত্বের প্রথমবার সরকারি বাসা নিলেও দ্বিতীয়বার নেননি। সংসদের উপনেতা হিসেবেও এই বাসায় ছিলেন।
মতিয়া চৌধুরী আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও মন্ত্রী ছিলেন; কিন্তু কখনো তদবিরকে প্রশ্রয় দিতেন না। এ কারণে এলাকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একাংশ তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। ১৯৯৬-০১ সালে মন্ত্রী হিসেবে সাফল্য দেখিয়েছেন, এলাকার উন্নয়নে অনেক কাজ করেছেন। এরপরও ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ী হতে পারেননি দলের সুযোগ-সন্ধানী নেতাদের বিরোধিতার কারণে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তার কাছে তদবিরের জন্য গেলে তিনি দরখাস্তে একটি কথাই লিখে দিতেন, ‘বিধিমতো ব্যবস্থা নেয়া হোক।’ নির্বাচনের পর সেই এলাকার একজন আওয়ামী লীগ নেতা বড়াই করে বলেছিলেন, ‘তারাও বিধি মোতাবেক জবাব দিয়েছেন’।
৬. বজলু ভাইয়ের হৃদয়ঘটিত সমস্যা ছিল। একবার বিদেশ থেকে ফিরে এলে আমরা বিমানবন্দরে যাই তাকে নিয়ে আসতে। বিমান আসতে দেরি করছে। ভেতরে আমরা কোনোভাবে যোগাযোগ করতে পারছি না। মতিয়া আপা বারবার টেলিফোন করছেন। আমাদের কাছে জানতে চাচ্ছেন- বজলুর কী হয়েছে। শরীর খারাপ কিনা? আমরা যতই বলি বিমান আসতে দেরি হচ্ছে, তিনি আশ্বস্ত হতে পারছিলেন না। বললেন, আমাকে বলো, যেকোনো খবরের জন্য আমি প্রস্তুত আছি। সে যাত্রায় বজলু ভাই নিরাপদেই বাসায় ফিরে এলেন। দুর্ঘটনা ঘটলো ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। বজলু ভাইয়ের মৃত্যুর পর মতিয়া আপা একেবারে একা হয়ে পড়লেন।
৭. নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি আমি যখন দৈনিক সংবাদ-এ সাংবাদিকতা করি, তখন পত্রিকার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। নিয়মিত বেতন হতো না। আমাদের এক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী করো। বললাম, সংবাদ-এ কাজ করি। তিনি বললেন, সেটা তো জানি, আর কী করো। আমি লা-জবাব। সত্যি আর কিছু করতাম না। পাকিস্তান আমলে সংবাদের অবস্থা আরও খারাপ ছিল। বজলু ভাইকে তার এক বন্ধু জিজ্ঞেস করেছিলেন, সংবাদ-এ এত দিন কী করে টিকে আছেন। বজলু ভাই বললেন, ‘আমার স্ত্রীর কোনো খরচ নেই বলে আমার চলতে সমস্যা হচ্ছে না।’
মতিয়া আপা রাজনীতির ব্যস্ততার মধ্যেও নিয়মিত বই পড়তেন। একবার একজন জনপ্রিয় লেখকের একটি বইয়ের বিজ্ঞাপন দেখে তিনি আমাকে পৌঁছে দিতে বললেন; কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা হলে বললেন, এতে কী আছে? এ রকম বাজে বই লিখেও জনপ্রিয় হওয়া যায়।
বজলু ভাই থাকতে নিয়মিত তাদের বাসায় যেতাম। মতিয়া আপা নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াতেন। বছরের দুই ঈদেই বজলু ভাই ঘনিষ্ঠজনদের আমন্ত্রণ জানাতেন। বিশেষ করে সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের বন্ধু-সুহৃদদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগ করা রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। বজলু ভাই মারা যাওয়ার পর মতিয়া আপাও সেই রীতি বহাল রেখেছিলেন। সেখানে গেলে বজলু ভাইয়ের সুহৃদদের সঙ্গে দেখা হতো। বিতর্কের ভয়ে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতাম না।
৮. বন্ধু আশরাফ কায়সার ফেসবুকে একটি সচিত্র পোস্ট দিয়েছেন মতিয়া চৌধুরীকে নিয়ে। ছবিতে দেখা যায়, একটি নন এসি পুরনো বাসে তিনি পেছনের আসনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। সামনের আসনে কয়েকজন যাত্রী বসা। সামনে খালি আসন নেই বলে তিনি পেছনের দিকের আসন খুঁজছেন। পরনে হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি। হয়তো শেরপুরে তার নির্বাচনী এলাকা থেকে ঢাকায় আসছেন। কিংবা ঢাকা থেকে নির্বাচনী এলাকায় যাচ্ছেন। যখন ব্যক্তিগত গাড়ি থাকতো না বা ড্রাইভার ছুটিতে থাকতেন, তিনি এভাবেই আসা-যাওয়া করতেন। আশরাফ কায়সার ছবির ক্যাপশনে লিখেছেন, ‘এই মতিয়া চৌধুরীকেই মনে রাখবো।’