প্রজাতন্ত্রের সংবিধান গণআকাঙ্ক্ষা বা সময়ের চাহিদা পূরণে যথার্থ সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার রূপরেখা নির্মাণ না করে অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়েই ’৭২ সালে যাত্রা শুরু করেছিল। প্রজাতন্ত্রে জনগণের সার্বভৌমত্ব অর্থাৎ জনগণের মালিকানা সংবিধানের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য প্রতিফলিত হলেও বাস্তবে তা প্রতিফলিত হয়নি। ফলে শাসন ব্যবস্থার সংকট নিরসনে একদিকে ১৭ বার সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে, অন্যদিকে একদলীয় শাসন ও সামরিক শাসন-সহ ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছে। প্রতিটি সংবিধানের একটি দর্শন থাকে। রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দর্শন সংবিধানের প্রস্তাবনায় বিবৃত থাকে। প্রস্তাবনায় সংবিধানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও গতিপথ সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট করে তোলা হয় যা সংবিধানের অন্তর্নিহিত দর্শন। প্রস্তাবনায় জাতির সংগ্রাম ও আন্দোলনের মহৎ অর্জনগুলোর উল্লেখ থাকে। প্রস্তাবনা যদিও আইনগতভাবে সংবিধানের অপরিহার্য অঙ্গ নয় তবু এর নৈতিক তাৎপর্য অনেক গভীর।
১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে রাষ্ট্রের দর্শনগত ভিত্তি অর্থাৎ ১) সাম্য, ২) মানবিক মর্যাদা, এবং ৩) সামাজিক ন্যায়বিচার-এই ত্রয়ী আদর্শ ছিল সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের মহৎ প্রেরণা। কিন্তু সেই মহৎ ও অবিস্মরণীয় উচ্চারণ উপেক্ষা করে ’৭২ সালের সংবিধান প্রণয়ন করা ছিল বড় ধরনের ঐতিহাসিক ভুল। ফলে একটি জাতি-রাষ্ট্রকে দর্শনগত জায়গা থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া হয়।
সাম্য: রাজনৈতিক সাম্য বলতে এমন একটি অবস্থা বোঝায় যেখানে সমাজের সকল সদস্যের সমান রাজনৈতিক অধিকার এবং সুযোগ রয়েছে ভোট দেয়ার এবং নির্বাচিত হওয়ার। সাম্য মানে সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সাম্য। সাম্য মানে সকল মানুষের মর্যাদা ও সুযোগের সুরক্ষা দেয়া।
মানবিক মর্যাদা: মানুষের মানবিক মর্যাদা পরম। এটা বিনষ্ট করার কোনো উদ্যোগ রাষ্ট্র গ্রহণ করতে পারে না। রাষ্ট্র যুদ্ধরত অবস্থায় বা যেকোনো পরিস্থিতিতে জরুরি অবস্থা জারি করলে সাময়িকভাবে মৌলিক অধিকার স্থগিত হয়ে যায় কিন্তু কোনো অবস্থাতেই মানবিক মর্যাদা বিনষ্ট করা যায় না।
সামাজিক ন্যায়বিচার: সামাজিক ন্যায়বিচার বলতে একটি রাজনৈতিক এবং দার্শনিক তত্ত্বকে বোঝায়, যা সমাজে ব্যক্তিদের মধ্যে সম্পর্কের ন্যায্যতার ধারণা এবং একটি সমাজে সম্পদ, সুযোগ এবং সামাজিক সুবিধাগুলোর সমান অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা দেয়।
দর্শনগত নির্দেশনা ছাড়া এবং জনগণের অভিপ্রায় বিবেচনায় না নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় চাপিয়ে দেয়া মডেল দিয়ে অভিযাত্রা শুরু হওয়ায় শাসন ব্যবস্থায় ক্রমাগত ত্রুটি এবং বিকৃতি এসে যায়। গণতন্ত্রের কথা বলা হলেও শাসন ব্যবস্থা কেন্দ্রীভূত হয় বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের হাতে। সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার ফলে ক্ষমতা হস্তান্তরের সাংবিধানিক পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। চতুর্থ সংশোধনী অর্থাৎ সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ধ্বংস করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনে বঙ্গবন্ধু মনে করেছিলেন-এই ব্যবস্থাই হবে চিরস্থায়ী এবং অভঙ্গুর। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট এক নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের মধ্যদিয়ে এ প্রশ্নের দ্রুত নিষ্পত্তি হয়ে যায়। বাকশালের বিলুপ্তি ঘটে। গত ৫৩ বছর সামরিক শাসন-সহ দলীয়শাসন এমন কী ব্যক্তির প্রয়োজনেও সংবিধানে সংশোধনী আনয়ন করা হয়েছে। এসব বিষয় এত জানা যে-এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
গত ১৫ বছর শেখ হাসিনা সংবিধানকে তার ক্ষমতা দখলের একমাত্র হাতিয়ার করে ফেলে এবং তার সরকার পতনের আন্দোলনকে সংবিধানবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করে। জনগণ ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থার অবসান চেয়ে লড়াই করছে দীর্ঘদিন। কিন্তু পরিশেষে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে হাসিনার সর্বগ্রাসী অপশাসনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার কুফল রাষ্ট্রের ভিত্তি এবং সাংস্কৃতিক পরিকাঠামোতেও বিস্তার লাভ করেছে। এই অবস্থায় জনগণ নির্মোহ দৃষ্টিতে ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা দেখবার ও বুঝবার ফলে দু’টি অবিচ্ছেদ্য বিষয় উচ্চারণ করছে। তা হচ্ছে-শাসন ব্যবস্থার সংস্কার-পরিবর্তন এবং পুনর্গঠন জরুরি। এটাই ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের অভিপ্রায়। প্রজাতন্ত্রের পথেই অর্থাৎ গণতান্ত্রিক পথে সমাজ এবং রাষ্ট্রের চরিত্র পরিবর্তনের ধারা চালু করতে চায়। বৈষম্যবিরোধী রাষ্ট্র বিনির্মাণের প্রক্রিয়া সন্ধান করতে হবে দেশজ বৈশিষ্ট্য নিয়ে, এটাই আমাদের মহৎ প্রেরণা। কোনো দেশের অন্ধঅনুকরণ বিপ্লব নয়; আবার বৈশ্বিক সমর্থনপুষ্ট আন্তর্জাতিক বিপ্লবও নয়। এটা কোনো সুনির্দিষ্ট মতাদর্শে আবদ্ধও নয়, এটা নতুন স্বাধীন-সার্বভৌম ভূখণ্ডের অন্তর্নিহিত আদর্শ।
আমাদের অতীত ইতিহাস এবং শাসনব্যবস্থা পর্যালোচনা করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ আবিষ্কার করতে হবে। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত উদ্ভাবন করাই হবে-ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের প্রতি প্রকৃত বিশ্বস্ততা। সমকালীন বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য নতুন পথের সন্ধান করতে হবে। অতীতের শাসনকাঠামো এবং শাসনপদ্ধতির বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ আমাদেরকে মোহমুক্ত করবে।
ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের সন্ধিক্ষণে এখন আমরা দাঁড়িয়ে আছি। বৈষম্যহীন প্রজাতন্ত্র নির্মাণের চিত্রকল্প যথেষ্ট নয়; কীভাবে সেই পথে পৌঁছানো যাবে তাও আমাদেরকে আবিষ্কার করতে হবে। বিদ্যমান ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে উচ্চতর রাজনৈতিক ব্যবস্থায় উত্তরণ ঘটাতে হবে। শাসনকাঠামো ও শাসনপদ্ধতির পরিবর্তনের লক্ষ্যে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ এবং পরিবর্তনের ধারা শুরু করতে হবে। শুধুমাত্র প্রচারধর্মী বা স্লোগানধর্মী বক্তব্য দিয়ে একটি গণমুখী রাষ্ট্র নির্মাণ করা যায় না।
শুধুমাত্র দলীয় শাসন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে যেমন ব্যর্থ হচ্ছে, তেমনি গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা উপযোগী কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। দলীয়শাসন একরৈখিক-যা ভিন্নমত ও পথের উপস্থিতি স্বীকার করে না বা ভিন্ন কণ্ঠস্বরকে স্বীকৃতি দেয় না। দলীয় শাসনের এটা যে এক অলঙ্ঘনীয় সীমাবদ্ধতা, তা আজ দ্বিধাহীন ও সংশয়হীন চিত্তে আমাদের স্বীকার করতে হবে। গণতন্ত্রকে নির্বাসিত করে স্বৈরতন্ত্রকে গণতন্ত্রের বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করার কৌশলের সমাপ্তি ঘটেছে। ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে ঐতিহাসিক মুহূর্ত উপস্থিত হয়েছে। দলকেন্দ্রিক শাসনপদ্ধতির বিপরীতে প্রজাতন্ত্র নির্মাণে ভিন্ন কোনো মডেল নিয়ে হাজির হওয়া জরুরি। দলীয় শাসনের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভয়াবহ দিকগুলো উন্মোচিত হয়েছে, অগোচরে থেকে গেছে গণমানুষের অধিকার, যা ক্রমে-ক্রমে ফ্যাসিবাদে রূপ নিয়েছে। ফ্যাসিবাদের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে গিয়েছিল ভিন্নধর্মী কোনো বিকল্প ভাবনা, বিরোধী দলকে জনগণের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। প্রজাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-রাষ্ট্রের মালিকানার পক্ষে জনগণের প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনার প্রয়োজনে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এই প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি নিয়ে সব সময় সংকট-সমস্যা এবং এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ফলে প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজের বিভ্রান্তি, অসন্তোষ এবং সংশয় থেকেই গেছে, গণতান্ত্রিক ধারা বিকশিত হয়নি। সকল শাসক-দল গণতন্ত্রের এই সংকট এবং সমস্যাকে নিরসনের উদ্যোগ না নিয়ে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করেছে, নির্বাচনী প্রতারণার মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে রেখেছে এবং পরিশেষে রক্তক্ষয়ী গণবিক্ষোভে উৎখাত হয়েছে। শুধুমাত্র দলীয়শাসন ব্যবস্থায় প্রতিনিধিত্বের তাত্ত্বিক ভিত্তি বাংলাদেশের বাস্তবতায় অসার হয়ে পড়েছে। দলীয়শাসন-এ বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলসমূহ এখনো মনে করে-এই নামসর্বস্ব গণতন্ত্রের মহাপতন নিতান্ত সাময়িক এবং আবার তার পুনরুত্থান ঘটবে। কিন্তু তাদের এই ধারণাকে গুঁড়িয়ে দিতে- ফ্যাসিবাদের উৎসমুখ চিরকালের জন্য রুদ্ধ করে দিতে হবে, নতুন কোনো তত্ত্ব প্রয়োগ করে। অধিকারবিহীন, স্বাধীনতাবিহীন পরাক্রমশালী রাষ্ট্র বা পরম প্রতাপশালী দল গঠনের বিপরীতে-নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের রূপরেখা হাজির করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন দলীয় শাসনের নিয়ন্ত্রিত বাকসর্বস্ব গণতন্ত্রের বিপরীতে সমাজের সকল অংশের অধিকার-ক্ষমতা-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ‘অংশীদারিত্বের গণতন্ত্র’। ইতিমধ্যেই যা-রাজনৈতিকতাত্ত্বিক ও দার্শনিক সিরাজুল আলম খান শাসনতন্ত্র, শাসনতন্ত্রের রূপরেখা ও শাসনপদ্ধতি-জাতির কাছে উপস্থাপন করেছেন। প্রজাতন্ত্র কেবল রাজনৈতিকভাবেই নয়; সামাজিকভাবেও প্রজাতান্ত্রিক। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে জনগণের চূড়ান্ত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার অব্যাহত প্রচেষ্টাই প্রজাতন্ত্রকে বিকশিত করবে। বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রে উত্তরাধিকার সূত্রে কেউ পদ-পদবি দখল করতে পারবে না। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের পদ ও পদবি জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্বাচিনভিত্তিক হতে হবে। প্রতিনিধি নির্বাচনে সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
সংবিধানের অন্তর্গত সকল শক্তির উৎস হবে জনগণ এবং বাইরের কোনো কর্তৃপক্ষের প্রতি কোনো ধরনের অধীনতা থাকবে না। শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে। বর্তমান সীমিত গণতন্ত্রকে অংশীদারিত্বের গণতন্ত্র আরও সমপ্রসারণ করবে, আরও অধিকতর গণতন্ত্রের রূপ দেবে। রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমাদের যেমন অধিক মনোযোগী হতে হবে, তেমনি দেশের রাজনৈতিক-আর্থিক বাস্তবতা, ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি, জনগণের মনন ও চিন্তার স্তর এবং মূল্যবোধকে বিবেচনায় নিতে হবে। দ্বন্দ্ব, সংঘাত, অনৈক্য, বিভক্তির প্রশ্নকেও গুরুত্ব দিতে হবে। গণঅভ্যুত্থানে ‘গণচরিত্র’ যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে, ‘গণচরিত্র’ যেভাবে আন্দোলনে ব্যাপকতা দিয়েছে তা গভীরভাবে পর্যালোচনা করে ভবিষ্যৎ নির্মাণের পরিকল্পনা করতে হবে।
আমরা জনগণের জন্য রাজপ্রাসাদ বানানোর স্বপ্ন দেখাবো না, সমাজ থেকে ব্যক্তিগত মালিকানা বিলুপ্ত করতে পারবো না, চাইলেই শোষণহীন সমাজের আদর্শ বাস্তবায়ন করতেও পারবো না কিন্তু আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে আড়ম্বরহীন, সহজ-সরল এবং একটি পবিত্র জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখাতে পারবো। আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারের সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিতে পারবো। আমরা অতীতের ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন, অত্যাচার, অবিচার, শোষণ বা নির্যাতনের অবসান করে দ্রুত স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবো না, জনগণকে কল্পরাজ্যের বাসিন্দা বানাতে পারবো না। তবে সকল নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের বৈষম্যহীন বা অসাম্যের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে রাষ্ট্র যে কারও ব্যক্তিগত নয় বরং সবার, এই স্বর্ণযুগের সূচনা করতে পারবো। অন্তত রাষ্ট্র জনগণের জীবন সুরক্ষা দেবে, সশস্ত্র শক্তি নিরস্ত্র শক্তিকে হত্যা করবে না, এটুকু প্রতিশ্রুতি নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করতে পারবো। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা থাকবে জনগণের হাতে, উৎপাদন শক্তির হাতে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে সম্পৃক্তদের হাতে, সংস্কৃতিজন-সাহিত্যিক, কারিগর এবং প্রযুক্তিবিদদের হাতে। শাসন ক্ষমতায় শাসন কাঠামোতে এবং শাসনব্যবস্থায় জনগণের সকল অংশের অংশীদারিত্ব, সকল অংশের অন্তর্ভুক্তি হবে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী রাষ্ট্রের ভিত্তি। এভাবেই জনগণ হবেন সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী, সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মানের অধিকারী। এটাই হবে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিকল্প রাজনৈতিকব্যবস্থা। এভাবেই সংবিধান এবং আইন সংস্কার করে নতুন প্রজাতন্ত্রের অভিযাত্রা শুরু করতে হবে।
প্রজাতন্ত্রকে দর্শনের আলোকে নির্মাণ করতে হবে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় দর্শন হবে:
১) সাম্য, ২) মানবিক মর্যাদা এবং ৩) সামাজিক ন্যায়বিচার। এই ত্রয়ী আদর্শকে ভিত্তি করে রাষ্ট্র পরিচালনা নীতি হবে গণতন্ত্র অর্থাৎ Democracy is a Government of the People by the People and for the People.
এই আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র নির্মিত হলে দেখা যাবে যে- মার্কসীয় সমাজতন্ত্র, ইসলামিক প্রজাতন্ত্র, সোশ্যাল ডেমোক্রেট বা রাষ্ট্রধর্ম বা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী কারও জন্যই রাষ্ট্র কোনো পক্ষপাতিত্বে অবস্থান করছে না, কারও বিশ্বাসকে আহত করছে না, কারও মূল্যবোধকে অবজ্ঞা করছে না। বরং সকল মতবাদ এবং মূল্যবোধকেই অন্তর্ভুক্তি করছে।
সাম্য এবং মানবিক মর্যাদা বিনষ্ট হতে পারে এমন কোনো আইন-প্রণয়ন রাষ্ট্র করতে পারবে না। ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে রাষ্ট্র কারও প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারবে না। আজ শুধু সংবিধানের প্রস্তাবনার মধ্যেই বক্তব্য সীমিত রাখবো। বিদ্যমান সংবিধানের প্রস্তাবনায় জাতির অতীত ইতিহাসের কোনো স্বীকৃতি নেই। ’৭১ সালের ভয়াবহ গণহত্যা নিয়ে টুঁ-শব্দটিও নেই, এমনকি ভাষা আন্দোলনের উল্লেখও নেই। সর্বোপরি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ত্রয়ী আদর্শেরও উল্লেখ নেই।
জাতির সংগ্রামী অতীত, ভাষা আন্দোলন, আদর্শ এবং গণহত্যার মতো গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলকের উল্লেখবিহীন সংবিধান সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে না। তাই সংবিধানের প্রস্তাবনায়:
১. দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত ঐতিহাসিক অর্জন-সহ ভাষা আন্দোলনের অবদানের কথা উল্লেখ করতে হবে।
২. ১৯৭১ সালের ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম এবং ভয়াবহ গণহত্যার কথা উল্লেখ করতে হবে।
৩. রাষ্ট্রীয় দর্শন সাম্য-মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার অর্থাৎ এই ত্রয়ীদর্শনই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ-এটা লিপিবদ্ধ করতে হবে।
৪. প্রজাতন্ত্রের সংবিধানের প্রস্তাবনায় জুলাই ’২৪ গণহত্যার বিষয় উল্লেখ করতে হবে।
উপরোক্ত চারটি প্রস্তাবনা ছাড়াও যেহেতু ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে প্রজাতন্ত্র বিনির্মাণের আইনগত ও নৈতিক ঘোষণা এবং প্রজাতন্ত্র নির্মাণের দার্শনিক নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে, সেহেতু ১০ই এপ্রিলকে ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ ঘোষণা করতে হবে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংবিধান সংস্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপ হবে ১০ই এপ্রিলকে প্রজাতন্ত্র দিবস ঘোষণা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা। সংবিধানের প্রস্তাবনা নতুনভাবে হাজির করে শাসনকাঠামোর প্রশ্নে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবনা উত্থাপন করতে হবে।
লেখক: গীতিকবি ও সংবিধান বিশ্লেষক
faraizees@gmail.com