মানুষ এমনও আছে/কলিজা ভুনা কইরা দিলে/কইব লবণ কম হইছে/বিশ্বাস কইরা যারে তুমি/ বুকে দিলা ঠাঁই/ নিজে না খাইয়া তুমি/তারে খাওয়াইলায়/দেখবা তুমি বুকে জড়াইয়া/পিছে ছুরি বসাইছে/ মানুষ এমনও আছে...।
প্রিয়, হাসু আপা
আপনার পলাতক জীবনের তিন মাস হতে চললো। এখন আর আপনার আজগুবি কথা প্রতিদিন শুনতে হয় না। দেশের মানুষ আজগুবি কথা, নিজে দোষ করে অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়ার বাণী আর শুনতে হচ্ছে না। এতে মানুষের কান রিলিফ পেয়েছে। কানের যন্ত্রণাও নাকি অনেকের কমেছে। আর বিশেষ করে আপনার দলের নেতাকর্মীরা এখন আপনাকে নিয়ে কলিজা ভুনার গান গাইছে। ওই চরিত্রের সঙ্গে আপনাকে মিলাতে চাইছে। আরে চাইছে কি বলছি? আসলে ওরা মিলিয়ে ফেলেছে। আর বলছে কার জন্য এতদিন কাজ করলাম। কোন দল করলাম। যারা আমাদের মতো নেতাকর্মীদের গলায় ছুরি বসিয়ে নিজেদের প্রাণ বাঁচিয়েছে।
আপাগো, আজকে এসব কথা বলতে বসিনি। আজ বলতে চাইছি আপনার প্রধান যে গুণ, নিজের দোষ অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়া সেটা নিয়ে কিছু বলতে। তবে সব তো একসঙ্গে বলা যাবে না। কারণ একে তো আপনি পলাতক। অন্যদিকে নেতাকর্মীদের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলছেন। আবার এসব টেলিকথা ফাঁস করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এটা করে কি বুঝাতে চাইছেন মানুষ তা জানতে চায়। তবে প্রত্যেকেই এটার ভাবার্থ বুঝে। বুঝে বলেই এসবকে কেউ পাত্তা-টাত্তা দেয় না। বরং কেউ কেউ বলছে, আপনি ক্ষমতা হারিয়ে পাগল হয়ে গেছেন। যাকগে সেসব কথা- আপনি ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ পেয়ে সরকার গঠন করেন। কিছু দিনের মধ্যেই ২০০৯ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি প্রথম চালটি দিয়ে দিলেন বিডিআর বিদ্রোহের নামে। ৫৭ জন চৌকস আর্মি অফিসারকে খতম করে দিলেন। কিন্তু আপনার নিষ্ঠুরতার ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি। কিন্তু এখন আপনি দেশত্যাগী এক রাষ্ট্রবিহীন মানুষ। তাই সে সময়ের সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ ও আপনার তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজের মুখে বেরিয়ে এসেছে আসল তথ্য। যে তথ্য বলে দেয় এর পেছনে রয়েছে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। তাহলে একটু শুনে নেয়া যাক তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদের মুখের সে কথা। সম্প্রতি দেশ টিভি নিউজে তিনি সবিস্তারে বিডিআর বিদ্রোহের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। বলেছেন, গত ৫ই আগস্ট স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর বিডিআর বিদ্রোহের কিছু প্রত্যক্ষদর্শীগণ এবং পরিবারবর্গ তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। আমিও আমার ভূমিকা আপনাদের জানাতে চাই। বিডিআর বিদ্রোহ দমনে সেনাবাহিনী তথা সেনাপ্রধানের ভূমিকার কথা অনেকের জানা নেই, এবং তার নেতিবাচক ধারণা পোষণ করছেন। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের উপর একটি বই আমি লিখেছি। যা সহসাই প্রকাশ করা হবে। বিদ্রোহের ১৫ বছর ধরে আমরা শুধু বিগত সরকারের কথাই শুনে গেছি। এবং প্রকৃত ঘটনা অনেক কিছুই আমাদের জানা নেই। জনগণও জানতে পারেনি। সরকার এ ব্যাপারে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে এবং সেনাবাহিনীও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। যখন আমি আদেশ দিয়েছি তদন্ত কমিটি গঠনের তখন আমাকে বলা হলো-সরকার যখন তদন্ত কমিটি করছে তখন আবার সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এই তদন্ত কমিটি করার প্রয়োজন কি? প্রতি উত্তরে আমি বললাম একই ঘটনায় বিভিন্ন পর্যায়ে তদন্ত কমিটি হতে পারে। যদি একটা ব্যাটালিয়নে কোনো ঘটনা ঘটে, তাহলে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার তদন্ত আদালত করবেন। ব্রিগেড কমান্ডার করবেন। প্রয়োজন হলে ডিপ কমান্ডারও করতে পারেন। তদ্রূপ আমি আমার ৫৭ জন অফিসার হারিয়েছি, আমি মনে করি আমার দায়িত্ব- আমার জানার প্রয়োজন আছে, সেনাবাহিনীর জানার প্রয়োজন আছে। কেন তাদের হত্যা করা হলো। এবং এই হত্যাকাণ্ডের কারণ আমাকে জানতে হবে। এরপর এ তদন্ত কমিটি করতে গিয়ে যেসব প্রয়োজন তা আমি সরকার থেকে সহযোগিতা পাইনি। তদন্ত কমিটির নেতৃত্ব দিয়েছে লে. জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তাকে যে টার্মস অব রেফারেন্স দেয়া হয়েছে তাতে তিনি তদন্ত সম্পন্ন করতে পারেননি। কারণ হলো যারা এর সঙ্গে জড়িত ছিল তারা জেলে ছিল। তাদেরকে সম্মুখে আনা সম্ভব হয়নি। তাদেরকে প্রশ্ন করা সম্ভব হয়নি। এবং যারা বিভিন্ন আলোচনায় এদের সঙ্গে যুক্ত ছিল তাদেরও স্টেটমেন্ট নেয়া সম্ভব হয়নি। সেজন্য টার্মস অফ রেফারেন্স অনুযায়ী উনার দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হননি। সেনাবাহিনীর তদন্ত চলাকালীন জেনারেল জাহাঙ্গীর আমার কাছে এসেছেন। উনার প্রবলেমগুলো তুলে ধরেছেন। আমি নিশ্চিত তিনি বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হয়ে এই তদন্ত কমিটি পুনর্গঠন করে সম্পূর্ণ তথ্য বের করে, কারা এর সঙ্গে জড়িত তা নির্ণয়ে সক্ষম হবেন। এখানে একটি বিষয় জানাতে হয়, এই সরকার যখন গঠন হয় তখনই আমি জেনারেল জাহাঙ্গীরকে টেলিফোন করি। বলি তিনি যাতে এই তদন্ত কমিটির ব্যাপারে ব্যবস্থা নেন এবং জনগণ জানুক কারা এর সঙ্গে জড়িত। এবং কেন ৫৭ জন নিরপরাধ ও চৌকস অফিসারকে খুন করা হলো?
মইন উ আহমেদ বলেন-কী ঘটেছিল সেদিন পিলখানায়? কারা এর সঙ্গে জড়িত ছিল? কেন ৫৭ জন অফিসারসহ ৭৪ জনকে হত্যা করা হলো? সেনাবাহিনীর ভূমিকা কি ছিল? তা আমি সংক্ষেপে বর্ণনা করছি-২৫শে ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে সাতটায় প্রতিদিনের মতো তার কাজ শুরু করে। কর্মসূচিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিল। সেটি হলো জিএসপিসি’র মিটিং। এই মিটিংয়ের মাধ্যমে সেনাবাহিনী সিদ্ধান্ত নেয় নেক্সট ইয়ারে কি কি জিনিস বাস্তবায়ন করবে। এই সভার সভাপতি হলেন সেনাপ্রধান। মেম্বারসরা হলেন- সেনাবাহিনীর পিএসও স্কন নির্ধারিত ডাইরেক্টর, সিনিয়র অফিসার্স। সেদিন সকাল থেকেই আমি মিটিংয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আনুমানিক সকাল পৌনে ৯টায় সিজিএস লে. জেনারেল সিনহা ইবনে জামালী আমার অফিসে আসেন। বলেন, স্যার- আমাদের কাছে কিছু ৮১ মিলিমিটার মর্টার আছে। যেটা সেনাবাহিনী ব্যবহার করে না। এটা গুদামজাত করা এবং রক্ষণাবেক্ষণ আমাদের জন্য টাফ হয়ে যাচ্ছে। তবে বিডিআর ৮১ মিলিমিটার মর্টার ব্যবহার করে। আপনি যদি ডিজি বিডিআরের সঙ্গে কথা বলেন, তারা যদি ট্রান্সফার করে নিয়ে যায় আমাদের জন্য উপকার হবে। আমি প্রস্তাবের গুরুত্ব অনুধাবন করে এডিসি ক্যাপ্টেন জুনায়েদকে বলি ডিজি বিডিআরকে টেলিফোনে সংযোগ দেয়ার জন্য। এবং সে সংযোগ দিলো। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পরে ডিজি বিডিআর জেনারেল শাকিলের সঙ্গে আমার কথা শুরু হয়। আমি উনাকে ৮১ মিলিমিটার মর্টার গ্রহণের জন্য প্রস্তাব দেই। তিনি সানন্দে গ্রহণ করলেন। পরে আগের দিনের বার্ষিক প্যারেডের প্রশংসা করে আলোচনা সমাপ্ত করি। আলোচনায় মনে হয়েছে বিদ্রোহীদের পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি জানতেন না বলে আমার বিশ্বাস। যদি জানতেন তাহলে তিনি অবশ্যই আমাকে অবগত করতেন। ৯টা বাজার দুই মিনিট বাকি। আমি এবং সিজিএস জিএসপিসি মিটিংয়ের জন্য কনফারেন্স রুমের দিকে যাত্রা করি। হয়তো জেনারেল শাকিল তার অফিস থেকে সেন্ট্রাল দরবারে এটেন্ড করার জন্য একই সময়ে অফিস ত্যাগ করেন। সকাল ৯টায় জিএসপিসি মিটিং শুরু হয় এবং আমরা ব্যস্ত হয়ে যাই। সাড়ে ৯টার দিকে আমার প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি কর্নেল ফিরোজ কক্ষে প্রবেশ করেন। আমার কানে কানে এসে বলেন-স্যার পিলখানায় গণ্ডগোল হচ্ছে- আপনার দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। তাৎক্ষণিক সভা স্থগিত করে সিজিএস এবং ডাইরেক্ট মিলিটারি অপারেশনকে সঙ্গে নিয়ে আমার অফিসে এলাম। ঘটনা সম্পর্কে জানার জন্য আমি জেনারেল শাকিল এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে সংযোগ দেয়ার জন্য এডিসি ক্যাপ্টেন জুনায়েদকে নির্দেশ দেই। তাদের ফোন কন্টিনিউসলি ব্যস্ত ছিল। এরই মধ্যে সামরিক গোয়েন্দার মাধ্যমে পিলখানা সম্বন্ধে তথ্য আসা শুরু করলো। পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে সময় বাঁচাতে কারও নির্দেশ ছাড়া আমি ৪৬ ইন্ডিপেন্ডেটকে অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হতে নির্দেশ দেই। এবং তারা তাৎক্ষণিক প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে। যার নামকরণ করা হয় অপারেশন রেস্টো অর্ডার। এই পদক্ষেপ সম্পর্কে পিএসও এএফডি জেনারেল মবিনকে অবহিত করি। ৯টা ৪৭ মিনিটে ডিজি বিডিআরকে ফোনে পাওয়া গেল। আমি উনাকে জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে? তিনি এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমাকে বললেন। তিনি বললেন, দরবার চলাকালীন দুই জন সশস্ত্র সৈনিক দরবার হলে প্রবেশ করে। একজন আমার পেছনে এসে দাঁড়ায়। অপরজন দরবার হল ক্রস করে বাইরে চলে যায়। তার পরপরই বাইরে থেকে গুলির শব্দ আসে। এবং গুলির শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই দরবার হলে উপস্থিত সৈনিকরা গণ্ডগোল শুরু করে দেয়। তারা দরবার হল থেকে বের হয়ে যায়। আমি সেক্টর কমান্ডার এবং ব্যাটালিয়ন কমান্ডারদের পাঠিয়েছি- তাদের ফিরিয়ে আনতে। যাতে করে পুনরায় দরবার শুরু করা যায়। আমি তাকে আমার প্রস্তুতি সম্পর্কে জানাই। অনেকে মনে করেন ডিজি বিডিআর সাহায্যের জন্য আমাকে টেলিফোন করেছেন। এটা সত্য নয়। ৯টা ৫৪ মিনিটে আমি সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে মোবাইল ফোনে পেলাম। ইতিমধ্যে বিডিআর বিদ্রোহ সম্পর্কে অনেক তথ্য পেয়ে গিয়েছিলেন। আমি যে ব্যবস্থা নিয়েছি- তা উনাকে জানাই। তিনি জানতে চাইলেন কতোক্ষণ সময় লাগবে এই ব্রিগেডকে তৈরি করতে। আমি বললাম সাধারণত ৬ ঘণ্টা লাগে। কিন্তু তাড়াতাড়ি করলে আমরা দুই ঘণ্টায় করতে পারি। আমি ৪৬ ব্রিগেডকে পিলখানায় যাত্রা শুরুর আদেশ চাইলাম। তিনি আদেশ দিলেন। আদেশ পাওয়ার পূর্বে ব্রিগেডটি নরমাল ট্রেনিং অ্যাক্টিভিটেজে ব্যস্ত ছিল। তবে ৪৬ ব্রিগেড এক ঘণ্টার মধ্যে প্রস্তুত হয়ে যাত্রা শুরু করে। এসব সম্ভব হয়েছে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাকিম, কমান্ডার ৪৬ ব্রিগেড এবং ইউনিট অধিনায়কদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য। ব্রিগেড কমান্ডারের নেত্বত্বে ১০ জন অফিসার, ৬৫৫ জন সৈনিক নিয়ে উনি পিলখানার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সকাল সাড়ে ১০টায় ব্রিগেডের অগ্রভাগ দল জাহাঙ্গীর গেট ক্রস করে। এত কম সময়ে প্রস্তুত হয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল যা একটি বিরল কৃতিত্বের উদাহরণ। কিন্তু...। আগামী সংখ্যায় থাকছে সবকিছু।
হাসু আপা, সে পর্যন্ত ভালো থাকুন।