প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

দফায় দফায় নতুন দফা

মোজাম্মেল হোসেন | রোজনামচা
নভেম্বর ২, ২০২৪
দফায় দফায়  নতুন দফা

জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এর দেশ কাঁপানো ছাত্র-গণআন্দোলনে মরণপণ লড়াইয়ে আত্মাহুতি দেয়া নবীন শিক্ষার্থীরা কী কী দাবি তুলেছিলেন? যেসব দাবি আদায়ের জন্য তারা প্রাণ দিয়েছিলেন সেই দাবিগুলো পূরণ হওয়া তাদের অভিভাবক ও দেশবাসীর আকাঙ্ক্ষা। এত বিপুলসংখ্যক কিশোর-তরুণ ছাত্র ও শ্রমজীবী মানুষের আত্মদানের ফলে আন্দোলনে যখন বিজয় এসেছে, কর্তৃত্ববাদী অত্যাচারী দুর্নীতিপরায়ণ সরকারের পতন ঘটেছে তখন ওই শহীদদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে মনোনিবেশ করা গোটা জাতির কর্তব্য। 


কিন্তু এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা রকম কথা উঠছে, দায়িত্ব নেয়া অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতর ও বাইরের বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন ইস্যু তোলা হচ্ছে, তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে আলোচনা ও লেখালেখিতে, ততোধিক হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমধ্যমে তথা ফেসবুক ও ইউটিউবে। একটি অত্যাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল-মতের লোকের সমাবেশ ঘটেছে। অন্যান্য দেশের ইতিহাসে বড় রাজনৈতিক আন্দোলন বা বিপ্লবের পরে দেখা গেছে তাতে শামিল বিভিন্ন দল ও গ্রুপ নিজ নিজ লক্ষ্য অর্জনে অগ্রসর হয় এবং নিজ দৃষ্টিভঙ্গিকেই ‘জনগণের দাবি’ বলে আখ্যায়িত করায় ঐক্য ভেঙে যায়। আমাদের দেশেও পাকিস্তান আমলে ও স্বাধীনতা-উত্তর নিকট অতীতে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে অনেকগুলো দলের একত্রে ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে সফল আন্দোলন হয়েছে। যেমন আইউব খানের বিরুদ্ধে ‘ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি’ (ডাক) এবং এরশাদের বিরুদ্ধে ১৫-দল, ৭-দল ও ৫-দল। যেসব কর্মসূচিতে সব দল একমত, যেমন, স্বৈরাচারী শাসকের পদত্যাগ, অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান, নির্বাচিত দলের কাছে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর,  দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, ছাত্রবেতন হ্রাস ইত্যাদি সেইসব দাবিতে ঐকমোর্চা গঠন এবং অন্যান্য দাবি স্ব স্ব দলীয় মঞ্চ থেকে তোলার জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়। ন্যূনতম কর্র্মসূচি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ঐক্য অটুট রাখতে হয়, নইলে সর্বনাশ। কিছুটা দূরবর্তী লক্ষ্যভিত্তিক সুসংবদ্ধ রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী মোর্চার দৃষ্টান্তও আছে। যেমন সাম্প্রতিক অতীতে পশ্চিমবঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রাম ও তিরিশ বছর শাসন চালানো বামফ্রন্ট। 


বিস্ময়করভাবে আমাদের জুলাই আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দল ও মোর্চার নেতৃত্বে হয়নি। হয়েছে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা সুযোগের বৈষম্য সৃষ্টি করেছে মর্মে তার বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলনে সদ্যগঠিত ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামের একটি মঞ্চের ‘সমন্বয়ক’ পরিচয় দানকারী একটি ছাত্র গ্রুপের নেতৃত্বে। দাবি পূরণে সরকারের গড়িমসি, ভুল পদক্ষেপ ও অতিরিক্ত পুলিশি শক্তি প্রয়োগের কারণেই পরিণামে সরকার হেরে যায়। আন্দোলনের শেষভাগে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দাবিই ছিল না, রাজনৈতিক লিখিত ও উচ্চারিত কোনো কর্মসূচিও নয়। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে পরবর্তী রাজনৈতিক পদক্ষেপ কী হবে তার কোনো ঘোষণাও ছিল না। দেশে দেশে মানুষের রাজনৈতিক দীর্ঘ ইতিহাসে বিপ্লবী দল, বিপ্লবী নেতৃত্ব, বিপ্লবের কর্মসূচি ও লক্ষ্য এবং তার পক্ষে জনগণকে সংগঠিত করা ও জনগণের ব্যাপক সমর্থন তৈরি করা ছাড়া কোনো বিপ্লবের নজির নাই। তাই জুলাই অভ্যুত্থানকে কোনোভাবেই বিপ্লব বলা যায় না। 


তবে এত বড় একটি ঘটনা যে ঘটলো, দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এক প্রধানমন্ত্রীর তড়িঘড়ি পলায়নসহ এত বড় পরিবর্তন তার নিশ্চয়ই একটি বাস্তব পটভূমি, প্রয়োজন, পরিবর্তনের পক্ষে জনগণের বিপুল সমর্থনের ভিত্তি ইত্যাদি রয়েছে। এই বিষয়গুলোকে সঠিকভাবে চিহ্নিত ও অনুধাবন করে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে দেশকে সুস্থ, স্থিতিশীল ও বিকাশমুখী করার দিকে এগুনো এখনকার কাজ। কারণগুলো এতই সুবিদিত যে বিশদ উল্লেখের আদৌ প্রয়োজন নেই। ১৫ বছর ধরে পরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচনে জলজ্যান্ত কাপচুপির মাধ্যমে জাতিকে চরম ধাপ্পা দেয়া, নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা বদলের ও গণতান্ত্রিক বিকাশের পথ বন্ধ করা এবং স্বেচ্ছাচারিতায় গোষ্ঠীতান্ত্রিক লুটপাটে দেশকে দুর্নীতির অতলে তলিয়ে দেয়ার পরে শেখ হাসিনার সরকারের অপসারণ দাবির আর কোনো কারণ লাগে না। সরকার ও বিরাট আকারের শাসক দল সম্পূর্ণ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। 


এসব সুবিদিত হলেও দুটি বিষয়ে সংক্ষেপে আলোকপাত প্রয়োজন মনে করি। প্রথমত, শেখ হাসিনার দেড় দশকব্যাপী নির্বাচনী প্রতারণা ও অপশাসনের বিরুদ্ধে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি ও সহযোগী কয়েকটি দল দশ বছরব্যাপী আন্দোলন করেও সফল হয়নি। শেখ হাসিনা লৌহদৃঢ় মুষ্ঠিতে ধরে রেখেছিলেন এবং বিরোধীরা তার দুর্ভেদ্য দুর্গপ্রাচীরে ফাটল ধরানোর জায়গাটা খুঁজে পায়নি। নতুন যুগের ছাত্রনেতারা ‘স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল’ তত্ত্বটি কাজে লাগাতে পেরেছে। ফলে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় সরকারের পদত্যাগের পরে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের পথে অনেক অনিশ্চয়তার কাঁটা বিছানো হয়ে গেছে। 


দ্বিতীয় বিষয়টি নিয়ে কথা শেষ করা যাবে না। ভবিষ্যতে গবেষক ও ইতিহাসবিদরা এ নিয়ে অনেক কাজ করবেন। সেটা হলো হাসিনা-পতনের প্রায় সাত সপ্তাহ পরে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূস জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অধিবেশনের ফাঁকে ক্লিনটন ইনিশিয়েটিভের অফিসে দুনিয়ার সামনে ঘোষণা করলেন বাংলাদেশের আন্দোলনটি হঠাৎ হয়নি, এটি সুচারুভাবে পূর্বপরিকল্পিত এবং পুরো পরিবর্তনের পেছনের মস্তিষ্ক বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন তার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলমকে। এ-ও বললেন যে আন্দোলনের সময় লোকজন জানতো না কারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
প্রফেসর ইউনূস স্পষ্টত এই পরিচয় গোপন করাকে আন্দোলনের কৃতিত্বপূর্ণ কৌশল হিসেবেই তুলে ধরেছেন। ভবিষ্যতে ইতিহাসবিদরা বলবেন এই কৌশল কতোটা সৎ ও নৈতিক। বিপ্লবের  ইতিহাসে শাসকদের হাতে ধরা পড়ার হাত থেকে বিপ্লবের স্বার্থেই নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে নেতারা আত্মগোপনে থেকেছেন। লেনিন  থাকতেন, আবার সুযোগ বুঝে শ্রমিকদের সভায় ভাষণ দিয়ে পালিয়ে যেতেন। শ্রমিকরা তাকে প্রাণ দিয়ে আগলে রাখতো। বিপ্লবের আগমুহূর্তেও লেনিন ফিনল্যান্ডে ছিলেন। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি বহু বছর প্যারিসে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন যা ইরানের জনগণ জানতো। আমরা ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বলতে পারি কমিউনিস্ট নেতা মোহাম্মদ ফরহাদ, ছাত্রনেতা সাইফউদ্দিন মানিক, পঙ্কজ ভট্টাচার্য হুলিয়া মাথায় আত্মগোপনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সুযোগমতো প্রকাশ্য পথসভায়ও এসেছেন। শাসকদের কাছে আত্মগোপনে থাকা আর জনগণের কাছে আত্মপরিচয় গোপন করা এক জিনিস নয়। 


এ হলো নেতার পরিচয় গোপন রাখা। আর রাজনৈতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য? আমরা দেখছি বৈষম্যহীন ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা প্রথম যে ৪ দফা দিলেন তা হচ্ছে বিদ্যমান কোটা বাতিল, অনগ্রসর  গোষ্ঠী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের জন্য ন্যায্য কোটা রেখে মোট কোটা অনধিক ৫% করা। এরপরে অতি দ্রুত অগ্রসর আন্দোলনের দুই সপ্তাহের মধ্যেই একবার ৯ দফা ও আরেকবার ৮ দফা যথাক্রমে অসহযোগ আন্দোলনে করণীয় ও প্রধানত শহীদদের স্মৃতিরক্ষা বিষয়ে নির্দেশনা। 


যে আন্দোলনের কোনো রাজনৈতিক ইশতেহার নেই তা থেকে সরকার পতনের পর ক্ষমতাসীনদের দ্বারা শহীদদের স্বপ্ন, জনগণের অভিপ্রায় প্রভৃতি উল্লেখ করে বিভিন্ন লক্ষ্য ঘোষিত হচ্ছে। এগুলোর প্রধান সুরটি হচ্ছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও তার নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, যার মধ্যে ৭ই মার্চ, ১৫ই মার্চ প্রভৃতি দিবসকে সরকারি স্বীকৃতি থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। এক নম্বর সমন্বয়ক ও উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম জাতির পিতা নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন। আন্দোলনের স্বল্প সময়ে একাধিকবার নানা দফা ঘোষণা হয়তো প্রয়োজন ছিল। আর এখন সর্বশেষ গত ২২শে অক্টোবর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৫ দফা দাবি ঘোষিত হয়েছে। এর একটি দফা ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ দ্রুতই হয়েছে। অপর নজরকাড়া দুটি দফা হচ্ছে ১৯৭২-এর সংবিধান বাতিল ও ‘জুলাই বিপ্লবের চেতনার আলোকে প্রক্লেমেশন অফ রিপাবলিক’ ঘোষণা করতে হবে। শেষোক্ত দাবিটির আগামাথা এখনো তেমন বোঝা যায়নি। ‘জুলাই বিপ্লবের’ মতো এই দাবিগুলোও কি আগেই সুচারুভাবে পরিকল্পনা করে রাখা হয়েছিল? তাহলে জনগণের কাছে গোপন কেন রাখা হবে?   


যে শহীদদের  অভিপ্রায় পূরণের কথা এখন বলা হচ্ছে তারা কিন্তু এই দফায় দফায় নতুন দফার রাজনৈতিক দাবিগুলো শুনেও যাননি, কোনো ছাত্র একটিবার স্লোগানও দেয়নি। তাই অভিপ্রায়ের জন্য কি শহীদদের বরাত দেয়া যায়, যারা এসে আর নিজেদের মতামত দিতে পারবেন না?
তবে এত বড় বিপ্লবাত্মক অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশ নেয়ার পেছনে অবশ্যই জনগণের স্বপ্ন ও অভিপ্রায় রয়েছে। তা গোপন নয়। এবং তা বহু বছরের। তা হচ্ছে গণতন্ত্র, সুশাসন ও জনগণের কল্যাণমূলক রাষ্ট্র, যা শেখ হাসিনার শাসনে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। যারা দফায় দফায় নতুন দফা হাজির করছেন সেই সন্তানতুল্য ছাত্র ও তরুণ নেতাদের প্রতি আমাদের আবেদন, জনগণের এই সরল আকাঙ্ক্ষা ও অভিপ্রায়  পূরণের পথ কোনো গোপন সুচারু পরিকল্পনা দিয়ে বাধাগ্রস্ত করবেন না। 

রোজনামচা'র অন্যান্য খবর