বাংলাদেশে ‘জাতির পিতা’ প্রশ্নে কখনো রাজনৈতিক ঐকমত্য হয়নি এবং আজ পর্যন্ত সাংবিধানিকভাবেও জাতির পিতা গৃহীত হয়নি। দলগতভাবে আওয়ামী লীগ এই দাবি উত্থাপন করলেও অতীতে প্রজ্ঞা ও বিবেচনা বোধে কখনো বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে ঘোষণার কোনো দাবি উত্থাপন করেনি। স্বাধীনতার ইশতেহারে ‘জাতীয় পতাকা’ ও ‘জাতীয় সংগীত’ নির্ধারিত হলেও ‘জাতির পিতা’ প্রশ্নে কাউকে নির্ধারণ করা হয়নি। তবে বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে মর্যাদা দেয়া এবং ঘোষণা করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পরও আওয়ামী লীগ কখনো সাংবিধানিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির পিতা’ ঘোষণার কোনোরকম উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এমনকি বঙ্গবন্ধুকে সাংবিধানিকভাবে মর্যাদাদানের বিষয়েও আওয়ামী লীগের কোনো ইচ্ছা বা অভিপ্রায়ের প্রতিফলন হয়নি।
১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে যেমন বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা ঘোষণা করা হয়নি, তেমনি স্বাধীনতার পর ’৭২ সালেও জাতির পিতা তো দূরের কথা, বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথাও সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়নি। যদিও বিশ্বের বহু সংবিধানে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতাদের অপরিসীম অবদানের কথা সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখ রয়েছে। ভিয়েতনাম, চীন, কোরিয়া ও তুরস্ক-সহ অনেক দেশের সংবিধানে জাতি বা রাষ্ট্র গঠনে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সংগ্রামী পুরুষদের অবদান স্বীকার করে তাঁদের প্রতি সাংবিধানিক মর্যাদা নিশ্চিত করা হয়েছে। আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে- ’৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নের সময় গণপরিষদ বিতর্কে বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির পিতা’ বা সংবিধানের প্রস্তাবনায় তাঁর নাম উত্থাপনের জন্য কেউ দাবি উত্থাপন করেননি। গণপরিষদ বিতর্কে বা বিশ্লেষণে জোরালো বা গভীরভাবে কেউ বঙ্গবন্ধুর অবদানের জন্য সাংবিধানিক মর্যাদা দেয়ার তাগিদও দেয়নি। ’৭২ সালে অস্থায়ী সংবিধানের আদেশ অনুসারে গণপরিষদের সদস্য সংখ্যা ছিল ৪৬৯ জন। কিন্তু সদস্যপদ বাতিল, মৃত্যু ও অন্যান্য কারণে সেই সংখ্যা ৪০৪ জনে নেমে আসে। এই ৪০৪ জনের কেউই সংবিধানে বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির পিতা’ বা তাঁর প্রতিকৃতি সংরক্ষণের কোনো দাবি একবারের জন্যও উত্থাপন করেননি। গণপরিষদে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মানবেন্দ্র লারমা ও মো. আব্দুল আজিজ চৌধুরী ছাড়া সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগের। ’৭২-এর ১১ই জানুয়ারি থেকে ’৭৩-এর ৭ই এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ২০০ আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল তখনো বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির পিতা’ কিংবা তাঁর প্রতিকৃতি সংরক্ষণের কোনো আইন প্রণয়ন করা হয়নি।
’৭১ সালে বঙ্গবন্ধু যখন অবিসংবাদিত নেতা তখন এবং তারপর ’৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় তাঁকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে ঘোষণা করার প্রয়োজন অনুভব করেনি। কিন্তু যখন ক্ষমতায় আসীন হয়ে জনগণ থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন তখন থেকে আওয়ামী লীগ আবার রাষ্ট্রক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে- তাঁকে জাতির পিতা এবং স্বাধীনতার একক নেতৃত্বকারী হিসেবে উপস্থাপনের কূট-কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালে একদলীয় শাসনে বঙ্গবন্ধুকে বিনাভোটে রাষ্ট্রপতি করার আত্মঘাতী চতুর্থ সংশোধনীতে শুধুমাত্র তাঁর নামের পূর্বে হঠাৎ করে ‘জাতির পিতা’ শব্দ যুগলটি যুক্ত করে কিন্তু কোনোরকম আইন তৈরির মাধ্যমে তা স্থির করেনি। কারও নামের পূর্বে হুট করে ‘জাতির পিতা’ লিখে দিলেই রাজনৈতিক বা সাংবিধানিকভাবে তা গ্রহণযোগ্য হয় না; এই সাধারণ বিষয়টিও আওয়ামী লীগের জানা নেই।
স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় কোনো একক ব্যক্তির সর্বোচ্চ অবদানকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য ‘জাতির পিতা’ বা ‘স্থপতি’ বা ‘জনক’ বা ‘জাতির অভিভাবক’ হিসেবে নানান উপাধি প্রদান করা হয়। যেসব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় একাধিক ব্যক্তির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে সেসব রাষ্ট্রে কয়েকজনকে ‘ফাউন্ডিং ফাদার’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
কোথাও সাংবিধানিকভাবে বা কোথাও রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে সেইসব ব্যক্তির ঐতিহাসিক ভূমিকাকে শ্রদ্ধা বা সম্মান প্রদর্শন করা হয়। কোনো কোনো দেশে জাতির জনক বা রাজাকেই জাতীয় ঐক্য বা স্থায়িত্বের মূর্ত প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। জাপান, থাইল্যান্ড বা বৃটেনে রাজার প্রতি অসম্মান প্রকাশ করলে কঠোর ফৌজদারি শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়।
মহাত্মা গান্ধীকে ‘বাপুজি’ বা ‘জাতির পিতা’ উল্লেখ করা হয় কিন্তু সাংবিধানিকভাবে এর কোনো রেকর্ড নেই। অনেক স্বৈরশাসক নিজেরাই নিজেদেরকে খেতাব প্রদান করেন, যা তাদের শাসনের শেষ পর্যন্ত খুব কমই টিকে থাকে। অনেকে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পর, শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে গণবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করায় নিজেদের পদবি বা মর্যাদা হারান।
অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে- বাংলাদেশে ‘জাতির পিতা’ নির্ধারণ বিষয়ে সাংবিধানিকভাবে আজও কোনো আইন হয়নি, অথচ ‘জাতির পিতা’ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ছবি সংরক্ষণের আইন হয়েছে!
বাংলাদেশের প্রথম রাজনৈতিক দলিল বা সংবিধান হচ্ছে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’। যা ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার কর্তৃক জারি করা হয়। ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, জাতির পিতা হিসেবে নয়। পরবর্তীতে গণপরিষদ কর্তৃক প্রণীত ১৯৭২ সালের সংবিধানেও বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি, এমনকি ’৭২ সালের সংবিধানের কোথাও বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারিত হয়নি, ২৬শে মার্চে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টিও সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়নি এবং স্বীকৃতি দেয়া হয়নি।
’৭১-এর স্বাধীনতার ‘ঘোষণাপত্র’ বা ’৭২ সালের সংবিধান প্রণেতাগণ বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে কোনো প্রয়োজন বোধ করেননি। এমনকি শেখ হাসিনার কয়েক মেয়াদের শাসনামলেও সাংবিধানিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়নি। কেন তা করা হয়নি, এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ কোনোদিন ব্যাখ্যা প্রদান করেনি বা ব্যাখ্যা প্রদানের প্রয়োজনও অনুভব করেনি। অথচ মুখে মুখে বলে আসছে- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন ‘জাতির পিতা’।
সংবিধানে যেমন আইনের দ্বারা বাংলাদেশের ‘জাতীয় সংগীত’, ‘জাতীয় পতাকা’ ও ‘জাতীয় প্রতীক’- নির্ধারিত করা হয়েছে তেমনি আইনের দ্বারা ‘জাতির পিতা’ নির্ধারিত হয়নি। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ চরমভাবে ব্যর্থ এবং দলটি যে, রাষ্ট্র ও সংবিধান বিষয়ে খুব বেশি জ্ঞাত নয়- তা সুস্পষ্ট। তারা সংবিধানকে দেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে বিবেচনা না করে সবসময় দলের ইচ্ছাধীন হিসেবেই বিবেচনা করেছে, কোনোদিনই জনগণের অভিপ্রায় হিসেবে বিবেচনা করেনি। যেখানে সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশের ‘জাতির পিতা’ কে, সেই নামটাই নির্ধারণ করা হয়নি, সেখানে জাতির পিতার ‘প্রতিকৃতি’ সংরক্ষণ আইন (২০০১) প্রণয়ন করা মারাত্মক অজ্ঞতার নিদর্শন। এই আইনের অধীনে যে বিধান রয়েছে তা হলো, ‘যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের লক্ষ্যে জাতির পিতার প্রতিকৃতি সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃক সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করতে হবে।’ উল্লেখ্য, প্রণীত আইনটি ‘জাতির পিতার প্রতিকৃতি সংরক্ষণ ও প্রণয়ন আইন-২০০১’ নামে অভিহিত। কিন্তু এই আইনের মাধ্যমে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে যাঁর ছবি সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করার বিধান করা হয়েছে, তাঁর নামটিই তো সাংবিধানিকভাবে নির্ধারিত হয়নি! আইনটিতে চতুর্থ সংশোধনীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে’। প্রকৃতপক্ষে চতুর্থ সংশোধনীর কোথাও বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে কোনো আইন তৈরি হয়নি। এ ছাড়া তৎকালীন ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনা সরকার জানেই না চতুর্থ সংশোধনী বাতিল হওয়ার পর সে বিষয়টিকে উল্লেখ করার কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই। সুতরাং বাতিলকৃত চতুর্থ সংশোধনীর কোনো দফার বৈধতা দেয়ার সাংবিধানিক কোনো সুযোগ নেই।
প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্রীয়ভাবে যে প্রতিকৃতি বা ছবি সংরক্ষণের নির্দেশনা রয়েছে, সে ছবি কোনো দলের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা যায় কিনা! ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্মান প্রদর্শনের কোনো সুযোগ আছে কিনা! কারণ ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর রাষ্ট্রীয় কোনো স্থাপনা নয়। তারপরও মন্ত্রিপরিষদ সদস্যসহ রাষ্ট্রীয় অতিথিবৃন্দ ৩২ নম্বরে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন কীসের ভিত্তিতে! কোন যৌক্তিকতায়!
জাতির পিতার প্রশ্নে সাংবিধানিক অভিযাত্রায় বা স্বাধীনতার শুরুতেই কোনো ঐকমত্য ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এবং একদলীয় শাসনব্যবস্থাসহ নির্বাচনবিহীন দুঃশাসনে, অপ্রয়োজন ও অকারণে বঙ্গবন্ধুকে জড়িত করে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। যা বঙ্গবন্ধুর সম্মান এবং মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করেছে।
কালের পরিক্রমায় জাতির পিতার প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য স্থাপনের ক্ষীণ সম্ভাবনা থাকলেও, তাঁর কন্যার ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ও পলায়ন- বঙ্গবন্ধুর মর্যাদাকে দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এ অমীমাংসিত প্রশ্নের দ্রুত সমাধান আশা করা যায় না।
লেখক: গীতিকবি ও সংবিধান বিশ্লেষক faraizees@gmail.com