সংস্কারের গল্পটা অনেক বড় করে ফাঁদা হয়েছে। যেন আকাশ-পাতাল, স্বর্গ-মর্ত্য কতো কিছু সংস্কার করে ফেলা হবে তুড়ি মেরে। সংস্কারের যে প্রয়োজন আছে তা সকলেই স্বীকার করে, কেউ দ্বিমত করছে না। কিসের সংস্কার? দেশের আইন-কানুন, শাসনের বিধি-ব্যবস্থা, রাজনৈতিক নেতা ও দলের আচার-আচরণ-ব্যবহারের, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যপদ্ধতির সংস্কার। পনের বছরে তিনটি সংসদ নির্বাচন যখন বিরাট ধাপ্পাবাজি ও কারচুপিতে পার করানো সম্ভব হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাচারী শাসন যখন একচ্ছত্রভাবে কায়েম রাখা সম্ভব হয়েছে, দুর্নীতির বন্যা বইয়ে দেয়া গেছে কারও কাছে কোনো জবাবদিহি ছাড়াই, ইয়া বড় তা বড় রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের কোনো মতামত ব্যক্ত করা ছাড়া দলের নেত্রীর হুকুম কেন দাসানুদাসের মতো মান্য করে গেলেন, কেন উপর থেকে নিচ পর্যন্ত দলের কোনো স্তরে সংগঠনের নেতা নির্বাচন করা যায় না, কেন দলে ন্যূনতম গণতন্ত্র নাই, দলীয় তহবিলের হিসাব নাই, কেন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা পঙ্গু হয়ে পড়লো? তাই বিধি-ব্যবস্থার সংস্কার অবশ্যই দরকার।
যত ভালো পদ্ধতি ও ব্যবস্থাই হোক, দিনে দিনে তা ব্যবহারে জীর্ণ হয়, দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে অনেকাংশে অকেজো হয়ে পড়ে, তাই পদ্ধতি ও প্রতিষ্ঠান যুগোপযোগী, কার্যোপযোগী করতে সংস্কার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়াও। সবকিছুই কিছুদিন পর পর ঝালাই বা সংস্কার করতে হয়। আর পদ্ধতি-প্রক্রিয়ার যদি অপব্যবহার করা হয়, আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের শাসনের মতো নিয়ম-কানুন লঙ্ঘন করে আংশিক ধ্বংস বা বিকৃত করে ফেলা হয়, তাহলে সেই শাসন থামাতে পারলে জরুরি সংস্কারও প্রয়োজন হয়। পদ্ধতি-প্রক্রিয়ার মধ্যে কোনো ত্রুটি ছিল কি-না যার ফাঁক দিয়ে বিকৃতিসাধন সম্ভব হয়েছে তা বের করে মেরামত প্রয়োজন হয়। ছাত্র আন্দোলনে গত ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার অগণতান্ত্রিক ও স্বৈর ধরনের শাসন উৎখাতের পর প্রতিষ্ঠিত প্রফেসর ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে এরকমই একটি সংস্কারের দায়িত্ব এসে পড়েছে। কাজেই যে সংস্কারের কাজ তাঁরা শুরু করেছেন তার পটভূমি, লক্ষ্য, প্রকৃতি, যৌক্তিক সময়সূচি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা উচিত এবং তা জনগণকে জানিয়ে করতে হবে। শেষ পর্যন্ত যথাসম্ভব রাজনৈতিক ঐকমত্য ও ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অনুমোদন ছাড়া কোনো সংস্কারই কার্যকর হবে না। ধোঁয়াটে ধারণা বা অস্বচ্ছতা রেখে বিশেষ বিশেষ মহলের ইচ্ছা বা নিজস্ব এজেন্ডা অনুযায়ী সংস্কার করতে গেলে তা সফল তো হবেই না, জাতীয় ক্ষেত্রে অধিক বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে। সফলতা ও জাতীয় ঐকমত্যের জন্য এখানে ন্যূনতম অপরিহার্যতার দৃষ্টিভঙ্গি রাখতে হবে। ক্ষমতার ভাগ পাওয়া কোনো মহল বিশেষের অতি উৎসাহী বৈপ্লবিক বা মেকি বিপ্লবী সংস্কারের ইচ্ছা কার্যকর হবে না, বরং সে চেষ্টা করতে গেলে নতুন দ্বন্দ্ব ও জাতীয় বিভক্তির সৃষ্টি হবে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র-তরুণদের আন্দোলন দমাতে সরকারের অতিরিক্ত পুলিশি বলপ্রয়োগ ও অন্যান্য কিছু সন্দেহজনক কারণে অস্বাভাবিক সংখ্যায় তরুণরা গুলিবিদ্ধ হয়ে হতাহত হলে সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের জনঅসন্তোষের বারুদ-স্তূপে আবেগের স্ফুলিঙ্গে এক গণবিস্ফোরণ ঘটে ও তার ঢেউ প্রধানমন্ত্রীর আবাসিক কার্যালয় গণভবনে আছড়ে পড়ার পটভূমিতে প্রধানমন্ত্রী দেশত্যাগে বাধ্য হন এবং সরকারের পতন ঘটে। ছাত্ররা ৩রা আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের একদফা দাবি জানানোর একদিনের ব্যবধানে অর্থাৎ একরকম বিদ্যুৎ গতিতে, আন্দোলনের বার্তা গ্রামাঞ্চলে বৃহত্তর কৃষক-জনতার কাছে পৌঁছানোর আগেই, শহুরে অভ্যুত্থানে এই পতন ঘটে। বর্তমানে ডিজিটাল যুগ বিধায় বার্তা অতি দ্রুত ছড়ায় সত্য, তবে তা শিক্ষিত ছাত্র-তরুণদের জন্য যেমন সত্য, আমজনতার জন্য তেমন নয়। আমজনতার কাছে গোপন রেখে আবার কোনো অবাস্তব সংস্কারের পদক্ষেপ নেয়াও তাই সঙ্গত হবে না। সারা দেশের জনগণের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক যোগাযোগের সেতুবন্ধ নাই। রাজনৈতিক দলের নেতাদের মতো উপদেষ্টারা জনসভায় বক্তৃতা দেন না। দেয়ার কথাও নয়। সরকার সমর্থিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নবগঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা পুলিশ পাহারায় সারা দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঘুরে কিছু ছাত্রসভা করছেন। তাঁরা কি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন বা এটা কি সরকারের জনসংযোগ বা জনগণের সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপের বিকল্প হতে পারে? অথচ সংস্কার একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। তাই অন্তর্বর্তী সরকারকে ন্যূনতম অপরিহার্য সংসদাকারে থাকতে হবে যাতে রাজনৈতিক মতৈক্য সম্ভব এবং নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার সংস্কার কার্যকর ও জনমতের ভিত্তিতে সম্প্রসারণও করতে পারেন।
সরকার পতনের আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একদফা বা আন্দোলনের কোনো স্লোগান বা দাবিনামায় কোনোরকম সংস্কারের কথা বলা হয়নি। তবে শেখ হাসিনার প্রথমে নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস ও ক্রমশ স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার পটভূমিতে জনগণের দীর্ঘদিনের উত্থাপিত দাবি এবং বিএনপি প্রভৃতি দলের দীর্ঘ আন্দোলনের দাবিগুলোর মধ্যে জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়েছে তা হচ্ছে গণতন্ত্র চাই, ভোট দিতে চাই, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনে সরকার গঠন করা চাই যার থাকবে জনগণের কাছে জবাবদিহি এবং জনগণের বৈষম্যহীন সমান সুযোগসহ জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র। এসবের লক্ষ্যেই সংস্কার চাই। প্রকতৃপক্ষে আমাদের সংবিধানে এবং দেশের আইন-কানুনে অবাধ নির্বাচনসহ এইসব ব্যবস্থাদি আছে। আওয়ামী লীগ সেগুলো মানেনি বলেই স্বৈরাচারের সৃষ্টি ও জাতীয় অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যাতে গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি মেনে চলে সেটা নিশ্চিত করাই মূল বিষয়। সেদিক থেকে রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক দলের সংস্কারই অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে। এটা তো মুখের কথায় হবে না। গণতন্ত্র চর্চার মধ্যদিয়ে জনগণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সেটা হবে। এটা একদিনে হওয়ার বিষয় নয়। দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম ও চর্চার বিষয়। সংস্কার যেন সেই পথটা খুলে দিতে পারে- এটাই চাওয়া।
সরকার পতনের একদফা রাজনৈতিক দাবি উত্থাপন ও আন্দোলনকে চূড়ান্ত ধাপে নেয়ার আগে নেতাদের পরবর্তী রাজনৈতিক পদক্ষেপ সম্পর্কে কোনো নির্দেশনামূলক কথাই ছিল না। ৫ থেকে ৭ই আগস্ট তিন দিন দেশ ছিল সরকারহীন। তখন আল্লাহ আমাদের রক্ষা করেছেন। একমাত্র দৃশ্যমান কর্তৃত্ব ছিল সেনাবাহিনীর। গণভবন, সংসদ ভবন, বঙ্গবন্ধুর বাড়ি, জাদুঘর লুটতরাজ করা, সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য-স্মারক ভেঙে তছনছ করা হয়, প্রতিহিংসায় পুলিশসহ অজ্ঞাত সংখ্যক মানুষ হত্যা করা হয়, যেগুলোর বিচার এখন ‘মামলা হবে না’ আদেশ দিয়ে দায়মুক্তির চাদরে ঢেকে দেয়া হয়েছে।
এই পরিস্থিতি সাধারণভাবে গণতান্ত্রিক সংস্কারের অনুকূল বলে ধরা যায় না। তবে প্রফেসর ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে ধন্যবাদ যে তাঁরা সংস্কারের কাজ শুরু করেছেন ও এগিয়ে নিচ্ছেন। সঠিক পথে এগুলে জনগণ ও সকল দেশপ্রেমিক শক্তি অবশ্যই সহযোগিতা করবে। অস্বচ্ছতা বজায় রেখে ও হুকুম দিয়ে সহযোগিতা আদায় করা যাবে না।
প্রফেসর ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার ৮ই আগস্ট শপথ নিয়ে ক্ষমতায় বসার দুই সপ্তাহ পরে ২৫শে আগস্ট জাতির উদ্দেশ্যে প্রথম ভাষণে ‘রাষ্ট্র সংস্কারের কাজের’ কথাগুলো উচ্চারণ করেন এবং কিছু ক্ষেত্র চিহ্নিত করেন। এরপর ১১ই সেপ্টেম্বর ৬টি এবং ১৭ই অক্টোবর আরও ৪টি সংস্কার কমিশনের প্রধানদের নাম ঘোষণা করে কমিশন গঠন প্রক্রিয়া শুরু করেন। কমিশনগুলো হলো যথাক্রমে নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান, দুর্নীতি দমন, স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম, শ্রমিক অধিকার ও নারী বিষয়ক।
প্রথম ৬টির কাজ এগিয়ে চলেছে এবং গত ৪ঠা নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টা কমিশন প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করে অগ্রগতি অবহিত হয়েছেন। সে বিষয়ে সংবাদমাধ্যমকে তথ্য দেয়া হয়েছে। নাগরিকদের প্রস্তাব ও পরামর্শ নেয়ার জন্য ওয়েবসাইট খোলা হয়েছে যা সঠিক দিকনির্দেশক।
নিঃসন্দেহে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের স্বাভাবিক পথে দেশকে নেয়ার জন্য রাজনৈতিক দিক থেকে সংস্কারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি ক্ষেত্র হলো নির্বাচন ব্যবস্থা ও সংবিধান। শক্ত নিরপেক্ষ স্বাধীন নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ ঠিক করার মাধ্যমে এমন কিছু সুষ্ঠু ভোট নিশ্চিত করা এবং স্বৈরশাসন ফিরে না আসা নিশ্চিত করার জন্য সংবিধানে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করাই মোদ্দা কথা। কিন্তু উপদেষ্টামণ্ডলী ও সংস্কার কমিশনগুলোর বাইরে থেকে বৈষম্যহীন ছাত্র আন্দোলন ও নাগরিক কমিটির তরফে এমন কিছু অপ্রাসঙ্গিক কথা তোলা হচ্ছে যা আন্দোলন পর্যায়ে কখনো বলা হয়নি এবং বিভ্রান্তি, বিতর্ক ও অনৈক্য সৃষ্টি করতে পারে। এগুলো হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর গণপরিষদে গৃহীত বিদ্যমান সংবিধানকে ‘একদলীয়’, ‘মুজিববাদী’ প্রভৃতি অভিহিত করে তা বাতিল করা এবং আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনের বাইরে রাখার দাবি। এ ধরনের দাবি ও চাপ সৃষ্টি সংস্কার কমিশনগুলোর কাজকেও বিঘ্নিত করতে পারে। তাই এই সব বিষয় মাথায় রেখে অন্তর্বর্তী সরকারকে সতর্কতার সঙ্গে এগুতে হবে।