এ ই স ম য়

আওয়ামী লীগের ক্ষমা প্রার্থনা ও শেখ হাসিনাকে ফেরত আনা-না আনা বিতর্ক

সোহরাব হাসান | বিশেষ রচনা
নভেম্বর ২৩, ২০২৪
আওয়ামী লীগের ক্ষমা প্রার্থনা ও শেখ হাসিনাকে  ফেরত আনা-না  আনা বিতর্ক

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলীয় প্রধানসহ বেশ কয়েকজন নেতার অডিও ফাঁস হলেও এই প্রথম একজন নেতা দলের ও সরকারের অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার কথা বললেন। তিনি আওয়ামী লীগের অন্যতম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম।


আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ই আগস্ট দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যান। সেখানেই তিনি ভারত সরকারের ‘অতিথি’ হিসেবে আছেন। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কোথায় আছেন জানা যায়নি। কেউ বলছেন, তিনি ভারতে গিয়েছেন। কেউ বলছেন, দেশের ভেতরেই আত্মগোপনে আছেন। প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ বেলজিয়ামে আছেন। তিনিও একবার অডিও বার্তা দিয়ে নিশ্চুপ। অপর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীপু মনি বর্তমানে কারাগারে আছেন এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অন্যদের সঙ্গে তারও বিচার প্রক্রিয়া চলছে।


সমপ্রতি শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া কিছু ফোনালাপে জুলাই আন্দোলন ঘিরে অনুশোচনা দেখা যায়নি। আন্দোলনকে তিনি তার বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখছেন। তবে প্রথমবার অডিও সাক্ষাৎকারে ভুলের জন্য অনুশোচনা করতে এবং সঠিক বিচারে অপরাধ প্রমাণ হলে ক্ষমা চাইতেও আওয়ামী লীগের আপত্তি নেই বলে সময় সংবাদকে জানিয়েছেন দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম।


তিনি বলেন, ‘আত্মগোপনে থেকে অনুশোচনা কি কারাগারের ভেতরে বসে করবে আওয়ামী লীগ? কীভাবে করবে? ভুলগুলো প্রকাশ করেই আমরা জাতির কাছে শুধরানোর পথ দেখাবো। আমাদের পরিকল্পনা এখন তেমন।’


নাছিম কোনো রাখঢাক না রেখেই জানিয়েছেন, ‘প্রকৃতপক্ষেই আমরা যদি ভুল করে থাকি বা অন্যায় করে থাকি, সেই অন্যায়ের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই অথবা ক্ষমা চাইবো না এ ধরনের গোঁড়ামি আমাদের কাজ করে না। এই মানসিকতার দল আওয়ামী লীগ নয়’।


৫ই আগস্ট ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলের অধিকাংশ নেতাকর্মী আত্মগোপনে চলে গেছেন। সাবেক মন্ত্রী-উপদেষ্টাসহ বেশ কিছু নেতা কারাগারে আছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাইরে যেসব মামলা করা হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে, সেসব মামলার তদন্ত বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা  আছে। প্রথমত এসব মামলায় গয়রহ  আসামি করা হয়েছে। কোনো কোনো মামলায় আসামির সংখ্যা দু’শরও বেশি। আবার সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে করা মামলার সংখ্যাও প্রায় দু’শ। এর বেশির ভাগই হত্যা মামলা।
এই প্রেক্ষাপটে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করার জন্য ইন্টারপোলের কাছে রেড অ্যালার্ট জারি করার অনুরোধ জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে সরকারের পক্ষ থেকে ভারতের কাছে তাকে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ বা আহ্বান জানানো হয়নি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, এখনো পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তাদের কাছে এ বিষয়ে কোনো অনুরোধ জানানো হয়নি।  


বাস্তবতা হলো আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ভারত-বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে নানা বিষয়ে টানাপড়েন দেখা যাচ্ছে। ভারত মেডিকেল ও ব্যবসায়ী ভিসা বাদে সব ভিসা দেয়া বন্ধ রেখেছে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে। আদানি গ্রুপ বকেয়া বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের তাগিদ দেয়ার পাশাপাশি সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ঢাকা শেখ হাসিনাকে ফেরত দেয়ার অনুরোধ জানালে দিল্লি সেটা ভালোভাবে নেবে না, সেটা বাংলাদেশের কূটনীতিকেরাও মনে করেন।


গত তিন মাসে ভারতের কোনো পদস্থ কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর করেননি। নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস চেয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। কিন্তু দুইয়ে দুইয়ে চার মেলেনি বলেই সেটা হয়নি। তবে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী-উপদেষ্টার মধ্যে আলোচনা হয়েছে। ডিসেম্বরে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের বাংলাদেশে আসার কথা আছে। সেই সফরে দুই দেশের কূটনৈতিক টানাপড়েন কমবে কি-না সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না।


বাংলাদেশ থেকে ইন্টারপোলে রেড অ্যালার্ট জারি করলেই শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে ফেরত আনার সম্ভাবনা কম। সমপ্রতি বে-অফ বেঙ্গল সম্মেলনে ভারতীয় কূটনীতিকেরা কৌশলী জবাব দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিলে এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেছেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বহুমাত্রিক। কোনো একটি বিষয়ে এই সম্পর্ক আটকে থাকতে পারে না।


রেড অ্যালার্ট জারি করে রাজনৈতিক অতিথি বা ব্যক্তিত্বকে ফেরত আনার দৃষ্টান্ত কম। ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ফেরত আনার জন্য রেড অ্যালার্ট জারি করেছিল। তাকে ফেরত আনা যায়নি। ভারতে পালিয়ে যাওয়া ব্যবসায়ী পিকে হালদারকে ফেরত চেয়ে আওয়ামী লীগ সরকার দিল্লিকে একাধিকবার চিঠি লিখেছিল। কাজ হয়নি। সেখানে তার নামে মামলা চলমান আছে।


কোনো কোনো বিশ্লেষক শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার বিষয়ে তার সম্পাদিত ভারতের সঙ্গে চুক্তির দোহাই দেন। চুক্তির শর্তাবলী বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে সব নাগরিকের ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য নয়। ভারত ও বাংলাদেশ ২০১৩ সালে একটি প্রত্যর্পণ চুক্তি স্বাক্ষর করে, ২০১৬ সালে সেটি সংশোধিত হয়। এই চুক্তিতে দুই দেশের মধ্যে পলাতক আসামিদের দ্রুত ও সহজে বিনিময়ের কথা বলা হয়েছে। বিশেষ করে, এটি ভারতের উত্তর-পূর্বের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সদস্যদের ফেরত নেয়াই ছিল এর অন্যতম উদ্দেশ্য।


এ ছাড়া বাংলাদেশও জামা’আতুল মুজাহেদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর মতো সংগঠনের কারণে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিল, যেখানে তাদের অপারেটররা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে লুকিয়ে ছিলেন।


২০১৫ সালে এই চুক্তির ফলে ভারত সফলভাবে ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ আসামের (উলফা) শীর্ষ নেতা অনুপ চেটিয়াকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রত্যর্পণ করতে সক্ষম হয়। এরপর থেকে বাংলাদেশও ভারতকে আরও কিছু পলাতক আসামি হস্তান্তর করে।


চুক্তির মূল দিক হলো- ভারত ও বাংলাদেশ এমন ব্যক্তিদের প্রত্যর্পণের জন্য সম্মত হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, অভিযোগ আনা হয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।


তবে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা হলো- যার হস্তান্তরের জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ যদি ‘রাজনৈতিক প্রকৃতি’র হয়, তাহলে সেই অনুরোধ খারিজ করা যাবে। ২০১৩ সালে চুক্তি সইয়ের পর বাংলাদেশের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর জানিয়েছিলেন, রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীরা এই চুক্তির আওতায় পড়বে না।


সে সময়ে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য অনুপ চেটিয়ার একটি আবেদন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে ছিল। আদালতের সিদ্ধান্ত আসার আগে বাংলাদেশ সরকার কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে ভারতও এই কৌশল নিতে পারে বলে কূটনীতিকেরা মনে করেন। সে ক্ষেত্রে ভারত না চাইলে বাংলাদেশের পক্ষে তাকে ফেরত আনা কঠিন হবে।


কূটনৈতিক সূত্র বলছে, সরাসরি বাংলাদেশের অনুরোধ ফিরিয়ে না দিয়ে, ভারত বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলিয়ে রাখতে পারে। এই ধরনের সব চুক্তির ক্ষেত্রেই নানা ফাঁকফোকরকে কাজে লাগিয়ে আইনি বিশেষজ্ঞরা বিষয়গুলোকে কয়েক মাস বা বছরের পর বছর ধরে ঝুলিয়ে রাখতে পারেন। মুম্বইয়ে ২৬/১১ জঙ্গি হামলার ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত তাহাউর হুসেন রানার ক্ষেত্রে যেমনটা করেছে আমেরিকা। একইভাবে, শেখ হাসিনাকে নিয়ে ঢাকার অনুরোধ এলে, ভারতও কয়েক বছরের জন্য সেই অনুরোধ ঝুলিয়ে রাখতে পারে।


শেখ হাসিনার পক্ষে আইনি লড়াই
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না শেখ হাসিনার পক্ষে মামলা লড়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বৃহস্পতিবার সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাছান চৌধুরীর জামিন স্থগিত নিয়ে সাংবাদিকের ব্রিফিংয়ের সময় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তিনি  ‘আজ (গত বৃহস্পতিবার) আদালতে নিয়মিত শুনানির সময় কেউ একজন জানতে চান যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিটি) আমি কারও পক্ষে লড়বো কি-না। তখন আমি বলেছি, সুযোগ আসলে শেখ হাসিনার পক্ষেই লড়বো।’
তাকে প্রশ্ন করা হয়, অতীতে আপনি শেখ হাসিনা সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনায় সরব ছিলেন। এখন তার পক্ষে লড়তে চাইছেন। এটি আপনার আগের অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি-না?
জবাবে জেড আই খান পান্না বলেন, ‘অবশ্যই সাংঘর্ষিক। কিন্তু প্রত্যেক মানুষের আইনি সুবিধা পাওয়ার অধিকার আছে। মানবিক দিক বিবেচনা করেই আমি শেখ হাসিনার পক্ষে লড়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছি।’


১/১১-এর পরও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে আইনি লড়াই করতে দলের সমর্থক অনেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে পাওয়া যায়নি। সে সময়ে শফিক আহমেদ, মাহবুব আলম, কামরুল ইসলামসহ কয়েকজন এগিয়ে এসেছিলেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তারা পুরস্কৃতও হয়েছিলেন। শফিক আহমদ আইনমন্ত্রী, কামরুল ইসলাম প্রথমে প্রতিমন্ত্রী ও পরে খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। অন্যদিকে মাহবুব আলম ‘আমৃত্যু’ অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। 

বিশেষ রচনা'র অন্যান্য খবর