১৯৮১ সালের ১লা জুন, একজন জাতীয় বীর এবং অন্যতম সিপাহসালারকে সামরিক হেফাজতে গুলি করে হত্যা করা হয় এই বাংলাদেশে, যাঁর অসম সাহসিকতা, বীরত্ব এবং কীর্তি, সর্বোপরি মহৎকর্ম আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক বিরাট অংশকে আলোকোজ্জ্বল করেছে। যে বীর মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার বিজয় ছিনিয়ে এনেছে, কতো আঘাত-আক্রমণের সামনে বুক পেতে দিয়েছে, সে বীর নিজ জন্মভূমি ও নিজ রাষ্ট্রেই চরম অবহেলার শিকার। স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশে এই বীরের ভাগ্য যেনো সর্বনাশের সুতো দিয়ে গাঁথা। তাঁর হত্যার বিচার হয় না, তাঁর জন্মদিন বা মৃত্যুদিন জাতির কেউ স্মরণ করে না। মুক্তিযুদ্ধের এই দেশে তাঁর হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে কোনো সংগঠনও বিবৃতি দেয় না। এই বীরের প্রতি চরম অবহেলা নিয়ে কেউ টুঁ- শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করে না। যে বীর নিজ দেশেই বহিরাগত, নিজ মাটিতেই অবহেলিত- সে বীরের নাম মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর, বীরউত্তম।
মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর, বীরউত্তম স্বাধীনতা যুদ্ধের অসম সাহসী বীর, রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সিপাহসালার। তাঁর রক্ত-ঋণে আবদ্ধ জাতি। যিনি দেশের জন্য জীবনকে বাজি রেখে পাকিস্তানের শিয়ালকোটের প্যারা ব্রিগেড থেকে কয়েক হাজার মাইল অতিক্রম করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। কী পরিমাণ দেশপ্রেম থাকলে, স্বাধীনতার জন্য কী পরিমাণ আকুল আকাঙ্ক্ষা থাকলে আর ভেতরে কী পরিমাণ ন্যায়বিচারবোধ থাকলে একজন মানুষ জীবন-মৃত্যুকে তুচ্ছ করে সর্বোচ্চ বিপজ্জনক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন।
একাত্তরের উত্তাল তরঙ্গমালার মাধ্যমে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো, সেই সময় নিশ্চিত জীবনের মোহকে উপেক্ষা এবং পাকিস্তানি রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সাহসিকতার বিরল মহিমায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন আবুল মঞ্জুর। পাকিস্তান সেনানিবাসে অবরুদ্ধ অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের ডাক- তাঁর বিবেক ও আত্মাকে শাণিত করেছে। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কের জাল চিরতরে ছিন্ন করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ভয়-ভীতি অগ্রাহ্য এবং চরম আত্মত্যাগের অঙ্গীকার করে পাকিস্তানের শিয়ালকোট থেকে অভিযাত্রা শুরু করেন- হয় মৃত্যু, নয় স্বাধীনতা-এই মহানব্রতকে সঙ্গী করে! কারণ, পাকিস্তান থেকে পালানো মানেই মৃত্যুপরোয়ানাকে চোখের সামনে ঝুলিয়ে রাখা। ধরা পড়লেই কোর্ট মার্শাল শেষে মৃত্যুদণ্ড।
অর্জিত সকল সম্পদ ও সমৃদ্ধির নিশ্চিন্ত জীবন উপেক্ষা করে তিনি জীবন ও ভাগ্য সঁপে দেন স্বাধীনতার বেদিতে। যাঁরা বীর তাঁরা চায়- নিজের জীবন নয়, অপরের জীবন এবং স্বাধীনতাকে সুরক্ষা দেয়া।
মেজর আবু তাহের এবং মেজর আবুল মঞ্জুর দু’জনেই দেশ-মাতৃকার টানে জীবনের উপর চরম ঝুঁকি নিয়ে শিয়ালকোট থেকে ভারতের দিল্লিতে আসেন। তারপর আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
মেজর আবুল মঞ্জুর ৮ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সাতটি সাব-সেক্টর নিয়ে গঠিত ৮ নং সেক্টর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বিরাট ভূমিকা গ্রহণ করে। রাষ্ট্রের জন্য বিশ্বস্ত, বিচক্ষণ এবং নিবেদিতপ্রাণ, তিনি ৩১ বছর বয়সেই সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীন দেশে মাত্র ৪০ বছর বয়সেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হন বীর এই সিপাহসালার
মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। সর্বশেষ মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হয়ে সেনাবাহিনীর চিফ অফ জেনারেল স্টাফ ও ২৪তম ডিভিশনের জিওসি হন।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম আরেক বীর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, বীরউত্তম ১৯৮১ সালের ৩০শে মে এক সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হন। তাঁর হত্যাকাণ্ডের ৩৬ ঘণ্টা পর পুলিশের হেফাজত থেকে নিয়ে জেনারেল এম এ মঞ্জুর, বীরউত্তমকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
রাজনৈতিক স্বার্থে একজন বীরউত্তম, সেনাবাহিনীর জেনারেল ও দেশের সুযোগ্য একজন নাগরিককে হত্যা করার পর- কেউ মামলা করার দায় অনুভব করেনি। এমনকি যে সেনাবাহিনীতে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিয়োজিত ছিলেন সেই সেনাবাহিনী বা রাষ্ট্র তাঁর হত্যাকাণ্ড নিয়ে মামলা করার প্রয়োজন বোধ করেনি। ১৯৮১ সালের পর অর্থাৎ জেনারেল মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের ১৪ বছর পর ১৯৯৫ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি তাঁর ভাইকে হত্যা মামলা করতে হয়েছে।
ঘটনার বিবরণীতে জানা যায়- ১৯৮১ সালের ৩০শে মে রাষ্ট্রপতি থাকাকালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে একদল বিপথগামী সৈন্যের গুলিতে নিহত হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। তখন মেজর জেনারেল এম এ মঞ্জুর সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের জিওসি ছিলেন। জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশের হাতে আটক হন জেনারেল মঞ্জুর। পুলিশ হেফাজত থেকে ১লা জুন চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নেয়ার পর তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
মামলার অভিযোগপত্র অনুযায়ী, মঞ্জুরকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে জিয়া হত্যায় জড়িয়ে সামরিক হেফাজতে নিয়ে তড়িঘড়ি হত্যা করা হয়েছিল।
১৯৯৫ সালের ২৭শে জুন এরশাদ-সহ পাঁচজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। অভিযোগপত্রে বলা হয়- ‘এরশাদের নির্দেশে আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে মঞ্জুরকে হত্যা করে এবং লাশ গোপন করার চেষ্টা করে।’
সেই মামলা দীর্ঘ ১৯ বছর চলার পর ২০১৪ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি রায় দেয়ার তারিখ নির্ধারণ করে আদালত। জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলার রায়ের তারিখ হওয়ার পরও বিচারক পরিবর্তন করা হয়। সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদ ছিলেন এই মামলার অন্যতম আসামি। শেখ হাসিনা রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার জন্য রাজনৈতিক সুবিধা নেয়ার স্বার্থে সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদকে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে সর্বনাশা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এই মামলার ভয় দেখিয়ে এরশাদকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন নির্বাচনে পার্টনার করেছেন। শুধু তাই নয়, একজন মুক্তিযুদ্ধের বীর সিপাহসালারকে হত্যার প্রধান অভিযুক্তকে শেখ হাসিনা তার সরকারের বিশেষ দূত বানিয়ে নিজের ক্ষমতা ও স্বার্থ নিরাপদ করেছেন। সরকার একদিকে আসামিকে হত্যার জন্য অভিযুক্ত করছেন অন্যদিকে সেই আসামিকেই বিশেষ দূত বানিয়ে ক্ষমতাবান করেছেন। শেখ হাসিনা সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের সামনে মৃত্যুদণ্ডের রশি ঝুলিয়ে দিয়ে তাকেই আবার ফুলের মালা দিয়ে সংবর্ধিত করেছেন। জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলাকে শেখ হাসিনা রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন! শেখ হাসিনা আইনের শাসনের শেষ আশ্রয় স্থল- বিচার বিভাগকে ধ্বংস এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কোনো দায় বহন না করে মুক্তিযুদ্ধের অভূতপূর্ব মহিমার বয়ান তৈরি করে রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্রে একজন বীর সিপাহসালার, একজন বীরউত্তম, একজন সেক্টর কমান্ডার, একজন মেজর জেনারেলের হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন করার বিষয়কে আমরা সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে পারিনি। একজন বীরের রক্তঋণ আমরা এইভাবে শোধ করেছি! এভাবেই প্রতিদান দিয়েছি!
২০১৪ সালের পর গঙ্গা-যমুনা দিয়ে কতো পানি প্রবাহিত হলো, পদ্মা ব্রিজ নির্মাণ হলো কিন্তু চিরদুঃখী বীরের অধিকতর তদন্ত আর শেষ হলো না।
মামলাটির পুনঃতদন্ত চলাকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ ২০১৯ সালের ১৫ই জুলাই মারা যান। ২০২০ সালে মারা যান ডিজিএফআইয়ের সাবেক প্রধান আবদুল লতিফ। পরে ২০২১ সালের ১২ই জানুয়ারি পুনঃতদন্ত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পুলিশ সুপার কুতুব উদ্দিন। দুই আসামি মারা যাওয়ায় ২০২১ সালের ২৫শে জানুয়ারি তাদেরকে আসামির তালিকা থেকে বাদ দেন আদালত। মূল আসামিদের মৃত্যুর পর অধিকতর তদন্ত চিরতরে হয় তো শেষ হয়ে গেল কিন্তু হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্রে যা সংঘটিত হলো, ন্যায়বিচারকে যেভাবে উপেক্ষা করা হলো, তা জাতির জন্য অভিশাপ বয়ে নিয়ে আসবে। এসব আমাদের চূড়ান্ত অধঃপতনের ফলাফল।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে জন্ম নেয়া রাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের বীরদের হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে না, এটা গ্রহণীয় হতে পারে না। বীরদের অসম্মানিত করা মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্রের চরিত্র হতে পারে না।
ক্ষমতার স্বার্থে আমরা বিশ্বাসঘাতকতা, বিবেকের সঙ্গে সুবিধাজনক আপস এবং যেকোনো অন্যায়কে চমৎকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। বঙ্গবন্ধুর কন্যা ক্ষমতায় থাকার কারণে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন হতে পেরেছে। যে নাগরিকের সন্তান রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হতে পারবে না, সে সন্তান বুঝি তার পিতার হত্যার বিচার দেখতে পারবে না!
জেনারেল আবুল মঞ্জুর, বীরউত্তমের স্ত্রী-সন্তান অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে বিচারের রায়ের জন্য। এ রাষ্ট্রের জন্য যাঁর বিশাল অবদান আর সে রাষ্ট্র কী পরিমাণ অবহেলা-উপেক্ষা করে যাচ্ছে গত ৪৩ বছর যাবৎ! মুক্তিযুদ্ধের একজন বীর সিপাহশালারকে হত্যার মূল ঘাতকের বিচার চিরকালের জন্য আড়াল করে দিলো এই রাষ্ট্র!
যে আবুল মঞ্জুর রাষ্ট্রের স্বাধীনতার জন্য ঝড়-ঝঞ্ঝা, দুঃখ-বিপর্যয়ের মাঝে অবিচল ও অটল থেকে বিরল মহিমায় উজ্জ্বল, তাঁকে বলি দেয়া হয়েছে- মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়ে নিশ্চিন্ত মনে শান্তিতে পাকিস্তান ক্যান্টনমেন্ট অবস্থান করা এইচএম এরশাদের জন্য। একজন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নিজের জীবনকে বাজি ধরেছেন আরেকজন আত্মরক্ষার্থে আত্মগোপন করেছেন। স্বাধীনতার জন্য যিনি জীবনকে বাজি ধরেছেন, তাঁর চেয়ে যিনি আত্মগোপন করেছেন তার মর্যাদা বেশি। একজন যখন সর্বস্ব ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন আরেকজন তখন ধন-সম্পদে ডুবে আত্মতৃপ্তিতে বিভোর ছিলেন। যিনি সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন সময়ের পরিক্রমায় আমরা তাঁকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছি আর একাত্তরে হাত গুটিয়ে যিনি পাকিস্তানে বসে ছিলেন তাকে সংবর্ধিত করেছি। তবুও আমাদের কোনো অনুশোচনা হয় না!
লেখক: গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক faraizees@gmail.com