সা ফ ক থা

সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়া, কোথায় শেখ হাসিনা

মাসুদ কামাল | বিশেষ রচনা
নভেম্বর ২৩, ২০২৪
সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়া, কোথায় শেখ হাসিনা

সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়ার হাস্যোজ্জ্বল ছবিটা দেখে দেখে আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়েছিলাম। এই দৃশ্যটি আমার মধ্যে নানা ধরনের অনুভূতির জন্ম দিয়েছিল।
আমি ভাবছিলাম শেখ হাসিনার কথা, তার ঘনিষ্ঠ সহচরদের কথা, বিএনপি’র অগণিত নেতাকর্মীর কথা। এই ছবিটি তাদের মনে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে? মনে পড়ছিল খালেদা জিয়াকে ২০১০ সালে সেনানিবাসের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের সেই দৃশ্যগুলোর কথা। সেই যে সরকারি কর্মকর্তা, তিনি বোধকরি আইএসপিআরে চাকরি করতেন, যিনি সংবাদ সম্মেলনে এসে খালেদা জিয়াকে উৎখাতের বিষয়গুলো বিকৃত আনন্দ সহকারে সবিস্তারে প্রকাশ করছিলেন, তার কথাও মনে পড়ছিল। তার নামটি মনে নেই। তিনি এখন কোথায়? মনে পড়ছিল আমার সেই সব সাংবাদিক সহকর্মীদের কথা, যারা উৎখাতের পর খালেদা জিয়ার বেডরুমে ঢুকে বিভিন্ন ম্যাগাজিন বা জিনিসপত্র দেখিয়ে ওনার চরিত্র বিশ্লেষণের কৌশলী প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। আচ্ছা, তাদের মনে কি এখন কোনো অনুশোচনা কাজ করছে? তারা কি নিজের কাছে, নিজের পরিবারের কাছে কিছুটা হলেও সেই কর্মকাণ্ডের জন্য কিছুটা হলেও লজ্জিত? আমি জানি না। কিন্তু আমার জানার খুব ইচ্ছা করছিল।


একটা কথা এখানে বলে নেয়া ভালো, আমি কিন্তু বিএনপি করি না। বিএনপি’র কোনো পর্যায়ের সঙ্গেই আমার কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই। খালেদা জিয়ার প্রতি এই যে আমার চিন্তা, সেটা একজন রাজনৈতিক নেতার জন্য কেবল নয়। বরং আমি ভাবছি একজন সম্মানিত নাগরিকের কথা। তিনি দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতা, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, একজন সাবেক প্রেসিডেন্টের স্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডারের স্ত্রী, সর্বোপরি একজন নারী, একজন মা। এমন একজন মানুষকে এতটা অপমানজনক পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে আমরা আসলে কী অর্জন করতে চেয়েছি? আমরা কি তাকে অপমান করেছি, নাকি নিজেরাই অপমানিত হয়েছি? 
আপনাদের কী মনে হয় জানি না, কিন্তু আমি নিশ্চিত যে, শেখ হাসিনা একজন প্রতিহিংসাপরায়ণ ব্যক্তি। রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা যান, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে যারা থাকেন, তাদের মধ্যে এধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থাকাটা অত্যন্ত বিপজ্জনক। এরকম হলে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদের জীবন হয়ে ওঠে অনিরাপদ। সরকারে থাকা লোকদের হতে হয় উদার, ক্ষমাশীল। কিন্তু শেখ হাসিনা ছিলেন এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সে কারণে তার ক্ষমতাকালে মানুষের জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। নানামুখী নির্যাতন আর মামলা মোকদ্দমায়  বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের জীবন হয়ে পড়েছিল নাজেহাল। নেতা-কর্মী-সমর্থকরা তো বটেই তার প্রতিহিংসার আগুন স্পর্শ করেছিল বিরোধী দলের শীর্ষ নেতৃত্বকেও। খোদ খালেদা জিয়াকেও জেলে পুরেছিলেন এমন এক মামলায়, যার বিস্তারিত শুনলে আইন সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান থাকা মানুষও অবিশ্বাসে কপালে চোখ তুলবেন। আচ্ছা, এসব মামলার সেইসব জাঁদরেল আইনজীবী-মোশাররফ হোসেন কাজল, খুরশীদ আলম খানরা এখন কোথায়? সে সময় টিভি খুললেই চিবিয়ে চিবিয়ে ওনারা বলতেন, জাতিকে জানাতেন-খালেদা জিয়া কীভাবে ‘এতিমের টাকা মেরে খেয়েছেন’। মির্জা ফখরুল কীভাবে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি ভাঙচুর করেছেন, আগুন দিয়েছেন! ওনাদের জ্ঞানী জ্ঞানী কথা শুনতে এখন খুবই মন চায়! 


খালেদা জিয়া কিন্তু আবার ক্ষমতায় গিয়ে বসেননি। উনি কেবল সেনাকুঞ্জে একটা অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছেন অতিথি হিসেবে। ক্ষমতায় এখন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। উনিই দেশ চালাচ্ছেন। রাজনৈতিক কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে বিএনপি’র সঙ্গে ইউনূস সাহেবের কিছু মতবিরোধও আছে। বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দু’দিন আগে বলেছেন, তিনি কিছু ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন। তার এমন মন্তব্যে ড. ইউনূসের সরকার একেবারেই বিব্রত হননি-তা বলা যাবে না। সেভাবে দেখলে ড. ইউনূস বিএনপি কিংবা এর নেতৃবৃন্দের প্রতি কিছুটা অখুশি থাকতেই পারেন। কিন্তু সে সবের কোনো কিছুই কাজ করেনি খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসে হয়ে যাওয়া এ অনুষ্ঠানে দাওয়াত করার ক্ষেত্রে। বরং তিনি বলেছেন, ‘শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া এখানে এসেছেন। ১২ বছর তিনি আসার সুযোগ পাননি। তাকে এই সুযোগ দিতে পেরে আমরা গর্বিত। ‘এটাই সৌজন্য, এটাই ভদ্রতা, যা গত দেড় দশকে পুরো জাতিকে ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল। 


গত পনের বছরে আমরা কী দেখেছি? দেখেছি-জাতিকে বিভক্ত করার, করে রাখার এক জঘন্য প্রচেষ্টা। ‘চেতনা’-নামে একটা শব্দ আমদানি করা হয়েছিল। আর এর সহযোগী শব্দ ছিল-মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, রাজাকার, উন্নয়ন ইত্যাদি। এসব বলে বলে ঘরের মধ্যে আর একটা ঘর বানানো হয়েছিল। শিশুদেরকে পর্যন্ত শেখানো হয়েছিল-তোমার প্রতিবেশী যে লোকটিকে দেখছো, প্রতিদিন যার সঙ্গে নিয়মিত তোমার দেখা হয়, সেও কিন্তু তোমার শত্রু। কারণ তার চেতনা মুক্তিযুদ্ধ বা উন্নয়নের কথা বলে না। বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, তোমার মামার শ্যালক বিএনপি করে, অতএব তুমি সরকারি চাকরি পাবে না। অথবা তোমার চেয়ে তোমার সহপাঠী অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের কাছে, কারণ তার দাদার কাছে ‘মুক্তিযোদ্ধা’র সার্টিফিকেট আছে। 


দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে, গত ৫ দশক ধরে আমরা এই ভয়ঙ্কর নীতিরই চর্চা করছি। প্রতিটা দিন তার আগের দিনের চেয়ে বেশি বিভক্ত হচ্ছি। এরই অবসান চেয়ে ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমেছে। এই যে গণঅভ্যুত্থান, যার প্রবল স্রোতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে শেখ হাসিনা, আমার বিবেচনায় এর মূল লক্ষ্যই ছিল পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা। ড. ইউনূসের কথায় সেই প্রত্যাশার বিষয়টা আমি যেন দেখতে পাই। সেনাকুঞ্জের সেই অনুষ্ঠানেও তিনি একই কথা বললেন। ‘এই নতুন দেশে আমাদের দায়িত্ব সকল মানুষকে একটি বৃহত্তর পরিবারের বন্ধনে আবদ্ধ করা। পরিবারে মতভেদ থাকবে, বাকবিতণ্ডা হবে, কিন্তু আমরা কেউ কারও শত্রু হবো না। কাউকে তার মতের জন্য শত্রু মনে করবো না।’ 
ড. ইউনূসের স্বপ্নের সেই দেশ আমরা কবে পাবো? সেই জাতি আমরা কবে হবো? 

বিশেষ রচনা'র অন্যান্য খবর