জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে- এটাই এখন রাজনৈতিক মহলে বড় প্রশ্ন। দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিতেও একই প্রশ্ন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছে দলটি। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছ থেকে এখনো সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য আসেনি। বরং সরকারের দু’-একজন উপদেষ্টার বক্তব্য বিষয়টিকে আরও ধোঁয়াশাচ্ছন্ন করে তুলেছে। এ জন্য ডিসেম্বর মাসের মধ্যে নির্বাচনী রোডম্যাপ চায় দলটি। এসময়ে সরকারের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবে তারা। এরমধ্যে না হলে আগামী মার্চ কিংবা এপ্রিল মাস থেকে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে সোচ্চার হবে বিএনপি। এই দাবিতে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে তারা।
বিএনপি’র নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার দাবির প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি’র ভয় হচ্ছে- ১/১১-এর পর কিংস পার্টি গঠন করে দুই নেত্রীকে মাইনাস করতে চেয়েছিলেন ক্ষমতাসীনরা। এবারও সেরকম হওয়ার আশঙ্কা করছে দলটি। তাই দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করার জন্য বার বার সরকারকে চাপ দিচ্ছে এবং তাড়াহুড়ো করছে দলটি।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান জনতার চোখকে বলেন, নির্বাচন নিয়ে আমাদের শঙ্কা প্রকাশের কিছু নেই। আমরা জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে চাই। এজন্য জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা নির্বাচনী রোডম্যাপ চাচ্ছি। আমাদের দাবি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করা না হলে তখন পরিবেশ ও পরিস্থিতি বুঝে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। কিন্তু আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করছি এবং সমর্থন দিয়েছি, যাতে এই সরকার ব্যর্থ না হয়।
এদিকে দলটি নানা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১৯শে নভেম্বর থেকে ১০টি সাংগঠনিক বিভাগ সফর করবে দলটির সিনিয়র নেতারা। সফর শেষ হবে আগামী ২১শে ডিসেম্বর। এই সফরে মূলত বিভাগীয় শহরে প্রশিক্ষণ কর্মশালা করবে দলটি। রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা প্রস্তাব জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া হবে এবং সারা দেশে গণসংযোগ করবেন নেতারা। এ ছাড়া ইতিমধ্যে দলটির অঙ্গসংগঠন বিশেষ করে যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দল এবং কৃষকদল পৃথক পৃথকভাবে নানা কর্মসূচি নিয়ে সারা দেশে সফর করছে। এ ছাড়া ১০টি সাংগঠনিক বিভাগে বড় সমাবেশ এবং ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসে ঢাকায় বড় শোডাউনের চিন্তাও করছে দলটি।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন জনতার চোখকে বলেন, বিএনপি’র গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কর্মসূচি আগেও ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। যে পর্যন্ত সুষ্ঠু পরিবেশে জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করে তাদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত না করবে, সে পর্যন্ত কর্মসূচি থাকবে। সুতরাং এটা একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।
ইতিমধ্যে ৭ই নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে ঢাকায় ব্যাপক লোকসমাগম ঘটিয়ে র্যালি করেছে বিএনপি। ৭ই নভেম্বর উপলক্ষে এই র্যালির আয়োজন করা হলেও মূলত দ্রুত নির্বাচনের দাবি জোরালোভাবে তুলে ধরার জন্য এই শোডাউনের আয়োজন করা হয়। এতে দলটির নেতারা বলেছেন, কোনো অজুহাত চলবে না। নির্বাচন ঝুলিয়ে রাখা যাবে না। শিগগিরই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে হবে। মূলত ৭ই নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রুত নির্বাচন দেয়ার একটি বার্তা দিতে চেয়েছে দলটি।
দলটি বলছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ তিন মাস অতিবাহিত হলেও নির্বাচন নিয়ে তারা কিছু বলছেন না। তারা শুধুই সংস্কারের কথা বলছেন। এজন্য নির্বাচন নিয়ে দলটির মধ্যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে যে, নির্বাচন কী হবে? যদি হয় সেটা কবে, কোন বছর কিংবা কতো মাস পরে হবে। এ বিষয়টি তারা সরকারের কাছ থেকে স্পষ্ট হতে চায়।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার কী কী সংস্কার করতে চায় এবং সেটা করতে কতোদিন লাগবে, কোনো ছলচাতুরী ছাড়াই তা স্পষ্ট করে অবিলম্বে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করতে হবে। তারা যাতে জাতিকে ধোঁয়াশায় না রাখে। গত ১৬ বছরের বিনা ভোটের সরকার আওয়ামী লীগকে জনগণ মানেনি, এখন এই সরকারকেও তারা দীর্ঘদিন মানবে না।
ওদিকে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জামায়াতের সঙ্গেও দূরত্ব কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। গত ১১ই নভেম্বর দলের চেয়ারপারসনের গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে জানা গেছে। বৈঠকে দলের কেউ কেউ বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্ক নিয়ে অভিমত ব্যক্ত করেন। তারা বলেন, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি’র কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতনে তারা একই সঙ্গে আন্দোলন করেছে। এখন ৫ই আগস্টের পরে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রশাসন ও মাঠ প্রশাসনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পদায়ন নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। এক্ষেত্রে জামায়াত বিএনপিকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছে কিনা, সে প্রশ্নও সামনে আসছে। এই পরিস্থিতিতে জামায়াতের সঙ্গে যাতে কোনো দূরত্ব তৈরি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত বলে বৈঠকে অভিমত দেন বিএনপি’র কয়েক নেতা।
গত ৮ই আগস্ট শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকেই তাদের সহযোগিতা ও সমর্থনের কথা বলছে। যাতে এই সরকার একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন নয় সংস্কারকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে মনে করছে বিএনপি।