বিদেশে একটি রাস্তায় একজন বেশ উত্তেজিত। তাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছেন কয়েকজন। প্রায় বেসামাল লোকটি, তার কথাগুলো অস্পষ্ট। তিনি সামনে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ধাক্কাধাক্কির এক পর্যায়ে তাকে পেছনেই সরতে হয়। ২৬ সেকেন্ডের এমন একটি ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যার টাইটেল ছিল ফ্রান্সে পাবলিকের দৌড়ানি খেয়ে দোকানের ভেতরে উপদেষ্টা...। কিন্তু ওই ভিডিওতে কোনো উপদেষ্টাকে দেখা যায়নি। এ নিয়ে খোঁজখবর নেয়া শুরু করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তথা বাংলাদেশ সরকার। এই প্রতিবেদকও কৌতূহলী হয়ে উঠেন। ঘটনার বেশ ক’টি ভাষ্য মিলেছে। তবে যেভাবে ফেসবুকে প্রচার হয়েছে তা সর্বৈব সত্য নয়। উপদেষ্টা দৌড়ানি খেয়েছেন এমনটি নয়। বরং একটি প্লট তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ঠেকানো গেছে। ঘটনার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের তরফে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো প্রেস নোট বা ভাষ্য প্রচার হয়নি। এ নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের একাধিক বয়ান পাওয়া গেছে। একটি ভাষ্য ছিল এমন- ৭ই নভেম্বর, বৃহস্পতিবার। প্যারিসের স্থানীয় সময় বিকাল। শহরের প্রাণকেন্দ্রের (ডিস্ট্রিক্ট-১৬) একটি রেস্টুরেন্ট। নাম ব্লু-আ। কেউ কেউ ব্লয়েসও বলে থাকেন। ফ্রান্সের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে ২ কিলোমিটার দূরত্বে এর অবস্থান। সেখানে পূর্ব নির্ধারিত বৈঠক চলছে লেখক ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য এবং ব্যক্তিগত সফরে প্যারিসে যাওয়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার। বাইরে ৬-৭ জনের একটি জটলা। দু’একটি মুখ পরিচিত। তারা আওয়ামীপন্থি। তাদের গতিবিধি সন্দেহজনক। উপদেষ্টার প্রটোকল টিম বিষয়টি অবহিত করে দূতাবাসের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে। তিনি সেখানে উপস্থিত হন। তাদেরকে বুঝিয়ে ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে নিতে সক্ষম হন। ততক্ষণে বৈঠকও শেষ হয়ে যায়। যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সম্পূর্ণ নিরাপদে ফ্রান্স ত্যাগ করেন। তার সঙ্গে ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মুখোমুখি হওয়া দূরে থাক তিনি ঘটনা আঁচ করতে পেরেছেন কিনা? সংশয় প্রকাশ করেন ওই প্রত্যক্ষদর্শী। অন্য ভাষ্যটি ছিল এমন ‘অনির্ধারিত সফরে কয়েক ঘণ্টার জন্য জেনেভার বৈঠক সেরে সড়কপথে প্যারিসে যান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। সঙ্গে ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামান, উপদেষ্টার পলিসি এডভাইজার আব্দুল আহাদ, এপিএস মোয়াজ্জেম হোসেন। জেনেভা থেকে ৬ ঘণ্টার ড্রাইভ শেষে ৭ই নভেম্বর সকালে তারা প্যারিসে পৌঁছান। ৯টায় বাংলাদেশ মিশনে মতবিনিময় করেন ৩৬ জুলাই’র আন্দোলনে প্যারিস থেকে নানাভাবে সহায়তাকারী প্রবাসী বিপ্লবীদের সঙ্গে। ফ্রান্সে পড়ুয়ারাও ছিলেন সেখানে। ওই মিটিং শেষে তিনি জেনেভা থেকে নিয়ে আসা গাড়িতে চড়েই আইফেল টাওয়ার দেখতে যান। দুপুরে ফিরেন বাংলাদেশ মিশনে। সেখানে সামান্য সময় বিশ্রাম এবং খাওয়া-দাওয়া সেরে বেরিয়ে যান। গন্তব্য জেনেভা। ফেরার পথে একটি ক্যাফেতে বৈঠকে বসেন লেখক ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্যের সঙ্গে। এটি না মিশন না পিনাকীর আবাসস্থল, থার্ড এবং মাঝামাঝি একটি প্লেস। ওই প্লেসেই উপদেষ্টাকে ঘিরে ধরার অপচেষ্টা হয়। কিন্তু বিক্ষুব্ধ আওয়ামী সমর্থকরা খুব সুবিধা করতে পারেনি। ওই প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান মতে, দূতাবাসের বেশ ক’জন কর্মকর্তার আচমকা উপস্থিতিতে তারা সরে গেছে এটা সত্য। তারচেয়ে বড় বিষয় ছিলো উপদেষ্টা সেখানে বেশিক্ষণ ছিলেন না। ফ্রান্সে তার সফরটি ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। সময় পেলে অর্থাৎ ফ্রান্সে তিনি রাত্রী যাপন করলে কিংবা তার উপস্থিতি প্রলম্বিত হলে হয়তো তারা বড়োসড়ো জমায়েতের প্রস্তুতি নিতে পারতো। জেনেভা, ফ্রান্স এবং ঢাকার ওয়াকিবহাল সূত্র মতে, জেনেভা বিমানবন্দরে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলকে হেনস্তা এবং ফ্রান্সে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদকে হেনস্তার ব্যর্থ চেষ্টা একই সূত্রে গাঁথা। ওই দু’টি ঘটনার নেপথ্যে একটি নাম পাওয়া গেছে। তিনি ষাটোর্ধ্ব, পতিত সরকারের সুবিধাভোগী। নাম এনায়েত উল্লাহ ইনু। কারাগারে থাকা ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলামের ব্যবসায়িক পার্টনার। আতিক মেয়র থাকা অবস্থায় সর্বশেষ ফ্রান্স সফরে দূতাবাসের প্রটোকল না নিয়ে তার বন্ধুর আতিথেয়তাতেই স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলেন। অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ এসোসিয়েশন আয়েবা’র নিয়ন্ত্রণ এনায়েত উল্লাহ’র হাতে। ওই সংগঠন ২০১৬ সালে মালয়েশিয়ায় একটি বিজনেস সম্মেলন করে। সেই সম্মেলন উপলক্ষ্যে ১০৭ জনকে বাংলাদেশ থেকে পাচারের অভিযোগে উঠেছিলো। পরবর্তীতে অবশ্য দাতো এবাদত হোসেনের মধ্যস্থতায় দায়মুক্তি মিলে। আসিফ মাহমুদ ও পিনাকী ভট্টাচার্যের বৈঠকস্থলের বাইরে বেসামাল হওয়া আলী হোসেন এনায়েত উল্লাহ ইনুর ঘনিষ্ঠজন বলে খ্যাত। তিনি আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য। আলীর সঙ্গে ছিলেন এমদাদ হোসেন। যিনি সাবেক বন ও পরিবেশমন্ত্রী শাহাব উদ্দিনের কথিত ভাগ্নে।