কলকাতার চিঠি

‘গোলকধাঁধা’য় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

পরিতোষ পাল | মতামত
এপ্রিল ১২, ২০২৫
‘গোলকধাঁধা’য় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কে জটিলতা কাটবে বলে যারা মনে করেছিলেন তারা হতাশ হয়েছেন। বরং ভারত শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ঝুলিয়ে রেখে বিমসটেকে পার্শ্ব বৈঠকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কেন বৈঠকে বসলেন তা নিয়ে নানা চর্চা চলছে ভারতের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলে। এই ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়গুলো যিনি ভারতের হয়ে পরিচালনা করেন সেই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল নাকি চান নি এই বৈঠক হোক। হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা এবং সন্ত্রাসবাদীদের কারাগার থেকে ছেড়ে দেয়া তাতে সরাসরি মৌলবাদী উত্থান নিয়ে ভারতের উদ্বেগ মাথায় রেখেই তিনি কট্টর অবস্থান নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের পাকিস্তান ও চীন প্রীতির বিষয়টিও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। দিল্লির শীর্ষ প্রশাসনিক স্তরে এমনই কানাঘুষা হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে শেষপর্যন্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রক ও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের আগ্রহে বৈঠকটি হয়েছিল। আর এই বৈঠকের জন্য ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মারও ভূমিকা রয়েছে বলে কূটনৈতিক মহলের একাংশ মনে করেন। আকস্মিকভাবে বিমসটেক বৈঠকের কয়েকদিন আগেই হাইকমিশনার তৎপর হয়ে ঢাকা ও দিল্লিতে কয়েকটি বৈঠক করেছেন। বিশেষ করে ঢাকা থেকে উড়ে এসে ভারতের সেনাপ্রধান দ্বিবেদীর সঙ্গে তার বৈঠকটিকে অনেকেই ইঙ্গিতবাহী বলে মনে করছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে সেনাপ্রধান বিভিন্ন সময়ে খোলাখুলি মন্তব্য করেছেন। বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের সঙ্গে যে তার যোগাযোগ ও নোট চালাচালি হয় সেটাও তিনি প্রকাশ্যেই বলেছেন। তিনি আরও বলেছেন, বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকার আসার পরই সম্পর্ক নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হবে। এই আবহে ভারতীয় হাইকমিশনার সেনাপ্রধানকে কী বার্তা দিতে এসেছিলেন বা কি ভূমিকা নেয়ার অনুরোধ জানাতে এসেছিলেন তা নিয়ে রহস্য দানা বেঁধেছে নানা মহলে। কূটনৈতিক মহলের মতে, বাংলাদেশের ক্রমাগত অনুরোধের পরও বৈঠক না হলে ভুল বার্তা যেত। বিশেষ করে ভারতের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিদ্বেষ বৃদ্ধি এবং সরকারের নেতৃস্থানীয়দের মধ্য থেকে ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারকে আটকাতে হলে এই বৈঠক দরকার ছিল বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রকের ধারণা। ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনও বার্তা পাঠিয়েছিল, বাংলাদেশের  ভারতবিরোধী মনোভাব যদি অব্যাহত থাকে তাহলে পাকিস্তানের মতো পরিবেশ হয়ে যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকেও তাই বৈঠকের ব্যাপারে অনেক গড়িমসির পরে সবুজ সংকেত দেয়া হয় বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা  গেছে। আবার পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মতে, বিমসটেকের পার্শ্ব বৈঠকে মোদি সব সদস্য দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল; সেখানে বাংলাদেশকে ব্রাত্য করে রাখা সম্ভব ছিল না। বিশেষ করে ভারত সার্ককে অকেজো করে গত এক দশক ধরে বিমসটেককে শক্তিশালি করতে মনোযোগী হয়েছে। সেখানে পরবর্তী বিমসটেকের দায়িত্বপ্রাপ্ত দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা করাও জরুরি। এত সব অঙ্ক মেলাতে গিয়ে নানা দ্বিধা সত্ত্বেও মোদি ইউনূসের সঙ্গে চল্লিশ মিনিটের বেশি বৈঠক করেছিলেন। সেই বৈঠকে দুই প্রধানের মধ্যে কী বার্তার আদান-প্রদান হয়েছে বা আদৌ ফলপ্রসূ কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা তা নিয়ে রীতিমতো ধোঁয়াশা রয়েছে। কেননা, বৈঠক থেকে কোনো যৌথ বিবৃতি আসেনি। কূটনীতির অঙ্গনে এই ধরনের বৈঠকে দু’পক্ষ নিজেদের বক্তব্যকে তুলে ধরেন। কোনো চটজলদি সিদ্ধান্ত আসে না। ভারত নিজেকে বাংলাদেশের বন্ধু প্রতিপন্ন করতে নির্বাচনের তাগিদ যে  দিয়েছে সেটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। 
কিন্তু বাংলাদেশের উপদেষ্টা ও সচিবরা বাংলাদেশের অনুকূলে বৈঠকের যে সব ন্যারেটিভ বাজারে ছেড়েছেন তাতে ভারত ক্ষুব্ধ হয়েছে। সেগুলোকে দুরভিসন্ধিমূলক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে সাউথ ব্লকের সঙ্গে যুক্তরা জানিয়েও দিয়েছেন। 


অবশ্য গত মাসে ইউনূসের চীন সফরে দেয়া বক্তব্য এবং বাংলাদেশে চীনের অর্থনীতির সমপ্রসারণের যে আহ্বান জানিয়েছেন তাতে ভারতের উদ্বেগ ধরা পড়েছে। বিশেষ করে সেভেন সিস্টার্সকে স্থলবেষ্টিত জানিয়ে ইউনূসের সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক হিসেবে বাংলাদেশকে তুলে ধরার উদ্দেশ্য নিয়ে ভারত রীতিমতো সন্দিহান বলে মনে করছেন ভারতের রাজনৈতিক মহল। অবশ্য ভারতের পক্ষ থেকে কৌশলে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। ভারতের দীর্ঘ উপকূল রেখার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে।
একদিকে চীনের সঙ্গে এই সখ্যতা অন্যদিকে পাকিস্তানের প্রতি বাংলাদেশের অনুরাগ যেভাবে বাড়ছে তাকে ভারতের পর্যবেক্ষক মহল ভালো দৃষ্টিতে দেখছেন না। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সচিব সহ এ মাসেই বাংলাদেশ সফরে আসছেন সম্পর্ক জোরদার করতে। ইউনূসকে পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণও জানানো হয়েছে। 


ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রক তাই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে নানা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে। মনোভাবে কঠোরতার প্রকাশ ঘটছে। বার বার বাংলাদেশ সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টিকে হাল্কাভাবে উল্লেখ করলেও ভারত যে তা মানছে না তা স্পষ্ট করে দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রক। গত বুধবার (৮ই এপ্রিল)  ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল সোজাসুজি বলেছেন, সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের ঘটনাগুলোকে শুধুমাত্র ‘রাজনৈতিক কারণে’ ঘটেছে বা ‘সংবাদমাধ্যমের অতিশয়োক্তি’ বলে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। এই ধরনের নৃশংসতায় যারা অভিযুক্ত, তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের (অন্তর্বর্তী) সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে ভারতের প্রত্যাশার কথা জানানো হয়েছে। সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের অভিযোগ নিয়ে আগেও বাংলাদেশের সঙ্গে বেশ কয়েকদফা কথা হয়েছে ভারতের। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সঙ্গে যেভাবে আচরণ করা হয়, তাদের ওপর যে নির্মমতার অভিযোগ উঠে আসে, তা নিয়ে ভারতের উদ্বেগ ফের নতুন করে জানানোর মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশেষ বার্তা দেয়া হয়েছে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা। এদিকে ভারত যেভাবে কোনো বলা কওয়া নেই, হঠাৎ  করে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে তাও বেশ ইঙ্গিতবহ বলেই মনে করা হচ্ছে। পাঁচ বছর ধরে ভারতের মধ্যদিয়ে তৃতীয় দেশে রপ্তানি পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশকে যে সুবিধা দেয়া হচ্ছিল তা হঠাৎ করেই বাতিল করার মধ্যে ভারতের কঠোর মনোভাবেরই স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।


রাষ্ট্র বিজ্ঞানের এক অধ্যাপক একান্ত আলোচনায় বলেছেন, বাংলাদেশ পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে দ্রুত সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে ভারতকে বৈরিতার বার্তা দিতে চেয়েছে। ইতিমধ্যেই চীনের জন্য আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। সামরিক সমঝোতা বৃদ্ধিরও নানা তথ্য সামনে আসছে। তিস্তায় চীনকে যুক্ত করা হয়েছে। তাই ভূ-কৌশলগত নিরাপত্তার স্বার্থে এই সব কার্যকলাপ ভারতের পক্ষে স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়া কষ্টকর বলে তিনি মনে করেন। ফলে ভারতের কঠোর মনোভাব নেয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই। হাসিনার প্রত্যর্পণের প্রশ্নে যে ভারত কোনো সাড়া না দিয়ে বসে থাকবে সেটাও ইতিমধ্যেই প্রতিফলিত হয়েছে। বরং হাসিনার মুখ বন্ধ রাখার যে অনুরোধ ভারতকে জানিয়েছিল বাংলাদেশ তাকে ভারত আমলে নিতে রাজি হয়নি। আগের মতোই ভারত মনে করে এটা হাসিনার ব্যক্তিগত পরিসরের বিষয়। আর তাই হাসিনা ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে অডিও বার্তায় নিত্য নতুন বিষোদ্গার করে চলেছেন। এমনকি ‘আমি আসতেছি’ বলে দলের নেতাকর্মীদের বার্তাও দিয়েছেন। 
সব মিলিয়ে ঘটনাপ্রবাহ যে খাতে বইছে তাতে দুই দেশের সম্পর্ক জটিল থেকে জটিলতরই হচ্ছে। 

মতামত'র অন্যান্য খবর