মু ক্ত চি ন্তা

প্রয়োজন ফ্যাসিবাদের বিকল্প গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো

শহীদুল্লাহ ফরায়জী | মতামত
এপ্রিল ১২, ২০২৫
প্রয়োজন ফ্যাসিবাদের বিকল্প গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো

১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামসহ যত সংগ্রাম লড়াই অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে তা ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে; তারপরও কেন সংগ্রাম লড়াই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়? এজন্য অতীতের সশস্ত্র সংগ্রাম বা নিরস্ত্র সংগ্রাম বা আত্মত্যাগের কীর্তিসহ সামপ্রতিক সময়ের বিদ্রোহের ইতিহাস, শুধুমাত্র নিজ দেশের নয়, বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে হয়। সংগ্রামের সাফল্য অর্জনের জন্য দেশটির হাজার বছরের ইতিহাস, জাতি সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়, ভূ রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আঞ্চলিক বৈচিত্র্য, রাজনীতি অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি থেকে শুরু করে সবকিছু বিবেচনায় নিতে হয়, নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ করতে হয়। বাংলাদেশে দুনিয়া কাঁপানো ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সকল শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে যে-অভূতপূর্ব ‘মহাজাগরণ’ সৃষ্টি হয়েছিল, তার দার্শনিকভিত্তি ছিল-  বৈষম্যহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। দীর্ঘদিন যাবৎ রাষ্ট্র বা সমাজে অর্থনৈতিক কাঠামো বা রাজনৈতিকব্যবস্থায় কোনো রূপান্তর ঘটেনি। ফলে রাষ্ট্রব্যবস্থায় এবং সমাজব্যবস্থায় ন্যায্যতার অভাবে- সাম্য, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র বা মানবাধিকার অনুপস্থিত হয়ে পড়ে। প্রভুত্ব এবং শোষণের সমন্বয়ে তৈরি ক্ষমতার আবর্তে বিশাল জনগোষ্ঠী আবর্তিত হতে থাকে। রাষ্ট্রক্ষমতা সর্বনাশের মূল কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। ফ্যাসিবাদী শাসন মানুষের জন্মগত অধিকার, সংবিধান সৃষ্ট অধিকার এবং রাজনৈতিক অধিকার থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। রাষ্ট্রশক্তি অধিকারহীন মানুষকে ক্রমাগত ইতিহাসের আবর্জনা হিসেবে উপস্থাপন করে। রাষ্ট্র ক্রমাগত নাগরিকহীন হয়ে পড়ে, অধিকারহীন হয়ে পড়ে এবং গণতন্ত্রহীন হয়ে পড়ে। অধীন, অধস্তনতা, নির্যাতন-নিপীড়ন ক্ষমতার অনিবার্য অংশ হয়ে যায়। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিপরীতে রাষ্ট্র নির্দয় ও বর্বরোচিত প্রভুত্ববাদী আর কর্তৃত্ববাদীব্যবস্থার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। শুধু ভোটাধিকার হরণ নয়, ভিন্ন মত ও ভিন্ন কণ্ঠস্বরের উপর ফ্যাসিবাদী সরকার- হত্যা, গুম এবং ভয়াবহ নির্যাতনের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে ধ্বংসের কিনারে এনে ফেলে। রাষ্ট্র আর জনগণের মাঝে সম্পর্ক হয়ে দাঁড়ায়- শিকার এবং শিকারির। গোপন বন্দিশালায় রাষ্ট্রকে আইনবহির্ভূতভাবে ভিন্ন এক ভূখণ্ডে পরিণত করে ফেলে। আর সর্বত্রই মানুষের স্বাধীন ও মানবিক সত্তা বিপর্যস্ত হয়।


এমন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অভূতপূর্ব ও বিস্ময়কর গণবিদ্রোহে রূপ নেয়। ফ্যাসিবাদের বর্বরতা ও ক্রুরতার বিরুদ্ধে অসংগঠিত ও অপ্রস্তুত সহজ-সরল, মানবিক ছাত্র-জনতা প্রচণ্ড প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সরকার সশস্ত্র শক্তি দিয়ে মৃত্যুর উৎসবে মেতে উঠলেও সংগ্রামী জনতা পিছু হটেনি বরং আত্মত্যাগে মহিয়ান হয়ে ওঠে। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার ডিক্টেটরশিপের বেদিতে অসংখ্য প্রাণ বলি দিতে হয়েছে। মৃত্যুকে জয় করা এবং ভয়কে উপেক্ষা করার গণ-অভ্যুত্থান দুনিয়াকে প্রকম্পিত করে শুধু আলোড়নই সৃষ্টি করেনি উপরন্তু শেখ হাসিনার মসনদ চূর্ণ-বিচূর্ণ করে তাসের ঘরের মতো গুঁড়িয়ে দিয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থানে লুণ্ঠন ও গণহত্যাকারী পরাক্রমশালী সরকারের পতন হয়। 
এখন বৈষম্যবিরোধী রাষ্ট্র বিনির্মাণের দার্শনিকভিত্তি নির্ধারণ করে পর্যালোচনা সাপেক্ষে প্রজাতন্ত্রের উচ্চস্তরে পৌঁছানোর প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। আমাদের জীবনে এক বিরল মুহূর্ত আবির্ভূত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে রূপান্তর করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, গণমানুষের রাষ্ট্র বিনির্মাণের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।


এই বৈষম্যবিরোধী রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়েছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মধ্যদিয়ে। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করাই বাংলাদেশ নামক প্রজাতন্ত্রের দার্শনিক ভিত্তি।
এই অঞ্চলের মানুষ বিশেষ করে শোষিত ও নিপীড়িত বাঙালি জাতি-গোষ্ঠী নিজেদের মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে- ১৯৭১ সালে নিজেরা নিজেদের সংবিধান প্রণয়নের জন্য অভূতপূর্ব বিপ্লবী উদ্দীপনায়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে প্রকম্পিত করে সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করেছিল। পরিশেষে জনগণ তাদের বীরত্ব, অসম সাহসিকতা ও অনন্য সাধারণ বিপ্লবী ভূমিকার কারণে বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের উপর কার্যকর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। অর্থাৎ জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষায় ও দৃঢ় আত্মবিশ্বাসে ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল বাংলাদেশের জনগণের জন্য- সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচার- এই ত্রয়ী দার্শনিক ভিত্তিতে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়। কোনো এক অজানা কারণে আমাদের রাজনৈতিক পরিসর থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ত্রয়ী আদর্শ আড়াল হয়ে গিয়েছিল। এমনকি ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নকালেও স্বাধীনতার মর্ম বস্তুকে উপেক্ষা করার ফলে রাষ্ট্র গঠন বা পুনর্গঠনের বিরাট সম্ভাবনা হাতছাড়া হয়ে যায়। 


আমাদের রাষ্ট্রের ঘোষিত দার্শনিকভিত্তিকে উপলব্ধি করার ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতার বিপদটাই রাষ্ট্রের বিপর্যয়ের প্রধান শর্ত। আমাদের বিপর্যয়ের কারণ কোনো ব্যক্তি বিশেষ নয় বরং এর কারণ ঐতিহাসিক, যা গভীর অর্থবহ। যার বাস্তবতা হলো রাষ্ট্রের দার্শনিকভিত্তিকে পুরোপুরি উপলব্ধি না করা। রাষ্ট্রবিনির্মাণের সঙ্গে দর্শনের অন্তর্বর্তী যোগসূত্রটা গভীরভাবে অনুসন্ধান করতে হয়। স্থায়ী ও ন্যায়-সঙ্গত শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য- দর্শনগত ধারণা সমাজে ব্যাপকভাবে প্রসারিত করতে হয়। নিম্নে রাষ্ট্রের কয়েকটি দার্শনিকভিত্তি নিয়ে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা:- 


১) সাম্য:
রাজনৈতিকসাম্য: মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন কিন্তু শৃঙ্খলিত। রাজনৈতিকসাম্য এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে রাষ্ট্র বা সমাজের সকল মানুষের সমান রাজনৈতিক অধিকার এবং সুযোগ নিশ্চিত করা যায়।  যেমন ভোট দেয়ার এবং নির্বাচিত হওয়ার অধিকার।
অর্থনৈতিকসাম্য: মানুষ প্রকৃতিগতভাবে অসাম্য কিন্তু আইন ও নৈতিকতা দিয়ে বিধিসম্মত সমতা নিশ্চিত করা যায়। অর্থনৈতিকসাম্য বলতে এমন একটি অবস্থা বোঝায়, যেখানে একটি সমাজের সকল সদস্যের আয় এবং সম্পদ অর্জনের অধিকার রয়েছে।
সামাজিকসাম্য: সামাজিকসাম্য বলতে সমস্বার্থ ও সর্বমঙ্গল সংরক্ষিত হতে পারে এমন একটি অবস্থা বোঝায়। যেখানে একটি সমাজের সকল সদস্যের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং কর্মসংস্থানের সমান সুযোগ এবং সুবিধা রয়েছে। সকল শিক্ষার্থীকে সমান শিক্ষার সুযোগ প্রদান করা সামাজিকসাম্য অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
২) মানবিকমর্যাদা: অলঙ্ঘনীয় ও অবিচ্ছেদ্য অধিকার। যা রাষ্ট্র হরণ করতে পারে না। মানবমর্যাদার সঙ্গে প্রতিটি মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান এবং সুরক্ষা জড়িত। মানুষের মর্যাদা তাই সামাজিকমর্যাদার সঙ্গে আপেক্ষিক নয়, শারীরিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মক্ষমতার সঙ্গেও নয়। মানবিক মর্যাদা পরম। এটা কেউ বিনষ্ট করতে পারে না।
৩) সামাজিকসুবিচার: উন্নয়ন, সমৃদ্ধি এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার অন্যতম মূল শর্ত হিসেবে মানা হয় সোশ্যাল জাস্টিস বা সামাজিকন্যায়বিচার। যে-রাষ্ট্রে সামাজিক ন্যায়বিচারবোধের যত প্রয়োগ আছে, সে রাষ্ট্র বা সমাজ ততই উন্নত এবং সমৃদ্ধ। সামাজিক ন্যায়বিচার বলতে সমাজের এমন একটি পরিবেশকে বোঝায়, যেখানে জাতি, লিঙ্গ-ধর্ম, বর্ণ-নির্বিশেষে সবার সমানভাবে বেঁচে থাকার, জীবনযাপন করার এবং কাজ করার সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়। সুতরাং রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্যদিয়ে যে-বাস্তবতায় বাংলাদেশ হাজির হয়েছে তার রাজনীতি নির্ধারণ করতে হবে ঘোষিত দর্শনের আলোকে। পুরনো ঔপনিবেশিকব্যবস্থা বিলুপ্ত করে নতুন রাজনৈতিকব্যবস্থাপনা প্রবর্তনে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার প্রয়োজন হবে। রোমান্টিক বিপ্লবীপনার দৃষ্টিভঙ্গিতে নয় বরং এই নতুন ধারার রাজনৈতিকব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার প্রশ্নে অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে। রাষ্ট্র বিনির্মাণের এই নবতর সংগ্রামে বিরাট জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার যে-অন্তর্ভুক্তিমূলক বা অংশীদারিত্বমূলক রাজনীতির ভাবাদর্শ, তার প্রভাব বিস্তার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যমান নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য বদলের পরিবর্তে জনগণের মালিকানাধীন রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তন এক জটিল এবং কঠিনতর প্রক্রিয়া।
তাই কতোগুলো বিষয়কে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।


যেমন:-
১) জুলাই গণহত্যার মধ্যদিয়ে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে তার আকাঙ্ক্ষা এবং অভিপ্রায়কে সমাজে হাজির রাখতে হবে।
২) অভ্যুত্থানকারী শক্তির ঐক্যকে আরও সংহত ও সুদৃঢ় করতে হবে।
৩) পরাজিত ফ্যাসিবাদী শক্তির অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সকল প্রচেষ্টাকে দৃঢ় হস্তে মোকাবিলা করতে হবে।
৪) ফ্যাসিবাদী অপশক্তির সংগঠিত হওয়ার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের শৈথিল্যতা হবে আত্মঘাতী।
৫) রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নে সংবিধান, প্রতিষ্ঠান, কাঠামোগত বিন্যাস ও জনগণের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে সুস্পষ্ট কর্মসূচি হাজির করতে হবে।
৬) প্রতিদিন গণ-অভ্যুত্থানে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাফল্য অর্জনের প্রয়াস পরিলক্ষিত করতে হবে।
৭) গণ-অভ্যুত্থানকারী শক্তির নৈতিক-শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে হবে।


গণশাসনের সঙ্গে গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। সুতরাং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় গণ-সংগ্রামকে দ্ব্যর্থহীন সমর্থন অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ ফ্যাসিবাদী ও তাদের দোসররা সর্বসময় চাইবে, গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক চেতনাকে ধ্বংস এবং প্রজাতন্ত্র বিনির্মাণের সকল সম্ভাবনা বিনষ্ট করতে। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে পরে রাষ্ট্রবিনির্মাণের দ্বিতীয় স্তরে উত্তীর্ণ হওয়ার তাৎপর্য এখানেই যে, এই স্তরেই নির্মিত হয় গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের পূর্ব শর্ত। দ্বিতীয় স্তরে গণ-অভ্যুত্থানের সাফল্য গণতন্ত্রকে প্রকৃত অর্থে গণমুখী ও সেখান থেকেই উৎসারিত হয় গণতন্ত্রের সার্থকতম রূপান্তর। ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী সব সময় গণতন্ত্র বিরোধী শক্তিগুলোর সঙ্গে আঁতাত করবে, যাতে প্রকৃতপক্ষে জনগণের প্রজাতন্ত্রের মাধ্যমে জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না হয়। সুতরাং ঐতিহাসিকভাবে প্রজাতন্ত্র বিনির্মাণের পথে প্রচণ্ড প্রতিকূলতা, ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি, ফ্যাসিবাদের মনস্তাত্ত্বিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে, তাই ঐতিহাসিকভাবে দায়িত্ব বর্তায় ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের চালিকা শক্তির উপর। এটাই হবে গণতান্ত্রিক বিপ্লব। এই গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রধান শক্তি হবে মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা। যারা রাষ্ট্র ক্ষমতার আমূল পরিবর্তন করে জনগণের সকল অংশকে রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ করবে। জনগণের সকল অংশের কার্যকর ভূমিকাই গণতন্ত্রের সার্থকতম ফলশ্রুতি।


ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমিকায়  গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটে সাম্য, মানবিকমর্যাদা ও সামাজিকসুবিচারের প্রেক্ষিতে গণতন্ত্রের সৃজনশীল বিকাশ ঘটাতে হবে। সংকুচিত ও অনুদার গণতন্ত্র বা দল কিংবা ব্যক্তিকেন্দ্রিক গণতন্ত্রকে অতিক্রম করে ‘অংশীদারিত্বের গণতন্ত্র’ প্রত্যর্পণ করানো ঐতিহাসিক কারণেই অনিবার্য। যার মাধ্যমে ফ্যাসিবাদীব্যবস্থা উচ্ছেদ করে সর্বস্তরের জনগণের ক্ষমতায়ন ও মালিকানাকে নিশ্চিত করা হবে। আমাদের এখানে তথাকথিত গণতান্ত্রিক চৌহদ্দি অতিক্রম করে শ্রম-কর্ম-পেশার জনগণের অংশীদারিত্বের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বাস্তব রূপায়ণ বা পরিণতির বহিঃপ্রকাশ দেখার কোনো সুযোগ হয়নি। অংশীদারিত্বের গণতন্ত্রের সৃজনশীল বিকাশ ঘটিয়ে দলীয় গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা বা অসম্পূর্ণতাকে রূপদান করা সম্ভব হবে। অংশীদারিত্বের গণতন্ত্রের তাত্ত্বিক ধারণার বিকাশ ঘটিয়ে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকাঠামো চূর্ণ করে দমনমূলক রাষ্ট্রকাঠামো ভাঙতে হবে- পরবর্তীতে যা হয়ে উঠবে ফ্যাসিবাদের বিকল্প রাষ্ট্রকাঠামো। কতিপয় সংখ্যালঘু শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে ব্যাপক সংখ্যাগুরু শোষিত মানুষের রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে একদিকে ফ্যাসিবাদীব্যবস্থা বা অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশবাদ অপসারণ হবে অন্যদিকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে। দলতন্ত্রের বিপরীতে জনগণের অংশীদারিত্বভিত্তিক নতুন শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়ার মধ্যদিয়ে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু হবে। এই উত্তরণ পর্বে রাষ্ট্রের চরিত্র হবে প্রজাতান্ত্রিক, গণমুখী ও বৈপ্লবিক। এটা ব্যবহৃত হবে অবিচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে। এই নতুন রাজনৈতিকশক্তি স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদকে পর্যুদস্ত করে গণতন্ত্রের হাতিয়ার হয়ে উঠবে। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে শ্রমজীবী, পেশাজীবী, সমাজশক্তির অংশীদারিত্ব বা অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিকব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে দীর্ঘ একটি কালপর্ব জুড়ে। এই নবতরব্যবস্থা হবে নৈতিক ও রাজনৈতিক মূল্যায়নের ভিত্তি। এই জটিল রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজন নতুন যুক্তি বিন্যাস।


শুধুমাত্র নতুন রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কার বা নতুন আইন করলেই গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র নির্মাণ হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্র শাসনব্যবস্থাকে এবং সংবিধানকে নৈতিকভাবে দেখার পূর্বশর্ত পূরণ না করে, ততক্ষণ রাষ্ট্র প্রজাতান্ত্রিক হয়ে উঠবে না। অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক অবস্থা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এ লড়াই নিরন্তর। ন্যায্য এবং ন্যায়সংগত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্যদিয়ে অর্থাৎ রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় ন্যায্যতার সূত্রগুলো চুক্তির মাধ্যমে গৃহীত হলেই ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের অভিপ্রায় অভিমুখী যাত্রা শুরু হবে। 
 

লেখক: গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
faraizees@gmail.com

মতামত'র অন্যান্য খবর