খোলা কলম

এক বছরের সেরা প্রাপ্তি মব কালচার!

মাসুদ কামাল | এক্সক্লুসিভ
জুলাই ৫, ২০২৫
এক বছরের সেরা প্রাপ্তি মব কালচার!

দেখতে দেখতে প্রায় এক বছর হয়ে গেল। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর দেশে নতুন এক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। স্বৈরাচারী শাসক আর নেই, লুটেরা গোষ্ঠী-যারা দেশ থেকে নির্বিচারে বিদেশে সম্পদ পাচার করতো তারাও নেই, নেই ছাত্রলীগের সেই হেলমেট বাহিনী, সাধারণ মানুষকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে প্রতিদিন যে কথা বলতেন আওয়ামী মন্ত্রীরা-সেসবও আর শুনতে হচ্ছে না। কিন্তু এতসব না থাকা সত্ত্বেও, মানুষের মনে শান্তি কি এসেছে? মিটেছে কি জনগণের মনের প্রত্যাশা? 
জুলাই গণ-আন্দোলনকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এইসব প্রশ্নকে বিবেচনার বাইরে রাখা যাবে না। শেখ হাসিনা স্বৈরাচারী ছিলেন। নিজের যা মনে হতো তাই করতেন। কারও কাছে কোনো জবাবদিহিতা ছিল না। মুখে গণতন্ত্রের কথা বলতেন, কিন্তু বছরের পর বছর জনগণকে তিনি ভোটই দিতে দেননি। মানুষ জানতো না ভোট কীভাবে দিতে হয়, ভোটের কী শক্তি। উনি মনে করতেন ওনার ক্ষমতায় থাকা দরকার, তাই তিনি থাকতেন। সরকারে থাকা না থাকাটা যে জনগণের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে, এটাই যে প্রচলিত গণতান্ত্রিক রীতি, তা তিনি মানুষকে ভুলিয়ে দিয়েছিলেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি একটা দাবি নিয়েই বছরের পর বছর আন্দোলন করে গেছে, সেটা হচ্ছে ভোটের দাবি। বিএনপি বলেছে-দেশের মানুষ নিজের ভোটটি দিতে চায়। এমন নিশ্চয়তায় ভোট দিতে চায়, যাতে সে এই বিশ্বাস করতে পারে যে, তার ভোটটি ঠিকঠাক মতো বিবেচনা করা হবে। সরকার নির্বাচনে তার ভোটটি হিসাবে নেয়া হবে। মানুষ এমন প্রত্যয় নিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবে, যাতে ব্যালট পেপারে তারা তাদের পছন্দের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক বিকল্প প্রার্থী বা দলের নাম দেখতে পাবে। হাসিনা চলে গেছেন এক বছর হলো। এখনো পর্যন্ত কি ভোট নিয়ে মানুষের মনের সেই সংশয় দূরীভূত হয়েছে? নির্বাচন কবে হবে, কেউ কি জানে? এতদিনেও সরকার এখনো স্পষ্ট করে বলতেই পারছে না, কবে নাগাদ আয়োজন করতে পারবে তারা একটা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের। 
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস অবশ্য বলেছেন, ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নির্বাচনটি তিনি দেবেন। কিন্তু তার কথায় আস্থা রেখেছে কয়জন? ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নির্বাচনের কোনো প্রস্তুতি কি এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়েছে? এমন কিছু কী ঘটেছে, উনি ঘটাতে পেরেছেন, যা দেশের মানুষ ধারণা করতে পারছে-আসলেই একটা অসাধারণ সুন্দর নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে দেশ? উল্টো, ওই যে আশঙ্কা ছিল, ব্যালটে পর্যাপ্ত সংখ্যক বিকল্প প্রার্থীর নাম ভোটাররা দেখতে পাবে কিনা, সেই আশঙ্কার বাস্তবায়ন যেন এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হয়ে আছে। ২০১৪, ২০১৮ কিংবা ২০২৪ সালের নির্বাচনে মানুষ দেখেছে তারা তাদের পছন্দের লোকটিকে ভোট দেয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। নানা কারণে, অজুহাতে কিংবা ছুতানাতায় একটা বড় অংশকে নির্বাচনের বাইরে রাখা হয়েছে। ২০১৪ সালে দেশের অর্ধেকেরও বেশি এলাকার মানুষের ভোট দেয়ারই প্রয়োজন হয়নি। ভোট ছাড়াই সেই সব এলাকা থেকে সরকার তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে নির্বাচিত বলে ঘোষণা করেছে। ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগের রাতেই ভোট হয়ে গেছে। এর মধ্যে আবার জামায়াতে ইসলামীকে নির্বাচনে অংশই নিতে দেয়া হয়নি, ব্যালট পেপারে জামায়াতের প্রতীক না রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাহলে যারা জামায়াতের কর্মী, সমর্থক বা ভোটার তাদের জন্য কী অপশন থাকলো? এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই, জবাব দেয়ার কোনো প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেনি সেই সময়ের সরকার। বরং কেন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করা জরুরি ছিল, তার পক্ষে হাজারো যুক্তি দেয়া হয়েছে। এবারও কি আমরা সেই একই দৃশ্য বা যুক্তির অবতারণা হতে দেখছি না? জামায়াতের চেয়ে আওয়ামী লীগ কি ছোট দল? আওয়ামী লীগের কর্মী সমর্থক বা ভোটার কি জামায়াতের চেয়ে কম? আওয়ামী লীগের অতি শত্রুও কখনো এমন দাবি করবেন বলে মনে হয় না। তাহলে আসন্ন ‘ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নির্বাচনে’ এই বিপুল সংখ্যক ভোটারের জন্য কী বিকল্প থাকছে? 
 

হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনটা শুরু হয়েছিল কোটা ব্যবস্থার বিলুপ্তির দাবিতে। স্লোগান উঠেছিল- ‘মেধা নাকি কোটা? মেধা মেধা’। হাসিনা শেষ সময়ে এসে সেই কোটা ব্যবস্থার সংশোধনও করেছিলেন। কিন্তু ততদিনে দেরি হয়ে গিয়েছিল। কোটা আন্দোলন ততক্ষণে হাসিনা পতনের একদফা আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। তার শেষ পরিণতি আমরা দেখেছি। কিন্তু আমরা কি তখন ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিলাম, কোটা আন্দোলনের এই কুশীলবরাই আবার নতুন করে কোটার কথা বলবে? এখন দেখতে পাচ্ছি-বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে কোটা, জুলাই আন্দোলনে আহতদের জন্য কোটা, তাদের বা নিহতদের আত্মীয়স্বজনের চাকরি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কোটা, চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোটা। এখানেই শেষ নয়, সেদিন দেখলাম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জুলাই শহীদদের আত্মীয়স্বজনদের জন্য কোটা রাখার দাবিও করা হচ্ছে। নতুন করে কোটা তৈরির ক্ষেত্রে কোটা চালুর পাশাপাশি পুরনো কোটার সুবিধা নেয়ার ক্ষেত্রেও এই কুশীলবদের কোনো ক্লান্তি কিংবা লজ্জা শরম দেখা যাচ্ছে না। এয়ারপোর্টে তরুণতম উপদেষ্টার অস্ত্রের গুলিসহ ম্যাগাজিন পাওয়ার ঘটনা নিয়ে আলোচনায় অনেকে প্রশ্ন তুললেন-বয়স ৩০ হওয়ার আগে তো অস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার কথা নয়। আবার প্রতিবছর তিন লাখ টাকা করে আয়কর দেয়ার মতো অবস্থাও তো নেই। তাহলে অস্ত্রের লাইসেন্স উনি পেলেন কীভাবে? উপদেষ্টা মহোদয় বেশ গর্বের সঙ্গে জানালেন, লাইসেন্স উনি নিয়েছেন মন্ত্রীর কোটায়! বাহ, আবার সেই কোটার সদ্ব্যবহার!
 

তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে বড় প্রাপ্তি আমার কাছে-মব কালচার। এই মাত্রায় মব ভায়োলেন্স আমি আগে কখনো দেখিনি।  যে কাউকে, যেকোনো জায়গায়, মেরে মাটিতে শুইয়ে ফেলা এখন আর কোনো বিষয় নয়। যেকোনো স্থাপনা ভেঙে ফেলা যায়। কেবল একটা ট্যাগ দিয়ে দিলেই হলো। কেউ কিছু বলবে না। পুলিশ চেয়ে চেয়ে দেখবে, কিন্তু কিছু বলার সাহস পাবে না। মবের সবচেয়ে বড় ঘটনা সম্ভবত ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া। বুলডোজার দিয়ে এমন একটি ঐতিহাসিক স্থাপনাকে ভেঙে ফেলা হলো, অথচ সরকার বা প্রশাসন নপুংসকের মতো নিশ্চুপ থাকলো! এরপর থেকেই মব ভায়োলেন্স যেন বেপরোয়া চেহারা নিয়ে পুরো জাতির উপর চড়াও হয়ে গেল। সামপ্রতিক কয়েকটা ঘটনার কথা আমরা মনে করতে পারি। পটিয়াতে কী হলো? একজনকে ধরে মারতে মারতে থানায় নিয়ে যেয়ে বলা হলো-একে গ্রেপ্তার করতে হবে। অপরাধ কী? অপরাধ হচ্ছে সে ছাত্রলীগ করতো। তার বিরুদ্ধে কী কোনো মামলা আছে? সে কি কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িয়েছে? না তেমন কিছুই নেই। কিন্তু তাতে কী, তাকে আমরা ধরে এনেছি, অতএব গ্রেপ্তার করতে হবে, কোনো একটা মামলায় ঢুকিয়ে দেতে হবে! ওসি সাহেব শক্ত মানুষ, উনি রাজি হননি। অতএব থানা ভাঙচুর। মারপিট। একদিনের মাথায় ওসিকে ক্লোজ করা হলো। ছাত্ররা সংবাদ সম্মেলন করে জানালেন, ক্লোজ করায় তারা সন্তুষ্ট নন, ওসিকে বরখাস্ত করে তারপর তার বিচার করতে হবে? বিচারের রায়ও দেখলাম একজন দিয়ে দিলেন। আবদুল্লাহ সালেহীন অয়ন নামে একজন ফেসবুকে লিখলেন, ‘পটিয়া থানার ওসিকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেয়া জায়েজ হয়ে গেছে। জুলাইয়ের মতো ওসি জায়েদ নুরকেও মেরে রাস্তায় ঝুলায়ে রাখতে হবে।’ এই অয়ন কিন্তু নামগোত্রপরিচয়হীন কেউ নয়। তিনি  বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ-এর যুগ্ম সদস্য সচিব। এনসিপি’র যুগ্ম সদস্য সচিব আরিফ সোহেল তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে লেখেন “পটিয়া থানা মাটির সাথে মিশায়া দিতে হবে!” এই যে সব হুমকি, এগুলোকে কোন বিবেচনায় সভ্য সমাজের উদাহরণ হিসাবে উপস্থাপন করা যায়? এগুলোই কি মব নয়। আরিফ সোহেল বা আবদুল্লাহ সালেহীনকে সরকারের কেউ কি ডেকে জিজ্ঞাসা করবেন, কেন তারা এসব কথা বলছেন? না, কেউ জিজ্ঞাসা করবেন না। বরং তারা এসব চলতে দেবেন। এসবই যেন এই সরকারের শক্তি। 

 

পটিয়ার ঘটনা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। এর পরদিনই দেখলাম সীমান্তবর্তী পাটগ্রামে থানা ভাঙচুর করা হলো। মুরাদনগরে আগেরদিন ঘোষণা দিয়ে এক পরিবারের তিনজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো! মবের শিকার হলেন রাজনীতিবিদরাও। রংপুরে জাতীয় পার্টির জিএম কাদেরের বাড়ি ভাঙচুর করা হলো। গত মে মাসের মাঝামাঝি দেখলাম রাজধানী ঢাকার ধানমণ্ডিতে কয়েকজন গিয়ে হাজির হয়েছে হাক্কানি প্রকাশনীর মালিকের বাড়িতে। তাদের দাবি ওই মালিককে গ্রেপ্তার করতে হবে। কিন্তু যার বিরুদ্ধে কোনোই মামলা নেই, তাকে গ্রেপ্তার করা যাবে কীভাবে? এই যুক্তি শুনতে ও মানতে রাজি নয় ওই মব। দিন কয়েক আগে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদাকে এমন একটি মব ধরে গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেয়, তারা গালে জুতার বাড়ি মারে। খুলনায় সাবেক এক এসআইকে মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেন বিএনপি’র নেতাকর্মীরা। পরে তাকে ছেড়ে দেয়ার অভিযোগ তুলে কেএমপি কমিশনারের অপসারণের দাবিতে ‘সচেতন ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে কেএমপি সদর দপ্তর ঘেরাও করা হয়। কয়টার কথা আর বলবো। চলছে এসব। বরং বলা যায় চলতে দেয়া হচ্ছে।  
প্রশ্ন ছিল-কী পেলাম আমরা এক বছরে? চুলচেরা বিশ্লষণ করলে হয়তো ইতিবাচক প্রাপ্তির তালিকায় কিছু না কিছু পাওয়া যাবে। তবে সেগুলোকে নানা ভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে বুঝতে হবে। কিন্তু প্রতিদিনের জীবনযাপনে, গায়ের চামড়া দিয়ে যা কিছু উপলব্ধি করছি, তাতে খুব বেশি সন্তুষ্ট হতে পারছি না। বরং এক নিদারুণ আইনহীনতা আর অনিশ্চয়তা আমাদের তীব্রভাবে আচ্ছন্ন করে তুলছে। এর কবল থেকে মুক্তি কীভাবে সম্ভব, কিংবা আদৌ সম্ভব কিনা, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাবে।

 

এক্সক্লুসিভ'র অন্যান্য খবর