রক্তাক্ত জুলাই

তারুণ্যের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন কতোদূর?

মুনির হোসেন | এক্সক্লুসিভ
জুলাই ৫, ২০২৫
তারুণ্যের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন কতোদূর?

‘যখন রাষ্ট্র জনগণের ভাষা বোঝে না, তখন রাজপথে তরুণেরা ভাষ্য রচনা করে।’ উক্তিটির মতো বাংলাদেশেও রাষ্ট্রের নির্লিপ্ততায় তরুণরা ভাষ্য রচনা করেছিল ২০২৪ এর জুলাই-আগস্টে। রক্তক্ষয়ী এক গণ-অভ্যুত্থানের সাক্ষী হয় দেশ। যার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসে এক নতুন মোড় তৈরি হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যেভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিল তরুণ সমাজ সেটি এক উপাখ্যান। যার শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে। এক সময় এটি রূপ পায় দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক নিপীড়ন, গণতন্ত্রহীনতা, বাকস্বাধীনতার সংকোচন, নির্বাচনী অনিয়ম এবং সর্বোপরি তরুণ সমাজের ভবিষ্যৎহীনতার প্রতিক্রিয়ায় এক জনবিস্ফোরণে। 
 

৫ই আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর ৮ই আগস্ট নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যে সরকার গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে মনোযোগী হবে- এমনটাই প্রত্যাশা ছিল তরুণ প্রজন্মের। একই সঙ্গে বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্নে বিভোর তরুণদের অন্যতম দাবি ছিল জুলাই-আগস্টের গণহত্যাকারীদের বিচার এবং রাষ্ট্র সংস্কার। কিন্তু গত ১১ মাসে তারুণ্যের অসীম ম্যান্ডেট পাওয়া সরকার তার কতোটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছে তার হিসাব করতে হচ্ছে এখন। যেখানে একরাশ হতাশা আর আক্ষেপ রয়েছে। সমাজে চলমান বিশৃঙ্খলা, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, মব ভায়োলেন্স, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না হওয়া, দেশ গঠনে অনৈক্য- সব মিলিয়ে তারুণ্যের প্রত্যাশার বাস্তবায়ন অনেক দূর বলেই মনে হচ্ছে। দেশ পরিবর্তনের যে স্বপ্ন তারা দেখেছেন ২০২৪ এর গণ-অভ্যুত্থানের সময় সেই দেশ এখন অনেক দূর। নতুন বাংলাদেশ গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোরও তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। আবার অভ্যুত্থানের নায়করা জড়িয়েছেন নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে। সব মিলিয়ে এ এক অপার সম্ভাবনা হাতছাড়া হওয়ার আক্ষেপ রয়েছে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। বিশেষ করে চাকরি বাজার নিয়ে একরাশ হতাশা বিরাজ করছে তাদের মধ্যে। বিগত দিনে সরকারি চাকরি পরীক্ষা তেমন হয়নি। নিয়োগ প্রক্রিয়ায়ও রয়েছে পূর্বের মতো দীর্ঘসূত্রতা। সবশেষ সম্প্রতি প্রকাশিত ৪৪তম বিসিএসে চূড়ান্ত ফলাফলে পদ না বাড়ানো এবং ক্যাডার রিপিটের ঘটনা মারাত্মকভাবে আশাহত করেছে চাকরিপ্রত্যাশীদের। 
এমতাবস্থায় যে চাকরির জন্য তারা শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল অদূর ভবিষ্যতে সেটির পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে। 
 

২০২৪ এর গণ-অভ্যুত্থানকে বিশ্লেষণের নানা দিক আছে। আমরা যদি দেখি- প্রচলিত রাজনৈতিক দল ও জোটের বাইরে দাঁড়িয়ে তরুণদের এ জাগরণ কেবল সরকারেরই পতন ঘটায়নি, বরং রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে। প্রশ্ন হলো- এই গণজাগরণ কি শুধু একটি তাৎক্ষণিক পরিবর্তন এনে থেমে গেছে, নাকি একটি বৃহত্তর রূপান্তরের সূচনা করেছে? তরুণ প্রজন্ম বরং এখানে বৃহত্তর রূপান্তরের স্বপ্ন দেখে। কারণ এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাস। ২০১৮ সালের নির্বাচন থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ গণতন্ত্রের কাঠামো অনেকের নজরে আসে। তবে ২০২৪ সালের ভোটপ্রক্রিয়া ছিল তরুণ সমাজের কাছে সহ্যের শেষ সীমা। রাতের আঁধারে ভোটদান, দলীয় নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন, বিরোধী দলের দমন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর নিয়ন্ত্রণ- এসবই তরুণদের হতাশা ও ক্ষোভকে দীর্ঘদিন ধরে জমতে দেয়। যার কারণে ছাত্র-জনতার সম্মিলনে এক অভূতপূর্ব সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলন ছিল অরাজনৈতিকের আড়ালে রাজনৈতিক, তবে অবশ্যই দলনিরপেক্ষ। নেতৃত্বে ছিল জনগণ, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম। স্বপ্ন ছিল বৈষম্যহীন উদার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে এ আন্দোলনের সূত্রপাত হলেও এর সঙ্গে আরও জড়িত ছিল- মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক পরিবেশ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান, আমলাতন্ত্র ও রাজনৈতিক স্তরে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং সর্বপরি বিসিএস সহ সরকারি চাকরিতে মেধার মূল্যায়ন। এসব দাবি থেকে বোঝা যায়, তরুণরা কেবল ক্ষমতার রদবদল চায়নি, তারা রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তি পুনর্গঠনের আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার তার কতোটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছে সেই প্রশ্ন এখন রাখতেই হচ্ছে। 
বিশেষ করে কর্মসংস্থান নিয়ে একরাশ হতাশা আছে তরুণদের মধ্যে। চাকরির পরীক্ষা নিয়মিত হচ্ছে না। নতুন সার্কুলার নেই। তার মধ্যে সম্প্রতি প্রকাশিত ৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল তো ছিল পুরোপুরি প্রশ্নবিদ্ধ। চাকরি যেখানে সোনার হরিণ সেখানে অসংখ্য ক্যাডার রিপিটের মতো ঘটনা ঘটেছে। আগেকার বিসিএসগুলোর মতো বাড়ানো হয়নি পদসংখ্যা। নন-কোটা বিসিএসে ফিরিয়ে আনা হয়েছে কোটা পদ্ধতি। যার কারণে তীব্র ক্ষোভ আর হতাশা দেখা গেছে তরুণদের মধ্যে। এনসিপি’র যুগ্ম সদস্য সচিব ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট মোহাম্মদ মিরাজ মিয়া সম্প্রতি এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, ‘আমার মনে হয় এদেশে শিগগিরই আরেকটা বড় আন্দোলন হতে যাচ্ছে, সেটাও হবে চাকরির পরীক্ষাগুলোকে কেন্দ্র করে। চাকরি দেয়ার মতো অসংখ্য পদ খালি থাকা সত্ত্বেও, সেগুলো সব রেখে দেয়া হয়েছে কোনো এক রহস্যজনক কারণে।’ অন্যদিকে সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলন এক স্ট্যাটাসে বলেন, ‘বিপিএসসি গত ৩০শে জুন বিসিএস ৪৪ এর ফলাফলে ১৬৯০ জন সুপারিশকৃতদের মধ্যে এমন অসংখ্য (৮০০+) প্রার্থী রয়েছেন যারা কিনা আগের ৪১ ও ৪৩তম বিসিএসে একই ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়ে চাকরিরত আছেন। ফলে, উক্ত ৮০০+ প্রার্থী সুপারিশ পাওয়া পদগুলো শূন্য থেকে যাবে। এমনকি, ৪৪ এর ফলাফলে দেখা গেছে যে, ডেল্টাল ক্যাডার পদে সুপারিশকৃত ২৫ জনের মধ্যে ১৫ জন আগের বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে কর্মরত আছে। ৪১ এবং ৪৩ বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে চাকরিরত কর্মকর্তাদের আবার সেই একই ক্যাডারে ৪৪তম বিসিএস পরীক্ষায় সুপারিশ করার কারণ কি পিএসসি’র ব্যর্থতা নাকি অজ্ঞতা অথবা অবহেলা। সরকারি চাকরির চার লক্ষাধিক পদ খালি আছে। সঠিক জরিপ করা হলে আসলে এই দেশে প্রকৃত জনসংখ্যা কতো কোটি এবং শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কতো, তা কেউ জানে না। সেটা যে ভয়াবহ একটা সংখ্যা দাঁড়াবে, তা সহজেই অনুমেয়। ২০২৫ সালে এসে এই আধুনিক এবং ডিজিটাল যুগে আগে চাকরিরত প্রার্থীদের পরবর্তীতে পুনরায় একই ক্যাডারে উত্তীর্ণদের কি বাদ দেয়া যেত না! তাহলে তো এই শূন্য পদগুলোতে নতুন প্রার্থী নিয়োগ দেয়া যেত। পিএসসি তথা সরকারপ্রধানের কাছে একান্ত অনুরোধ, যুব সমাজের কথা চিন্তা করে ৪৪তম বিসিএসে আগে কর্মরত একই ক্যাডারে পুনরায় সুপারিশকৃতদের বাদ দিয়ে ৪৪তম বিসিএসের মেরিট লিস্ট  থেকে ক্যাডার সার্ভিসে সুপারিশ করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এই সহজ একটা বিষয়, যা ন্যায়বিচারের দাবিদার, তা পিএসসি’র সম্মানিত চেয়ারম্যান এবং মেম্বার মহোদয়গণ বুঝবেন না, সেটা তো হতে পারে না। আমাদের সব কিছুই তো মানবকল্যাণে। আমাদের সন্তানদের জন্যই তো আমরা। কেন আমাদের বাচ্চারা অসহায় হয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াবে! একটা ন্যায়বিচারের জন্য আকুতি জানাবে।’ সব মিলিয়ে কর্মসংস্থান নিয়ে সরকার যে খুব বেশি মনোযোগী সেটি বলার সুযোগ নেই। ইন্টেরিম হয়তো তরুণদের কর্মসংস্থান থেকে অন্য বিষয়গুলোতে বেশি মনোযোগী হচ্ছে। কিন্তু তরুণদের চিন্তা বাদ দিয়ে যে সেটি নয় হয়তো ইন্টেরিম ভুলে গিয়েছে। 
 

অন্যদিকে ৬ মাসেও জুলাই ঘোষণা ও জুলাই সনদ দিতে না পারা অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম ব্যর্থতা বলেই মনে করছে তরুণরা। কারণ চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানকে স্বীকৃতি দেয়ার এ কাজটি সরকারকেই করতে হবে। যদি এ সরকার এটি করতে বাধ্য না হয় তাহলে এক সময় এ আন্দোলন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে ট্যাগ পাবে। অন্যদিকে গণহত্যার কুশীলবদের বিচারও এখনো বৃহৎ অর্থে দৃশ্যমান না। হত্যাকারীরা বিদেশে বসে জুলাই অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোকে নিয়মিত হুমকি দিচ্ছে। আর রাষ্ট্র সংস্কার ঠিক পথে আগাচ্ছে বলার সুযোগ নেই। রাজনৈতিক শক্তিগুলোর বাধার কারণে এটি সর্বশেষ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা বলা মুশকিল। ছাত্রসমাজের যে স্বপ্ন সেটি খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে না রাজনৈতিক দলগুলো। তারা যেনতেন ভাবে ক্ষমতায় যেতে চায়। ক্ষমতায় গিয়ে এসব সংস্কারে হাত দেবে বলে বলা হচ্ছে। কিন্তু যেখানে অন্তর্বর্তী সরকার এটি করতে ব্যর্থ হচ্ছে সেখানে একটি রাজনৈতিক সরকার কতোটুকু আন্তরিকতা দেখাবে তা সময়ই বলে দেবে। এটা বাস্তব যে রাজনৈতিক সরকার কখনো তার দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার অন্তরায় হয় এমন কোনো সংস্কার করতে দেবে না। অন্যদিকে বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি দাঁড়িয়েছে তাতে দলগুলো চায় ক্ষমতার একচ্ছত্র আধিপত্য। তারা কোনোভাবেই ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হোক সেটি চায় না। তাই রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার করা না গেলে আদতে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। 
এ ছাড়া সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থার যে স্বপ্ন দেখছে তরুণ প্রজন্ম সেটিও অধরাই থেকে যাবে। চুরি, ছিনতাই, কিশোর গ্যাংসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়েই চলছে। বিশেষ করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা যায়নি। আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ইতিমধ্যে মানুষকে ত্যক্ত-বিরক্ত করে তুলেছে। মব ভায়োলেন্সের মতো ঘটনাও ঘটছে অহরহ। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও পরমত সহিষ্ণুতার লক্ষণ নেই। মানুষ দিন দিন আক্রমণাত্মক হয়ে যাচ্ছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটা ক্রমশ সংকোচিত হচ্ছে। যেগুলো তরুণদের তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। 
সব মিলিয়ে তরুণদের স্বপ্নের বাংলাদেশ এখনো অনেক দূর। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এসবে মনোযোগী হতে হবে। নির্বাচনের আগে বিচার, সংস্কারের দৃশ্যমান অগ্রগতি হতে হবে। তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের খাত তৈরি করতে হবে। সমাজে বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তবেই নতুন বাংলাদেশ তৈরি হবে। অন্যথায় এ অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা অধরাই থেকে যাবে। মনে রাখতে হবে, ২০২৪ এর গণ-অভ্যুত্থান ছিল কেবল সরকারের পতনের নয়- বরং একটি জাতির নবজাগরণের প্রতীক। তরুণ সমাজ রাষ্ট্রের কাছে চেয়েছিল সাম্য, সমতা এবং সুশাসন। রাষ্ট্র যদি তরুণদের আশা পূরণে ব্যর্থ হয়, তবে আবারো রাজপথেই রচিত হবে নতুন ভাষ্য। 

এক্সক্লুসিভ'র অন্যান্য খবর