পার্শ্ব ভাবনা

থলের বিড়াল ভেতরে নাকি বাইরে

খায়রুল আনোয়ার | এক্সক্লুসিভ
জুলাই ৫, ২০২৫
থলের বিড়াল ভেতরে নাকি বাইরে

পাকিস্তানে তখন সেনাশাসক জেনারেল জিয়াউল হকের শাসনকাল চলছিল। এর অনেক আগেই ১৯৭৪ সালের ভারত প্রথমবারের মতো সফল পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালায়। ভারত বিশ্বে ষষ্ঠ পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই খবর পাকিস্তানের জন্য একই সঙ্গে ছিল অস্বস্তিকর এবং উদ্বেগের। আর এ কারণে জেনারেল জিয়াউল হকের অনেক আগে থেকেই পাকিস্তান পারমাণবিক কর্মসূচিতে হাত দেয়। মনোযোগী হয় পারমাণবিক বোমা তৈরিতে। আর গবেষণার জন্য ভারতের গোয়েন্দা নজরদারি এড়াতে গোপন স্থান হিসেবে বেছে নেয়া হয় রাওয়ালপিন্ডির একটি ছোট শহর ‘কাহুতা’কে। জিয়াউল হক ভারত সফরে গেলে প্রভাবশালী সাময়িকী ‘সানডে’ তার একটি সাক্ষাৎকার নেয় । সাক্ষাৎকারে কাহুতায় পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে প্রশ্নের জবাবে জেনারেল বলেছিলেন, ্তুঞযবৎব রং হড় পধঃ রহ কধযঁঃধ্থ, এটিই সাক্ষাৎকারের শিরোনাম হয়েছিল। জিয়াউল হক বিষয়টি হালকা চালে এড়িয়ে গেলেও পাকিস্তান অনেকদিন যাবৎ পারমাণবিক কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। দেশটি ১৯৯৮ সালের মে মাসে প্রথম পারমাণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটায়। তার কিছুদিন আগে চালানো ভারতের আরও একটি সফল পারমাণবিক পরীক্ষার জবাবে এই বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
 

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের রাখাইনের মধ্যে ‘মানবিক করিডোর’ নিয়ে দুই উপদেষ্টার বিপরীতমুখী বক্তব্য, কূটনৈতিক পাড়া ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়ানোয় প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, ‘থলের ভেতর বেড়াল আছে নাকি নেই?’ মানবিক করিডোর বিষয়টি কি একেবারেই বাদ দেয়া হয়েছে নাকি আপাতত স্থগিত হয়ে আছে? এদিকে এখনো রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করে ঠেলে পাঠাচ্ছে আরাকান আর্মি। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরাকান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধ করতে কক্সবাজারের আশ্রয়শিবির থেকে সদস্য সংগ্রহ করছে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। রোহিঙ্গাদের এই বিদ্রোহ মিয়ানমারের আন্তঃসাম্প্রদায়িক সম্পর্কে ভয়াবহ ক্ষতি এবং প্রত্যাবাসন সম্ভাবনাও ক্ষীণ করবে। ক্রাইসিস গ্রুপ বলছে, বাংলাদেশের সঙ্গে থাকা মিয়ানমারের সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করছে আরাকান আর্মি। ঢাকা ও তার নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর উচিত শিবিরে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব নিয়ন্ত্রণে জোর প্রচেষ্টা চালানো।
করিডোর বিষয়টি কেন কিছুদিন আগে পর্যন্ত আলোচনা এবং বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়? এর সূত্রপাত ঘটান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। গত ২৭শে এপ্রিল নিজ মন্ত্রণালয়ে এক ব্রিফিংয়ে উপদেষ্টা জানান, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মধ্যে একটি মানবিক করিডোর স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সেদিন তিনি আরও বলেন, ‘তবে আমাদের কিছু শর্ত আছে। এ ব্যাপারে আপাতত বিস্তারিত কিছু বলছি না। সেই শর্ত যদি পালন করা হয়, অবশ্যই আমরা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করবো।’ করিডোর বাংলাদেশের জন্য নিরাপদ হবে কিনা এ প্রশ্নে তার জবাব ছিল, ‘এটা মালপত্র যাওয়ার ব্যবস্থা করা, অস্ত্র তো আর নেয়া হচ্ছে না।’ পররাষ্ট্র উপদেষ্টার এই বক্তব্যের পর থেকে শুরু হয়ে যায় নানামুখী আলোচনা ও বিতর্ক। প্রায় সকল রাজনৈতিক দল এমনকি জাতীয় নাগরিক পার্টি এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। রাজনীতির মাঠ ছাপিয়ে বিষয়টি চলে যায় সেনানিবাসেও। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ২১শে মে অফিসারদের সঙ্গে এই বৈঠকে বলেন, ‘মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সঙ্গে মানবিক করিডোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত একটি নির্বাচিত সরকার থেকেই আসতে হবে। এটি হতে হবে বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। করিডোরের ব্যাপারে জাতীয় স্বার্থ দেখতে হবে। রোহিঙ্গাদের ফেরত দেয়ার বিষয়ও এখানে যুক্ত।’ চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের বিষয়েও কোনো সিদ্ধান্ত এই সরকারের নেয়া উচিত হবে না বলে জেনারেল ওয়াকার মত প্রকাশ করেন।
 

করিডোর নিয়ে উত্তাপ ছড়ানোর বেশ কিছুদিন পর মুখ খোলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান। ২১শে মে সংবাদ সম্মেলন ডেকে ড. খলিল বলেন, ‘আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলছি, করিডোর নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কারও কথা হয়নি। কারও সঙ্গে কথা হবেও না। আরাকানের সে অবস্থা তাতে করিডোর স্থাপন নিয়ে আলোচনার অবস্থা নেই।’ গত এপ্রিলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা করিডোর স্থাপনের বিষয় সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে, নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, ‘তিনি করিডোর শব্দটা উচ্চারণ করেছিলেন। এরপরেই কিন্তু বলেছিলেন পাথওয়ে। সেটা ‘স্লিপ অব টাং’ ছিল। কথাবার্তায় অনেক সময় ভুল হতে পারে।’
 

প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঈদুল আজহার আগে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে করিডোর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, ‘করিডোর দেয়া হয়েছে বলে যে প্রচার চলছে তা সর্বৈব মিথ্যা। এটা চিলে কান নিয়ে যাওয়ার মতো গল্প।’ করিডোর নিয়ে এত বক্তৃতা, বিবৃতি, বিতর্কের পরেও কথা থেকে যায়। প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার দেয়া বক্তব্য কি নিছক ‘স্লিপ অব টাং?’ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা পদে থেকে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সম্মতি বা সংকেত ছাড়া তিনি এমন কথা বলতে পারেন কিনা?  আর এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা উপদেষ্টার ‘কথাবার্তায় অনেক সময় ভুল হতে পারে’ বলে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা যদি ঠিক হয়, তারপরেও প্রশ্ন থেকে যায়, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা নিজে কেন এ বিষয়ে চুপ হয়ে গেলেন? করিডোর নিয়ে প্রথমে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্য, পরে নিরাপত্তা উপদেষ্টার এ নিয়ে দীর্ঘ ব্যাখ্যা কি এবং প্রকৃত অর্থই প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে উল্লেখিত ‘চিলে কান নিয়ে যাওয়ার’ গল্প?
এদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকার নানামুখি তৎপরতা চালাচ্ছে। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সম্প্রতি ওয়াশিংটন সফর করেন। সেখানে তিনি মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টোফার ল্যান্ডোর সঙ্গে বৈঠক করেন। তাদের আলোচনায় রোহিঙ্গা সমস্যাসহ বেশ কিছু বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুস বিভিন্ন দেশ সফরকালে এ নিয়ে জোরালো বক্তব্য রাখছেন। গত ৬ জুন দেয়া ভাষণে তিনি  উল্লেখ করেন যে, এপ্রিলে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত বিমিসটেক সম্মেলনের ‘সাইড লাইনে’র আলোচনায় মিয়ানমার সরকার প্রথমবারের মতো এক লাখ আশি হাজার প্রত্যাবাসনযোগ্য রোহিঙ্গা শরণার্থীর তালিকা ঘোষণা করে। বাস্তবতা হচ্ছে, তালিকা অনুযায়ী একজন রোহিঙ্গাও এখনো পর্যন্ত ফিরে যায়নি। বরং এর বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা প্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। গত ১৮ জুন প্রাণভয়ে নৌকায় নাফ নদ পেরিয়ে নাইট্যাংপাড়া সীমান্ত দিয়ে এক নৌকায় ৩৩ জন টেকনাফে প্রবেশ করেন। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে রোহিঙ্গাদের প্রবেশ ঘটছে। গণমাধ্যমের খবর বলছে, রাখাইন রাজ্য থেকে গত ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত নতুন করে ১ লাখ ১৩ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত দেড় বছরে আসা রোহিঙ্গাদের নতুন হিসাবে শনাক্ত করা হয়েছে। এমনকি সম্প্রতি ভারত মৌলভীবাজারের কুমারশাইল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশি বলে ১২ রোহিঙ্গাকে পুশইন করে। আরাকান আর্মি সদস্যরা রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করছে। যাদের কাছে অর্থ আছে তাদের পালানোর সুযোগ করে দেয়। আবার রোহিঙ্গাদের অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করে। মুক্তিপণ দেওয়ার পর ছেড়ে দেয়। কিন্তু কিছুদিন পর আবার ধরে নিয়ে যায়। অনেককে আটকে রেখে অস্ত্রসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয় আরাকান আর্মি।
 

কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে বর্তমানে ১৩ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। ক্যাম্পে প্রতিবছর ৩০ হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে। আগামী দিনে রোহিঙ্গাদের খাবারের টান পড়ার শঙ্কাও দেখা দিয়েছে। খাদ্য সংকটের তীব্র ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জনপ্রতি মাত্র ১২ ডলারের মানবিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) বেশ আগেই খাদ্য সহায়তার পরিমাণ অর্ধেক কাটছাঁট করার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। সংশ্লিষ্টরা এসব পরিস্থিতি বিবেচনায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভয়াবহ সংকটের আশঙ্কা করছেন। খাদ্য ও স্বাস্থ্য সমস্যার পাশাপাশি ক্যাম্পে আইন-শৃংখলায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অবৈধ অস্ত্র, মাদক ও পাচারের ঘটনায় রোহিঙ্গাদের জড়িত পড়ার প্রবণতা আরো বাড়বে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। প্রত্যাবাসনের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন দূরের বিষয়, নতুন করে প্রতিদিন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশ সংকটের নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
 

‘মানবিক করিডোর’ সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী ‘পাথওয়ে’ অথবা ‘হিউম্যান চ্যানেল’ - যে ভাবেই বলা হোক না কেন বিষয়টি কি একেবারেই বাতিল হয়ে গেছে? নাকি রাজনৈতিক দল, সেনাবাহিনী প্রধানের বক্তব্যসহ বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়ায় বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে? এই প্রশ্নের জবাব সম্ভবতঃ এখনই মিলবে না। বর্তমানে বাংলাদেশ ভূরাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে দাঁড়িয়ে। একদিকে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত, মিয়ানমার, অপরদিকে চীনের প্রভাব বলয় বিস্তারের মাঝে গুঞ্জন রয়েছে পরাশক্তি আমেরিকাকে নিয়ে। মিয়ানমার ঘিরে আমেরিকার দৃষ্টি নিক্ষেপের গুঞ্জনও শোনা যাচ্ছে বেশ জোরেশোরে। দীর্ঘদিন আমেরিকা প্রবাসী একদা সিভিল সার্ভিসের ডঃ খলিলুর রহমানকে দেশে এনে শরণার্থী বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়ার পর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসাবেও নিয়োগ দেওয়ার মধ্যে অনেকে যোগসূত্র খুঁজছেন। সম্প্রতি আমেরিকায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র সচিব করা হয়েছে। গণমাধ্যমের খবর, মিয়ানমারে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন এমন একজন কূটনীতিককে ঢাকায় সে দেশের হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে ‘থলের বিড়াল’ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। 
কলাম লেখক

এক্সক্লুসিভ'র অন্যান্য খবর