কলকাতার চিঠি

আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ভারতের নিঃসঙ্গতার চ্যালেঞ্জ

পরিতোষ পাল | এক্সক্লুসিভ
জুলাই ৫, ২০২৫
আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ভারতের নিঃসঙ্গতার চ্যালেঞ্জ

জম্মু ও কাশ্মীরের  পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর অপারেশন সিঁদুর ও চারদিনের যুদ্ধের সাফল্যগাঁথা  ভারতের শাসক দল বিজেপি চারদিকে ফেরি করে চলেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেও অপারেশন সিঁদুর থিম বিপণনের কাজে নেমে পড়েছেন। এমনকি সামনের নির্বাচনী মঞ্চেও এই অপারেশন সিঁদুরের সাফল্য তুলে ধরে মানুষের আবেগে তরঙ্গ তোলার সক্রিয় চেষ্টা করে চলেছেন। অবশ্য সিঁদুর রাজনীতি নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে সিঁদুর মাহাত্ম্য তুলে ধরেছিলেন। আর তার পরেই মোদিকে তীব্র আক্রমণ করে মমতা বলেছেন, একসময় উনি নিজেকে চা-ওয়ালা বলতেন। এরপর বললেন চৌকিদার। এখন সিঁদুর বেচতে এসেছেন। এভাবে সিঁদুর বেচা যায় না। এতে দেশের মা-বোনদের অসম্মান করা হয়।
 

কিন্তু পাকিস্তান ও সন্ত্রাসবাদ নিয়ে ভারত বার বার সোচ্চার হওয়ার চেষ্টা করেছে। নিজেদের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে বিশ্বের ৩২টি রাষ্ট্রে একাধিক বহুদলীয় প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা ও অপারেশন সিঁদুরের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে প্রচুর কাঠখড় পুড়িয়েছেন সাংসদ ও কূটনীতিকরা। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের কঠোর ভূমিকাকেও প্রচারের আলোয় নিয়ে আসার চেষ্টা হয়েছে। এক্ষেত্রে ভারতের সব বিরোধী দলকে মোদি মাঠে নামিয়েছিলেন দেশের স্বার্থের কথা তুলে ধরে। জাতীয়তার আবেগকে মাথায় রেখে বিরোধী দলগুলো পর্যন্ত মোদির বিশ্ব প্রচার পরিকল্পনাকে সমর্থন করেছেন। কিন্তু ভারত কি বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন আদায় করতে পেরেছেন? তা নিয়েই এখন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সোচ্চারে প্রশ্ন করছেন।   
অথচ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র  মোদি প্রথমে ভারতকে বিশ্বগুরু (বিশ্বের শিক্ষক) এবং পরে বিশ্বামিত্র (বিশ্বের বন্ধু) হিসেবে তুলে ধরার দাবি করেছেন। কিন্তু মোদি কি সংকটের সময়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছেন?
 

পেহেলগামে পরবর্তী সময়ে যে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি একের পর এক ধাক্কা খাচ্ছে তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। ভারতের বৃহৎ বিরোধী দল কংগ্রেস ভারতের কূটনীতির ব্যর্থতাকে তুলে ধরে বলেছে, ভারত একের পর এক কূটনৈতিক ব্যর্থতার নজির তৈরি করে চলেছে। এমনকি বিশ্ব কূটনীতিতে একঘরে হয়ে পড়ছে তার পররাষ্ট্রনীতির জন্য। কংগ্রেসের মতে, নরেন্দ্র মোদির অধীনে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি  মতবাদের চেয়ে নাটকের উপর বেশি নির্ভরশীল। 
আর তাই ভারত সামরিক সাফল্যকে পাকিস্তানের উপরে স্থায়ী কূটনৈতিক সুবিধায় রূপান্তর করতে ব্যর্থ হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই ভারতের অবস্থান  উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে।
সমপ্রতি সাংহাই পাকিস্তানের রাজনৈতিক শাসক না হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেভাবে লাঞ্চে আমন্ত্রণ জানিয়ে একান্তে বৈঠক করেছেন তাকেও ভারতের কূটনৈতিক ব্যর্থতার নজির বলে মনে করা হচ্ছে। অথচ ট্রাম্পের সঙ্গে মোদির বন্ধুত্বের জয়গাঁথা মাঝে মাঝেই উচ্চারিত হয় গর্বের সঙ্গে। সেই বন্ধুত্বের কোনো মূল্যই ট্রাম্প দিচ্ছেন না এটা স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও মোদি মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন। 
 

গাজায় ইসরাইলের নির্মম গণহত্যার নিন্দায় জাতিসংঘের প্রস্তাব থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার পাশাপাশি ইরানে ইসরাইলের ধ্বংসাত্মক হামলার কোনো জোরালো প্রতিক্রিয়া না জানানোর মধ্যদিয়ে ভারত তার পূর্বেকার পররাষ্ট্রনীতির ভারসাম্য থেকে অনেকটাই সরে এসেছে বলে জানিয়েছেন কূটনৈতিক মহল। মোদি সরকারের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে কংগ্রেস জানতে চেয়েছে, ভারত যুদ্ধের বিরুদ্ধে, গণহত্যার বিরুদ্ধে এবং ন্যায়বিচারের পক্ষে তার নীতিগত অবস্থান ত্যাগ করেছে কিনা।
বিশ্বের দরবারে ভারত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে প্রচারকে তুলে ধরতে প্রধানমন্ত্রী থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সাংসদরা জোরদার চেষ্টা করলেও কোনো দেশ পাকিস্তানকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেনি বা ভারতের পক্ষে সদর্থক বিবৃতি দেয়নি। সমপ্রতি চীনে অনুষ্ঠিত দশ দেশীয় সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের বৈঠকে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং সন্ত্রাসবাদ নিয়ে ভারতের অবস্থান জোর গলায় ব্যাখ্যা করার পরও কোনো দেশ তাকে আমল দেয়নি। ফলে সম্মেলনের যৌথ বিবৃতির খসড়ায় ভারতের বক্তব্যকে স্থান দেয়া হয়নি। ইরানের মতো বন্ধু দেশ থাকা সত্ত্বেও কোনো দেশই ভারতকে সমর্থন করেনি। বরং পাকিস্তানের মনোভাবের প্রতিফলন ঘটিয়ে ইঙ্গিতে বলা হয়েছে বেলুচিস্তানে বিদ্রোহের পেছনে ভারতের মদত রয়েছে।
অথচ বিশ্ব অঙ্গনে ভারতের এমন নিঃসঙ্গ অবস্থান অতীতে ছিল না। মোদি জমানার প্রথমার্ধে ২০১৬ সালের উরি এবং ২০১৯ সালের পুলওয়ামা কাণ্ডের পর ভারত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রশ্নাতীত সমর্থন ও সহানুভূতি পেয়েছিল। সেই সমর্থন এতটাই প্রবল ছিল যে,  জৈশ-ই-মোহাম্মদের প্রধান মাসুদ আজাহারকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সন্ত্রাসবাদীর তালিকায় রাখাকে চীনের মতো দেশও সমর্থন জানিয়েছিল। কিন্তু মাত্র ৬ বছরের ব্যবধানে ভারত সঙ্গী হারিয়ে একঘরে হয়ে পড়েছে।             
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জাতিসংঘের মঞ্চেও ভারতের কূটনৈতিক ব্যর্থতা বার বার স্পষ্ট হয়েছে। আর তাই  পেহেলগামে হামলার জন্য পাকিস্তান-ভিত্তিক গোষ্ঠীগুলোর স্পষ্ট নিন্দা আদায়ের প্রচেষ্টায় ভারত সফল হতে পারেনি। চীনের সহায়তায় পাকিস্তান জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতিতে নির্দিষ্ট অপরাধীদের উল্লেখযোগ্যদের আটকাতে সক্ষম হয়েছে সফলভাবে। চীন, রাশিয়া, ইরান, তুরস্ক এবং মালয়েশিয়ার সমর্থন পাকিস্তানের পক্ষেই গিয়েছে। ফলে এরা সকলেই পাকিস্তানের দাবি মতো ‘সুষ্ঠু তদন্তের’ দাবি করেছে। এ ব্যাপারে ভারতের কূটনীতির দুর্বলতাকেই দায়ী করছেন পর্যবেক্ষকমহল। 
 

শুধু তাই নয়, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের তালেবান নিষেধাজ্ঞা কমিটির সভাপতি এবং সন্ত্রাস দমন কমিটির সহ-সভাপতি হিসেবে পাকিস্তানের পদোন্নতি ভারতের জন্য একটি কূটনৈতিক ধাক্কা ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা, এই গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে অধিষ্ঠানের ফলে পাকিস্তান  সন্ত্রাসবাদ এবং আফগানিস্তান সম্পর্কে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরতে  সক্ষম হবে। প্রয়োজনে ভারতবিরোধী বক্তব্য প্রচারের জন্য এই প্ল্যাটফরমকে ব্যবহার করতে পারে। এর ফলে  ভারতের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে বলে মনে করা হচ্ছে। 
কূটনৈতিক ব্যর্থতার তালিকা তুলে ধরে কংগ্রেস নেতা পবন খেরা বলেছেন, ভারতের বিশ্ব মর্যাদা ভেঙে পড়ছে। মোদির জমানায় ভারতের পররাষ্ট্রনীতি ধারাবাহিকভাবে যে ভেঙে পড়ছে তার অজস্র উদাহরণ চোখের সামনে রয়েছে।
সৌদি আরব সমপ্রতি যে ১৪টি দেশের জন্য ভিসা বাতিল করেছে সেই তালিকায় রয়েছে ভারতও। অথচ এই সৌদির সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সামরিক সম্পর্ক খুবই শক্তিশালি ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে বলে দাবি করা হয়। পশ্চিম এশিয়া এবং অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি)ভুক্ত দেশগুলো কাশ্মীর ও মুসলিমদের অধিকার নিয়ে ভারতের নিন্দাই করে চলেছে।
 

পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদের পীঠস্থান হিসেবে তুলে ধরা হলেও রাশিয়ার মতো ভারত বন্ধু দেশও পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক ও জ্বালানি চুক্তি করেছে। এদিকে ভারতের তীব্র আপত্তিকে কানে না নিয়ে এডিবি, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ পাকিস্তানের দেউলিয়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে বিশাল পরিমাণ অর্থ সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে ভারতের হতাশ হওয়ার কারণ রয়েছে। 
এদিকে চীনের প্রভাব বাড়তে থাকায় এসসিও এবং ব্রিকস এখন চীনের মুখপাত্রে পরিণত হয়েছে। সব আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ফোরামে ভারত কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে। অকেজো সার্কের পাল্টা হিসেবে চীন ও পাকিস্তান আলাদা জোট গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষার নামে। সেই জোটে বাংলাদেশও শামিল হতে পারে। একদফা তিন দেশ বৈঠকও করেছে।
অন্যদিকে ভারতের নিকট প্রতিবেশীদের মধ্যেও চীনের প্রভাব বাড়ছে। সামপ্রতিক দৃষ্টান্ত হলো বাংলাদেশে চীনের সার্বিক উপস্থিতির সম্ভাবনা। মালদ্বীপ থেকে ভারত একরকম বিতাড়িত। শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের কৌশলগত সম্পদ চীন লিজ নিয়ে বসে রয়েছে। নেপালও ভারতের জমির দাবি জানিয়ে নিজেদের মানচিত্র তৈরি করেছে। সমপ্রতি সেখানে রাজতন্ত্রের পক্ষে যে আন্দোলন হচ্ছে তাতে ভারতের সমর্থন রয়েছে বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে নেপালের শাসক দলের পক্ষ থেকে।
সার্বিকভাবে ভারতের আন্তর্জাতিক কূটনীতির দায়বদ্ধতা নিয়ে আলোচনার দাবি উঠেছে। দেশের  ভেতরে সাফল্যের ঢক্কানিনাদ জোরদার হলেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্যর্থতার জবাবদিহির প্রযোজনীয়তা রয়েছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ মহল। ভারতের শীর্ষ নেতাদের উচিত এই নিঃসঙ্গতার কারণ খুঁজে বের করে সেই মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তা না হলে ভারত আগামী দিনে নানা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। 

 

এক্সক্লুসিভ'র অন্যান্য খবর