প র্য বে ক্ষ ণ

ডাকসু নির্বাচন যেন ফাকসু না হয়ে যায়

মোজাম্মেল হোসেন | বিশেষ রচনা
আগস্ট ১৬, ২০২৫
ডাকসু নির্বাচন যেন ফাকসু না হয়ে যায়

সংক্ষেপে ‘ডাকসু’ বলে বহুল পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নির্বাচন ৬ বছর পরে হতে যাচ্ছে আগামী ৯ই সেপ্টেম্বর। এটি একটি সহজ ঘটনা নয়। গত ২৯শে জুলাই নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণার পরই চঞ্চল হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস। চঞ্চল না বলে অস্থির বললেই সত্যের কাছাকাছি হয়। এর আঁচ যে ভেতরে ভেতরে দেশের অন্তত বড় দু’টি রাজনৈতিক দলের অফিসেও লাগেনি তা বলা যায় না। কারণ একদা ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলে গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত এই উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামটি পাশ্চাত্যের শিক্ষাজগৎ প্রায় ভুলতে বসলেও দেশের অস্থির রাজনীতির ডামাডোলে ডাকসুকে আমাদের ‘দ্বিতীয় পার্লামেন্ট’ বলে আদর করে ডাকা যেতেই পারে। ভোটার সংখ্যা ৩৯ হাজার ৭৭৫ জন। ছাত্র-ছাত্রীর অনুপাত প্রায় সমান সমান। শুধু তা দিয়ে নয়, বরং ডাকসুর রাজনৈতিক উত্তাপ এতই বেশি যে, ছ’বছর আগে সর্বশেষ নির্বাচনটি হয়েছিল ২০১৯ সালে; তার আগে ২৯ বছর নির্বাচন হয়নি। এতই গুরুত্বপূর্ণ এই ‘পার্লামেন্ট’!


গত বছর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে দুনিয়া কাঁপানো জেন-জি ছাত্রদের জুলাই অভ্যুত্থানে পনের বছরের একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগকারী শাসকদল আওয়ামী লীগ ও তার লৌহমানবী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের মাধ্যমে সূচিত রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদগুলোর দীর্ঘকাল তামাদি হয়ে থাকা নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আরও আগেই নেয়ার দাবি ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাকসু) ও ১৫ তারিখে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাকসু)তে নির্বাচন হবে। এই দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ে যথাক্রমে ৩৩ ও ৩৬ বছর পরে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। 


তারিখ ঘোষণার পরে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়েই নানা বিষয়ে অস্থিরতা। জাহাঙ্গীরনগরে গত এপ্রিলে একবার তারিখ দিয়ে ‘জুলাই হত্যার বিচার’ প্রশ্নে টানাপড়েনে পিছিয়ে বর্তমান তারিখ দেয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগও কিছু ছাত্র তুলেছিল। রাজশাহীতে ভোটগ্রহণ ছাত্রাবাসের পরিবর্তে একাডেমিক ভবনে হোক দাবি তুলে কয়েকটি ছাত্র সংগঠন অনশন পর্যন্ত করে ফেলেছে। আরও আছে বিভিন্ন নামের গ্রুপের সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা রকম আক্রমণাত্মক প্রচার বন্ধ করার দাবি ও দোষীদের  ভোটাধিকার বাতিল চেয়ে হৈ-হল্লা ইত্যাদি। এ সমস্যা এখন সব ক্যাম্পাসেই আছে। আর  প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনগুলো জয়ের নিশ্চয়তার জন্য বিভিন্ন রকম নৈতিক-অনৈতিক কৌশল ভাজতে শুরু করছে। এর বড় বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। গত ১৫ বছর ছাত্রলীগের একাধিপত্যের যুগে তাদের আনুগত্য করার জন্য ছাত্রদের ওপর নানা রকমের অত্যাচার ঘটতো। যেমন সিট বণ্টনের দায়িত্ব হাউজ টিউটর অফিসের পরিবর্তে ছাত্রনেতারা নিজেদের হাতে নিয়ে নিয়েছিলেন এবং অপেক্ষমাণ ছাত্রদের ‘গণরুমে’ রেখে দলীয় সভা-মিছিলে জোর করে নিয়ে যাওয়া, আর্থিক দুর্নীতি এমনকি দৈহিক নির্যাতন পর্যন্ত করার অভিযোগ আছে। 

 

গত বছর আন্দোলনের সময় ১৫ই জুলাই ছাত্রলীগ সন্ত্রাস চালায় ও পরিণামে পরের দিন একজোট হওয়া আন্দোলনকারীদের দ্বারা ছাত্রলীগ বিতাড়িত হয়। এখন রাজনৈতিক দলের অনুসারী ছাত্র সংগঠনের ক্যাম্পাসে, ছাত্রাবাসে কাজ না করতে দেয়ার পক্ষে জনমত আছে। এখন তো ছাত্রলীগ দেশে আইনত নিষিদ্ধ। বলা হয়, ছাত্রাবাসে রাজনীতি করতে দেয়া হলে ভবিষ্যতে বিএনপি অনুসারী ছাত্রদল ও জামায়াত অনুসারী ছাত্রশিবির অতীতের ছাত্রলীগের মতো হয়ে উঠবে, সাধারণ ছাত্রদের ওপর অত্যাচার করবে, ভালোর দিকে পরিবর্তন কিছু হবে না। তবে এই পরিস্থিতি নিয়েও পুরনো রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলো প্যাঁচ খেলে। দেশের মূলধারার রাজনৈতিক নেতারাই তো এখন রাজনীতিকে ‘খেলা’ বলেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিনিয়ত যেকোনো ছোট-বড় রাজনৈতিক ঘটনার ভিডিও চিত্র ‘খেলা শুরু হয়ে গেছে’ লিখে পোস্ট দেয়া হচ্ছে। নানাভাবে রাজনীতিতে খারাপ অনুশীলন বাড়ছে, ভালো আচরণের পরিবর্তে। জুলাইয়ে ছাত্রাবাসে সাংগঠনিক রাজনীতি বন্ধ রাখার একটি সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া হয়েছিল। ছাত্রলীগ সরে যাওয়ায় ক্রমশ সেটা ভুলে যাওয়া হচ্ছে। গত ৯ই আগস্ট ১৮টি হলে ছাত্রদল কমিটি গঠন করে ঘোষণা দিলে সত্যিই একটা ‘খেলা’ হয়ে যায়। সাধারণ শিক্ষার্থী পরিচয়ে গভীর রাতে ছাত্রছাত্রীরা হল থেকে বেরিয়ে আসে, জমায়েত হয়ে ছাত্রদল এমনকি বিএনপি’র শীর্ষ নেতার নামেও অশ্লীল স্লোগান দেয়, দাবি তোলে হলে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। উপাচার্যকে পর্যন্ত গভীর রাতে ঐ জমায়েতে আসতে হয় পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য। এ ঘটনায় ছাত্রদল পাল্টা ছাত্রশিবিরকে ইঙ্গিত করে ‘গুপ্ত রাজনীতি’ বন্ধের দাবি জানায়। এর অর্থ হলো ছদ্মবেশে অন্য সংগঠনে ঢুকে কাজ করা। আমরা স্মরণ করতে পারি কোটা আন্দোলন থেকে সরকার পতনের আন্দোলনের পরে উদ্ঘাটিত হয় যে বৈষম্যবিরোধী নামের প্ল্যাটফরমটির কয়েকজন নেতা দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগ হয়ে কাজ করেছেন। শিবিরের অনেক ক্যাডার ছাত্রলীগের ভেতরে ঢুকে হাতুড়ি-হেলমেট নিয়ে সড়ক আন্দোলনের স্কুলছাত্রদের পিটিয়ে ছাত্রলীগের বদনাম করিয়েছে ইত্যাদি। জুলাই আন্দোলনের শুরুতে মেয়েদের ওপরে হামলায় ছাত্রলীগের অনেক বদনাম হয়েছে। এখানেও ছদ্মবেশী বা গুপ্ত রাজনীতির ভূমিকা থাকার বিষয়ে সন্দেহ আছে। দেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র শাসনামলে রাজনীতিতে চাঁদাবাজি-দখলসহ দুর্বৃত্তায়নের অভিযোগ ওঠে। এখন গুপ্ত রাজনীতির মতো নতুন ঘটনা দেখা যাচ্ছে। অথচ অন্তর্বর্তী সরকার কতো শত রাষ্ট্রীয় সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন। ছাত্রদলের হল কমিটি থাকবে এবং ঢাবি কর্তৃপক্ষ ছাত্রাবাসে ‘গঠনমূলক ছাত্র রাজনীতির রূপরেখা’ সুপারিশের জন্য পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। উচ্চশিক্ষার দুর্দশার মধ্যে প্রফেসররা একটি নতুন কাজ পেলেন। 


এই সার্বিক পটভূমিতে বলতে হয় যে, সাড়ে তিন দশক পরে এই যে ডাকসু-রাকসু নির্বাচন হচ্ছে তা যাতে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির ফাঁদে পড়ে ফাকসু না হয়ে যায় সেজন্য তথাকথিত ছাত্র রাজনীতির ক্ষেত্রেও সংস্কারের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগুতে হতো। সামপ্রতিক বছরগুলোতে এ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সেই ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত আমাদের ছাত্র রাজনীতির গৌরবের স্মৃতিতে বুঁদ থেকে আমরা বুঝতেই পারলাম না যে, ছাত্র রাজনীতি রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করে অনেক আগেই পচে গেছে। তখন ছিল ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র রাজনীতি নয়। এত দীর্ঘ সময় যে ডাকসু নির্বাচন হয়নি তার জন্য দায়ী দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। তারা নিজেদের স্বার্থে ছাত্রদের লাঠিয়াল বানিয়েছে। ছাত্ররা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদের মাধ্যমে নিজেদের নেতৃত্বগুণ বিকাশের সুযোগ হারিয়ে বিনষ্টি অর্জন করেছে। আমাদের নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ প্রতি বছর নির্বাচনসহ এর মৌলিক লক্ষ্যে ফিরুক এবং দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হোক। ১৮ বছরের বেশি বয়সী ছাত্ররা রাজনীতি করতে পারে মৌলিক অধিকার হিসেবেই, তবে সেটা করুক রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়ে, সংঘবদ্ধভাবে রাজনৈতিক দলের লাঠিয়াল হয়ে নয়। এমনকি রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্র ব্রিগেড গঠন করুক, তা ক্যাম্পাসে সীমিত দলীয় প্রচার করতে পারবে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে, কিন্তু সংগঠনের নামে ক্যাম্পাসে মারামারি-হানাহানি করতে পারবে না। 

বিশেষ রচনা'র অন্যান্য খবর